- মুসলিম বাঙালিদের তাড়ানোর খেলায় বিজেপি
- দিল্লিতে সিজদারত মুসল্লিদেরকে পুলিশের বুটের লাথি
পশ্চিমবঙ্গ নিউজ ডেস্ক: ভারতে লোকসভা নির্বাচনের আগেই সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) কার্যকর হলো। সোমবার এ সম্পর্কিত একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সিএএ চালু করার কথা ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে সংসদে আইনটি পাস হওয়ার প্রায় চার বছর পর চালু হলো নতুন এ নাগরিকত্ব আইন।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বরে ভারতের সংসদে পাস হয় সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন। এ আইন অনুযায়ী ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে আসা অমুসলিম নাগরিকরা (হিন্দু শিখ খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি, বৌদ্ধ) ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবেন। আর মুসলিম নাগরিকরা বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত হবেন।
২০১৯ সালে আইনে পরিণত হওয়া সিএএ-তে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। বিতর্কিত এই সিএএ আটকাতে মঙ্গলবারই সুপ্রিমকোর্টের দ্বারস্থ হলো একটি মুসলিম সংগঠন। কেরালার আঞ্চলিক দল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লিগ (আইইউএমএল) শীর্ষ আদালতে সিএএ নিয়ে দ্রুত হস্তক্ষেপের আর্জি জানিয়েছে। সুপ্রিমকোর্টে জমা দেওয়া আবেদনে আইইউএমএল বলেছে, সিএএ ‘অসাংবিধানিক এবং বিভাজনের আইন।’
দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর সিএএ পাশ করিয়েছিল মোদি সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো মুসলিম ধর্মাবলম্বী দেশ থেকে যদি সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে ভারতে আশ্রয় চান, তা হলে তা দেবে ভারত। কিন্তু সিএএ-তে হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পার্সি এবং খ্রিস্টান শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও সেখানে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্তদের কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রায় সাড়ে চার বছর আগে সংসদের উভয় কক্ষে পাশ হওয়ার পর দেশটির তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও অনুমোদন দিয়েছিলেন সিএএ বিলে। কিন্তু এতদিন ধরে সিএএ কার্যকর করা নিয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জানিয়েছিলেন, লোকসভা নির্বাচনের আগেই দেশে সিএএ কার্যকর হবে। শুধু তা-ই নয়, শাহ এ-ও বলেছিলেন, শিগগিরই সিএএ কার্যকর করার বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে যাবে।
এ আইনের বিরোধিতা করে প্রতিবাদে নেমেছে কংগ্রেস, তৃণমূলসহ বিরোধী দলগুলো। তাদের দাবি, ধর্মের ভিত্তিতে এ আইন কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। এ আইনকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে সহিংসতা, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ কিছু রাজ্য চায় না সিএএ। যদিও আসাম সরকার যেহেতু বিজেপি সরকার তাই তারা বিপক্ষ নয়, কিন্তু আসামের জনগণ সিএএ র বিপক্ষে। সোমবার সন্ধ্যায় মোদি সরকার বিজ্ঞপ্তি জারি করতেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে আসামে। মঙ্গলবার রাজ্যজুড়ে হরতালের ডাক দিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন। তবে সেই সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন বাতিলের হুমকিও দেন আগের দিন। অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (এএএসইউ) এবং অন্যান্য গোষ্ঠীগুলো মঙ্গলবার এ বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়। রাজ্যজুড়ে এদিন বিক্ষোভ-সমাবেশ এবং সিএএর কপি পোড়ানো হয় । আসামের ১৬টি বিরোধী দলের জোট ইউওএফএ সাফ জানিয়েছিল, সিএএ কার্যকর হওয়ার পরদিন থেকেই রাজ্যজুড়ে বন্ধ-হরতাল শুরু হবে। এদিনের বিক্ষোভে অংশ নেয় তারাও।
মোদি সরকারের সিএএ আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও। মঙ্গলবার উত্তর চব্বিশ পরগনার হাবড়ার প্রশাসনিক সভা থেকে মমতা বলেন, ‘ভোটের আগে বিজেপি বিভাজনের খেলা খেলতেই এটা করেছে। তা হলে চার বছর বসে রইল কেন? ওরা আবার বাংলাটাকে ভাগ করতে চায়। বাঙালিকে তাড়াতে চায়।’ এই প্রসঙ্গেই মমতা ২০১৯ সালে আসামের ঘটনার উল্লেখ করেন। তার কথায়, ‘২০১৯ সালে আসামে এনআরসির নামে ১৯ লাখ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা কথা মন দিয়ে শুনে নিন! আপনারা কেউ নাগরিকত্বের জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করবেন না। করলেই আপনাদের নাগরিকত্ব চলে যাবে। আপনাকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী বলবে। আপনার সম্পত্তি কেড়ে নেবে। ওই ফাঁদে খবরদার পা দেবেন না!’
যদিও ভারতের সংবিধান বলছে, রাজ্য সরকার চাইলেও সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আটকাতে পারবে না। সংবিধানের সপ্তম তফসিল অনুযায়ী, নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন বদল, সংশোধন বা বলবত করার অধিকার শুধুমাত্র কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত। রাজ্য সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না। শুধু তাই নয়, সংবিধানের ২৪৬ নং অনুচ্ছেদ বলছে নাগরিকত্ব সম্পর্কিত আইন প্রণয়নের অধিকার শুধু সংসদের আছে। রাজ্য বিধানসভার নেই। রাজ্য সরকার কিছুই করতে পারবে না।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ-পাকিস্তান-আফগানিস্তান থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দিতে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি আলাদা পোর্টাল তৈরি করেছে। এই বিশেষ পোর্টালটি মঙ্গলবার ১২ মার্চ থেকে চালুও হয়ে গেছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, যেহেতু ভারতের বেশ কয়েকটি বিরোধী দল শাসিত রাজ্য সরকার হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে তারা কিছুতেই নাগরিকত্ব আইন বলবৎ করবে না, তাই এই রাজ্য সরকারগুলোকে ‘বাইপাস’ করতে বা পাশ কাটাতেই কেন্দ্রীয় সরকার এই প্রক্রিয়াটিকে ‘সম্পূর্ণ অনলাইন’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
দিল্লিতে সিজদারত মুসল্লিদের পুলিশের লাথি
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে ব্যস্ত সড়কের পাশে জুম্মার নামাজ পড়ার সময় কয়েকজন মুসল্লিকে লাথি ও ধাক্কা মেরেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা। এই ঘটনায় বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ পুলিশ কর্মকর্তা দ্বারা নামাজ পাঠরত মুসল্লিদের লাথি মারার ঘটনাকে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বলে অভিহিত করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর ভিকে সাক্সেনাকে চিঠি লিখে অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্তের দাবিতে চিঠি দিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, এ ধরনের ঘটনা বৈশ্বিক পর্যায়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতারা উত্তর দিল্লির ইন্দ্রলোক এলাকায় রাস্তায় নামাজ পড়া কিছু লোককে লাথি মারার ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে এফআইআর নিবন্ধনের দাবি জানিয়েছেন। কংগ্রেসের এমপি ইমরান প্রতাপগড়ি বলেছেন, অভিযুক্ত পুলিশকর্মীর বিরুদ্ধে এফআইআর করা উচিত। দানিশ আলী এমপি বলেছেন, দেশে যে সাম্প্রদায়িক পরিবেশ বিরাজ করছে তারই ফলশ্রুতিতে নামাজ পড়তে যাওয়া ব্যক্তিদের লাথি-থাপ্পড় মারার সাহস পাচ্ছে। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে একদিন ভারতে এক সম্প্রদায়ের লোকেরা রাস্তায় প্রার্থনা করবে, তাদের উপর ফুল বর্ষণ করা হবে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকদের আঘাত করা হবে। ওই পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতার করা উচিত।
এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় পুলিশ সদস্যকে গ্রেফতারের দাবি ও ওই ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।
দিল্লির ইন্দ্রলোক এলাকার ঘটনা প্রসঙ্গে গুড্ডু আনসারি নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি গণমাধ্যমকে বলেন, (মসজিদে) শুক্রবার অতিরিক্ত নামাজিরা আসায় ৩ দফায় নামাজ হয় এখানে যাতে সড়কে ভিড় না হয়। কিন্তু কিছু লোক সড়কের একপাশে নামাজ পড়ছিলেন, এ সময়ে পুলিশ তাদেরকে ধাক্কা দেয়, লাথি মারে, চড় মারে। তার দাবি-নামাজের জন্য মাত্র ৪ মিনিট লাগে। পুলিশের এ ধরণের আচরণ উচিত নয়। মুহাম্মদ হারুণ নামে এক ব্যক্তি বলেন, সড়কের একপাশে কিছু মানুষ নামাজ পড়ছিলেন। এতে যানবাহন চলাচলে কোনোই সমস্যা ছিল না। কিন্তু জানি না, ওই পুলিশ কর্মকর্তার কী সমস্যা হচ্ছিল। অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে সাসপেন্ড করায় তারা খুশি বলেও জানিয়েছেন মুহাম্মদ হারুণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক বার্তায় মিস্টার হক নামে এক ব্যক্তি কাওয়াড়িদের উপর পুলিশ সদস্যদের ফুল বর্ষণের একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, দুই ভারত। দিল্লি পুলিশ ইন্দ্রলোকে দিল্লিতে নামাজ পড়া লোকদের লাথি মারছে। অন্যদিকে, পুলিশ কাওয়াড়িদের রাস্তার মাঝখানে ফুল দিয়ে স্বাগত জানায়।
নামাজিদের পুলিশ কর্মকর্তার হেনস্তা করার ৩৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দিল্লির ইন্দ্রলোক এলাকায় রাস্তায় নামাজে দাঁড়ানো মুসল্লিদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। ওই সময় হঠাৎ করে রেগে গিয়ে পিছন থেকে দুই মুসল্লিকে তিনি লাথি দেন। এরপর একসঙ্গে কয়েকজনকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। বসে থাকা আরেক মুসল্লির মুখে ধাক্কা দেওয়ার পর কয়েকজন মুসল্লি ক্ষিপ্ত হয়ে যান। তখন তারা ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে গণধোলাই দেন। এরপর তিনি দৌড় দিলে অন্যরাও দৌড়ে তাকে তাড়া করেন।
দিল্লি উত্তর পুলিশের উপকমিশনার এমকে মিনা বার্তাসংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, “আজ যা ঘটেছে তার প্রেক্ষিতে, পুলিশ পোস্ট ইনচার্জ, যাকে ভিডিওতে দেখা গেছে, তাকে তাৎক্ষণিকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।” এছাড়া ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি। নামাজিদের হেনস্তা করার কারণে পরবর্তীতে মুসল্লিরা সড়ক অবরোধ করেন এবং অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। জানা গেছে, জুম্মার নামাজের সময় মসজিদ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর মুসল্লিরা রাস্তায় নামাজ আদায় করেন। তখনই তাদের ওপর চড়াও হন পুলিশের ওই সদস্য।