- ভারতীয় গুঁড়া মসলায়ও ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান
আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: ভারতীয় খাদ্যদ্রব্যে ‘ক্যানসারের বিষ’ পাওয়ার অভিযোগ তুলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগ। তাদের অভিযোগ, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে রফতানি করা অন্তত ৫২৭টি খাদ্যপণ্যে ‘বিষ’ পেয়েছে তারা। এর মধ্যে বেশিভাগই বাদাম, তিল, ভেষজ পদার্থ, মশলা, ডায়েট-ফুড জাতীয় খাদ্যবস্তু। ৮৭টি খাদ্যপণ্যকে সীমান্তেই আটকে দেয়া হয়েছিল। বাকি খাদ্যদ্রব্যগুলো পরে বাজার থেকে সরানো হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নে দাবি, ইথিলিন অক্সাইড নামে একটি বর্ণহীন গ্যাস কীটনাশক ও জীবাণুমুক্ত করার রাসায়নিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। রাসায়নিকটি চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু খাদ্যদ্রব্যে এই রাসায়নিক কোনোভাবে মিশে শরীরে ঢুকলে লিম্ফোমা এবং লিউকেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা খুব বেশি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন-ভুক্ত দেশগুলোতে খাদ্য-নিরাপত্তা বিষয়টির ওপর নজর রাখে ‘র্যাপিড অ্যালার্ট সিস্টেম ফর ফুড অ্যান্ড ফিড’ (আরএএসএফএফ)। তারা জানায়, ৫২৫টি খাদ্যদ্রব্যে রাসায়নিকটি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৩২টি দ্রব্য সরাসরি ভারত থেকে যায়। বাকি খাদ্যদ্রব্যগুলোতেও ভারতের নাম জড়িয়ে রয়েছে।
একটি খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষাকারী ল্যাবের মুখ্য কর্মকর্তা জুবিন জর্জ জোসেফ জানান, ইথিলিন অক্সাইড ছাড়াও আরো দু’টি রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। তিনি বলেন, ‘এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ইথিলিন গ্লাইকল। আফ্রিকায় কাশির সিরাপের মধ্যে এই রাসায়নিকটি পাওয়া গিয়েছিল। সিরাপ খেয়ে বহু শিশুর মৃত্যু হয়েছিল ওই ঘটনায়।’
জোসেফের বক্তব্য, ইথিলিন অক্সাইড চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একটা বিকল্প কিছু পাওয়া জরুরি। তার কথায়, ‘ভারতের খাবারের গুণমান ও নিরাপত্তা-বিষয়ক কর্তৃপক্ষ দ্য ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যানডার্ডস অথরিটির (এফএসএসএআই) ভেবে দেখা উচিত, যদি বিকল্প জীবাণুনাশক হিসেবে গামা রশ্মির ব্যবহার করা যায়। তাদের উচিত বিভিন্ন শিল্প-সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে ভাবতে উৎসাহ দেয়া।’
এই পরিস্থিতিতে ভারতের এক সমাজকর্মী উদ্বেগপ্রকাশ করে বলেন, ‘যে সব খাদ্যদ্রব্য বিদেশে রফতানি করা হয়, সেগুলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের। সেগুলোর যদি এই অবস্থা হয়, তা হলে স্থানীয় বাজারে যা বিক্রি হয়, তার কী অবস্থা কে জানে। সেগুলোও পরীক্ষা করা দরকার।’
বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম এই সংবাদ প্রকাশ করে লিখেছে, ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতি মেলায় ভারতীয় দুই কোম্পানির পণ্য হংকং এবং সিঙ্গাপুর নিষিদ্ধ করার ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এবার ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) রফতানি করা ভারতের পাঁচ শতাধিক পণ্যে একই রাসায়নিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ইউরোপীয় ফুড সেফটি অথরিটি বলেছে, ইউরোপে রফতানি করা ভারতীয় ৫২৭টি পণ্যে ইথিলিন অক্সাইড রাসায়নিকের উপস্থিতি মিলেছে। কিন্তু ভারতীয় কর্মকর্তারা এই রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সক্রিয় কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাদ্য নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ভারতের সাথে সংশ্লিষ্ট ৫২৭টি পণ্যে ইথিলিন অক্সাইড খুঁজে পেয়েছে। এসবের বেশির ভাগই বাদাম এবং তিলবীজ (৩১৩), ভেষজ ও মসলা (৬০), ডায়েট জাতীয় খাদ্য (৪৮) এবং অন্যান্য খাদ্যপণ্য (৩৪)। ইউরোপে রফতানি করা ভারতীয় এসব পণ্যের ৮৭টি চালান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্তে আটকে দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাকি পণ্য বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হয়।
এক ধরনের রঙহীন গ্যাস ইথিলিন অক্সাইড; যা ভারতীয় পণ্যগুলোতে কীটনাশক ও জীবাণুমুক্ত করার রাসায়নিক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। সাধারণত এই রাসায়নিক চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হয়। তবে খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহার করা এই রাসায়নিক শরীরে প্রবেশ করলে তা অন্যান্য ক্যান্সারের পাশাপাশি লিম্ফোমা এবং লিউকেমিয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোতে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংস্থা র্যাপিড অ্যালার্ট সিস্টেম ফর ফুড অ্যান্ড ফিডের (আরএএসএফএফ) তথ্যানুযায়ী, ৫২৫টি খাদ্যদ্রব্য ও দু’টি ফিড পণ্যে রাসায়নিকটি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৩৩২টি পণ্যের উৎস দেশ ভারত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আর বাকি খাদ্যপণ্য অন্যান্য দেশ থেকে গেলেও সেগুলোতে ভারতের ট্যাগ ব্যবহার করা হয়েছে।
ইউরোপে খাদ্যপণ্য পরীক্ষাকারী রামাইয়াহ অ্যাডভান্সড টেস্টিং ল্যাবের সিওও জুবিন জর্জ জোসেফ বলেছেন, সরাসরি ইথিলিন অক্সাইডের সংস্পর্শে আসা ছাড়াও খাদ্যপণ্যে মেলা আরো দু’টি রাসায়নিক ভোক্তাদের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল। তিনি বলেন, এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক ইথিলিন গ্লাইকল। কিছুদিন আগে আফ্রিকায় কাশির সিরাপের মধ্যে এই রাসায়নিক পাওয়া যায়। আফ্রিকায় এই সিরাপ খেয়ে অনেক শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। জোসেফ বলেন, ইথিলিন অক্সাইড চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত করার কাজে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর বিকল্প বের করা জরুরি বলে জোর দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় পণ্যের গুণগত মান ও নিরাপত্তাবিষয়ক কর্তৃপক্ষ দ্য ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (এফএসএসএআই) ভেবে দেখা উচিত বিকল্প জীবাণুনাশক হিসেবে গামা রশ্মির ব্যবহার করা যায় কি না। বিভিন্ন শিল্প-সংস্থাকে এ বিষয়ে ভাবতে উৎসাহ দেয়া দরকার।’
ভারতের জেলা ভোক্তা ফোরামের সদস্য এক কর্মী বলেন, রফতানি পণ্যে এ ধরনের রাসায়নিকের উপস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যেসব খাদ্যপণ্য বিদেশে রফতানি করা হয়, সেগুলো সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের। আর এসব পণ্যের মান যদি এমন হয় তা হলে স্থানীয় বাজারে যা বিক্রি হয়, তার কী অবস্থা? সেগুলোও পরীক্ষা করা দরকার।
এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে এফএসএসএআইয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে দেশটির সংবাদমাধ্যম ডেকান হেরাল্ড। তবে পত্রিকাটি প্রিন্টে যাওয়ার আগে পর্যন্ত এই বিষয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পায়নি। ডেকান হেরাল্ডের এক প্রশ্নের জবাবে জোসেফ বলেছেন, ইথিলিন অক্সাইড সম্ভবত পণ্যকে সালমোনেলা এবং ইকোলি ব্যাকটেরিয়া মুক্ত করার কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। এই রাসায়নিকের ব্যবহারকে সবচেয়ে সস্তাপদ্ধতি হিসেবে দেখা হয়। যা পণ্যকে শেলফ বা তাকে বেশি সময় ধরে রাখার কাজে সহায়তা করে। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ দেশ পণ্যসামগ্রীতে রাসায়নিকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে না। এটি করা হলে তা আমাদের একটি ভালো ধারণা পেতে সহায়তা করবে। এর আগে, গত ২৩ এপ্রিল রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচ ও এভারেস্ট স্পাইসেসের গুঁড়া মসলা বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে হংকং এবং সিঙ্গাপুর। হংকংয়ে ভারতীয় দুই কোম্পানির গুঁড়া মসলায় ক্যান্সার-সৃষ্টিকারী রাসায়নিক ইথিলিন অক্সাইডের উপস্থিতি পাওয়ার পর ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বলা হয়, চলতি মাসে হংকং মাছ রান্নায় ব্যবহৃত ভারতীয় কোম্পানি এমডিএইচের তিন ধরনের গুঁড়া মসলা ও এভারেস্টের একটি গুঁড়া মসলার বিক্রি স্থগিত করেছে। সিঙ্গাপুরও দেশটির বাজার থেকে এভারেস্টের গুঁড়া মসলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছে। একই সাথে রান্নার কাজে এসব মসলা ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছে। এই ঘটনার পর ভারতীয় খাদ্য কর্তৃপক্ষ গত সোমবার এমডিএইচ এবং এভারেস্টের গুঁড়া মসলার মান পরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছে।
ভারতীয় গুঁড়া মসলায় ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান!
ভারতের দুটি স্বনামধন্য গুঁড়া মসলা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্যে ‘কারসিনোজেন’ হিসেবে পরিচিত ইথিলিন অক্সাইড থাকায় হংকং ও সিঙ্গাপুরে কয়েকটি ব্র্যান্ডের মসলা বিক্রি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
ওই ব্র্যান্ডগুলোর মসলায় ইথিলিন অক্সাইড নামের গ্রুপ ওয়ান কারসিনোজেন বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান থাকায় তা মানবদেহের জন্য অতিমাত্রায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করেছে বলে জানা গেছে। ভারতের এমডিএইচ প্রাইভেট এবং এভারেস্ট ফুড প্রোডাক্টস প্রাইভেট কোম্পানির কয়েকটি গুঁড়া মসলায় পাওয়া গেছে এই উপাদান।
হংকংয়ে সরকারের খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগ গত ৫ এপ্রিল এক বিবৃতিতে জানায়, এমডিএইচ গ্রুপের মসলা মাদ্রাজ কারি পাউডার, সম্ভার মসলা পাউডার ও কারি পাউডারে পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ইথিলিন অক্সাইড, যা কীটনাশক হিসেবেও করা হয়। পাশাপাশি এভারেস্ট গ্রুপের ফিশ কারি মসলাতেও পাওয়া গেছে সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি ইথিলিন অক্সাইড।
আন্তর্জাতিক ক্যানসার গবেষণা এজেন্সির শ্রেণিবিন্যাসে ইথিলিন অক্সাইড হলো গ্রুপ ওয়ান কারসিনোজেন বা ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান। এই উপাদানের উপস্থিতি মানব দেহে ব্রেস্ট ক্যানসারসহ মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
ভারতীয় মসলায় স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান থাকার অভিযোগ এর আগেও এসেছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন বিভাগ (এফডিএ) দেশটির এভারেস্ট ফুড প্রডাক্টসের মসলায় সালমোনেলা ব্যাকটেরিয়ার উপাদান থাকায় তা বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।