ঢাকা অফিস: ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতি ঐক্যবদ্ধ। হিন্দুত্ববাদী ভারতের আগ্রাসন, ষড়যন্ত্র, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কাল্পকাহিনী বানিয়ে অপপ্রচার, দিল্লিতে আশ্রয় নেতা খুনি হাসিনার অপতৎপরতা রুখে দিতে সব মত-পথের রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধভাবে ড. ইউনূসের পাশে থাকার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। এখন থেকে দেশের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে যেকোনো আঘাত এলে দল-মত নির্বিশেষে সব দল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিহত করবে। গণহত্যাকারী হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া ভারত একের পর এক ষড়যন্ত্র করছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার আগামী নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের বিপক্ষে হিন্দু ভোটার টানতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি, আরএসএস, ভিএইচপি মিলে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন কার্ড খেলছে। এটি করতে গিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নিয়ে ‘খেলা’ শুরু করেছে। দিল্লি চেতনা লালন করা এদেশীয় কিছু এজেন্ট মমতা ব্যানার্জির বক্তব্য তালগোল পাকিয়ে মোদির ষড়যন্ত্র কার্পেটের নিচে চাপা দিয়ে মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছে। অন্যদিকে পলাতক হাসিনা একের পর এক বাংলাদেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের সব ধরনের ষড়যন্ত্র ঐক্যবদ্ধভাব রুখে দিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেন। তার ডাকে সাড়া দিয়েছে দেশের সব রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় নেতা ও শিক্ষার্থীরা। এমনকি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারাও ভারতের অপপ্রচার রুখে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
ভারতের নানামুখী ষড়যন্ত্র ডালপালা ছড়ানোর মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যম, বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে ফেইক তথ্য দিয়ে বিভ্রান্তিমূলক খবর প্রচারের প্রতিযোগিতায় নামে। এ অবস্থায় দেশের সব রাজনৈতিক দলকে এক প্ল্যাটফর্মে এনে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধের পরিকল্পনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি ঢাকায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সিরিজ সংলাপের আয়োজন করেন। তারই অংশ হিসেবে গত মঙ্গলবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেন। বুধবার বৈঠক করেন বিএনপি, জামায়াত, কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে। গতকাল বৃহস্পতিবার ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন।
জানা গেছে, বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম-বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা, কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব সাজেদুর রহমান, হেফাজতের কেন্দ্রীয় নেতা মুহিউদ্দিন রাব্বানী, জুনায়েদ আল হাবিব ও মুনির হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ডের (বেফাক) মহাসচিব মাহফুজুল হক, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের শায়খ আহমদুল্লাহ, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব আবদুল মালেকসহ কয়েকজন আলেম অংশগ্রহণ করেন।
সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে বক্তব্য দিলেও সব দলের নেতা প্রতিশ্রুতি দেন তারা দেশবিরোধী যেকোনো ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সবসময় প্রস্তুত। ডাক পেলেই তারা নেমে আসবেন। দু’-একটি দল থেকে জাতীয় কাউন্সিল আয়োজনের পরামর্শ দেয়া হয়। নেতাদের কেউ কেউ বলেছেন, ড. ইউনূস ডাক দিলে দেশের ১৮ কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে আসবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও হিন্দুত্ববাদী ভারতকে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না।
অবশ্য পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারতের ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়ানোর ব্যাপারে এক ধরনের ঐক্য আগেই হয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয়ার পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ উঠায় বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী দলগুলো, মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক সবাই সারাদেশে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘর পাহরা দিয়েছেন। ইসকন ইস্যুতেও সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। চট্টগ্রাম আদালতে একজন আইনজীবীকে হত্যার পর লাখো তৌহিদি জনতা জানাজায় অংশ নেন। অথচ কোথাও কেউ ইসকনের উপর আক্রমণ করেনি। ঐক্য তো হয়েই রয়েছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার বলেন, ভারত ও ভারতীয় জনগণের একাংশ আওয়ামী প্রোপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে বাংলাদেশের জনগণকে শত্রু বানাচ্ছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখনই হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান নাগরিকরা সর্বক্ষণ আতঙ্কিত থাকে; এখন হিন্দু জনগণ শান্তিতে জীবন নির্বাহ করছে। ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হিন্দুরা রুখে দাঁড়াবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানান, রাজনৈতিক দলগুলো সব দলকে নিয়ে কাউন্সিল করে ঐক্য গড়ার সুপারিশ করেছে। রাজনৈতিক দলগুলো ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং ভারতীয় ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সব দল ও সরকার মিলে একটি কাউন্সিল করে ঐক্য গড়ে তোলার সুপারিশ এসেছে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বলেছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা প্রশ্নে ভারতকে এক চুলও ছাড় দেয়া হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ জানান, ভারতের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানোর বিপরীতে আমাদের প্রচার করতে হবে, বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ, বিশ্ব দরবারে সেই তথ্য তুলে ধরতে হবে। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবে। এত দিন বাংলাদেশকে আওয়ামী লীগের চোখ দিয়ে দেখেছে, এতে জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক হয়নি, রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক হয়নি। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের দেশের জনগণের বিমাতাসুলভ সম্পর্ক নেই।
গতকাল প্রধান উপদেষ্টা দেশের হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও মুসলিমসহ বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তিনি ধর্ম-বর্ণ ও মতের পার্থক্য থাকলেও বাংলাদেশের সব মানুষ একই পরিবারের সদস্য বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আমাদের শত পার্থক্য থাকা সত্তেও আমরা পরস্পরের শত্রু নই। আমাদের জাতীয়তা, পরিচয়ের প্রশ্নে এক জায়গায় চলে আসি। আমরা বাংলাদেশি, এক পরিবারের সদস্য। ভুল তথ্যের বিষয়ে সবাইকে সজাগ ও সতর্ক থাকতে হবে।
মূলত ৫ আগস্ট হাসিনা পালালেও জাতীয় নির্বাচন, ভারতের সাথে সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নির্ধারণসহ নানা ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলো ও ছাত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে মতপার্থক ছিল। তবে দেশের ভারতের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টিতে ঐকমত্য হয়েছে। গত শনিবার দেশের ৫০ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়ে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার দোসর ভারতের সব অপচেষ্টা রুখে দিতে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, পরাজিত শক্তি বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের প্রকাশ্য এবং গোপন সমর্থনে দেশে বিভাজন সৃষ্টিতে মিথ্যা তথ্য ও অপপ্রচার ছড়াচ্ছে এবং সহিংসতা উসকে দিচ্ছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচারের অতিরঞ্জিত, মিথ্য প্রচারণা চালাচ্ছে। আমরা সব বাংলাদেশিকে, ধর্ম, রাজনৈতিক মতাদর্শ, আদর্শ, লিঙ্গ, বয়স বা যেকোনো বৈশিষ্ট্যের পার্থক্যের ঊর্ধ্বে উঠে এই হুমকির মুখে জাতীয় ঐক্যের আহবান জানাচ্ছি।
সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক বিবৃতিতে চলমান পরিস্থিতিতে দেশের পক্ষের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে জনগণের উদ্দেশে বলেন, সরকারকে আরেকটু সময় দিন, আরেকটু ধৈর্যের পরিচয় দিন, শান্ত থাকুন। পরিস্থিতির ওপর সতর্ক ও সজাগ দৃষ্টি রাখুন। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে আমাদের প্রত্যেককে মনে রাখতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যাত্রাপথে ষড়যন্ত্রকারীদের বাধা বিচক্ষণতার সঙ্গে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হলে স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে চরম মূল্য দিতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেছেন, রাজনৈতিক দল, জনগণ বা সরকার এখানে আলাদা কিছু নয়। বাংলাদেশের অখন্ডতা রক্ষা এবং জনগণকে ঐক্যবদ্ধ রাখার কাজ সবার। এই ঐক্য ধরে রাখলে আর কখনোই ফ্যাসিজম ফিরে আসবে না। বিএনপি ও জামায়াত নেতারাও অখন্ডতা ও ঐক্যের কথা বলেছেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সবাই ঐক্যবদ্ধ থেকে কীভাবে কাজ করা যায় সে ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কোনো ধরনের হুমকির মধ্যে নেই। সীমান্তে উত্তেজনা নেই। সীমান্ত অন্যান্য সময়ের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। তবে ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে অপপ্রচার চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে হয় ভুল করে বাংলাদেশের নাম বলে ফেলেছেন। আমার তো মনে হয় ভারতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা প্রয়োজন। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে।