আজও ভাষা সংগ্রামীদের সঠিক তালিকা করা সম্ভব হয়নি-ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরের ইতিহাসে এটাই পরম সত্য। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কাছ থেকে জাতির অধিকার আদায়ের প্রথম লড়াইয়ের সংগ্রামীদের সঠিক তালিকা করা আজ আর সম্ভবও নয়। সেটি রীতিমতো দুরূহ একটি কাজ। ভাষাসংগ্রাম সারা দেশে হলেও সে ইতিহাস পূর্ণাঙ্গভাবে সংগ্রামীরাও লিপিবদ্ধ করেননি, তেমন সরকারি উদ্যোগও ছিল না। অন্যদিকে গবেষণা বা মাঠপর্যায়ে কাজের মাধ্যমেও তুলে আনা সম্ভব হয়নি ভাষাসংগ্রামীদের নাম।
বর্তমানে ৯৩ বছর বয়সি ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক রোববার বলেন, আজ ৭০ বছর পর যেখানে অধিকাংশ ভাষাসংগ্রামী ও প্রত্যক্ষদর্শী মারা গেছেন সেখানে এখন আর তালিকা তৈরির চেষ্টা ঠিক হবে বলে মনে করি না। যেহেতু তালিকা তৈরির বিষয়ে হাইকোর্টের নির্দেশ আছে, সে হিসাবে চেষ্টা হতে পারে কিন্তু কতটা সঠিক হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কারণ ভাষাসংগ্রামীদের অনুপস্থিতিতে যে বা যারা তথ্য দেবেন তারা কতটা সঠিক তথ্য দিচ্ছেন সেটা যাচাই-বাছাই হবে কীভাবে? মনে রাখতে হবে, তালিকা তৈরি করতে গিয়ে যেন যুদ্ধ না করেও মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢুকে যাওয়ার মতো ঘটনা ভাষাসংগ্রামীদের তালিকার ক্ষেত্রেও না ঘটে।
আহমদ রফিক বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় আমার বয়স ছিল ২৩ বছর। ঢাকায় বর্তমানে জীবিত ভাষাসংগ্রামী আমি ছাড়া কাউকে তো দেখি না। আমার জানা মতে, চট্টগ্রাম, খুলনা, মেহেরপুর, ময়মনসিংহ, নবাবগঞ্জসহ অনেক জেলায় এখন আর কোনো ভাষাসংগ্রামী জীবিত নেই।
এদিকে ভাষাসংগ্রামীদের নামের তালিকা তৈরির বিষয়ে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কোনো অগ্রগতির তথ্য পাওয়া যায়নি।
কয়েক বছর ধরে ভাষা আন্দোলন বিষয়ে গবেষণা করছেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। তিনি বলেন, ‘ভাষাসংগ্রামী’ বা ‘ভাষাসৈনিক’ কারা, তার ব্যাখ্যা কী সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। বিষয়টি এখনো ‘দুরূহ’ অবস্থায় আছে। তাই প্রথমে হাইকোর্টকে এ বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলতে হবে, কাদেরকে আসলে আমরা ভাষাসংগ্রামী বলব। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়ে যেমন বিষয়টি খুব স্পষ্ট করে বলা আছে। আমার বিবেচনায় ভাষাসংগ্রামী বা ভাষাসৈনিক তিনি, যিনি ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন বা বিশেষ অবদান রেখেছেন।
তালিকা তৈরির বিষয়ে তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের খুঁজে পেতে কিছু পন্থার কথা বলতে পারি। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন জেলা ও বিভিন্ন অঞ্চলে যতগুলো রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়েছে সেই কমিটির তালিকা যদি পাওয়া যায় তাহলে কাজ এগিয়ে যাবে। কমিটির সদস্যরা ভাষাসংগ্রামী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হবেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় যারা ভাষা আন্দোলনে মারা গেছেন, যারা আহত হয়েছেন, যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন, যাদের নামে মামলা হয়েছিল তারা ভাষাসংগ্রামী হবেন। ভাষা সংগ্রামের মিছিলে হয়তো হাজার হাজার মানুষ হেঁটেছিলেন। এখন তারাও যদি দাবি করেন, আমি ভাষাসংগ্রামী, আমাকে একুশে পদক দিতে হবে তাহলে সেটি যুক্তিসঙ্গত হয় না। এজন্য ৬৪ জেলায় অনুসন্ধান কমিটি করে সেখানকার প্রবীণ, শিক্ষাবিদ, যদি ভাষাসংগ্রামী কেউ জীবিত থাকেন তাকে যুক্ত করা যেতে পারে। তারা সেখানের ভাষাসংগ্রামীদের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে উপযুক্ত ডকুমেন্ট, সেই সময়ের লিফলেট, ম্মরণিকা বা অন্যকিছুর মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামীদের তালিকা তৈরির আবেদন জানিয়ে ২০১০ সালে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট তালিকা তৈরির নির্দেশ দিলে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে একটি তালিকা পেশ করেছিল। যেখানে জিল্লুর রহমান, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবদুল মতিন, হাবিবুর রহমানসহ ৬৮ জন ভাষাসংগ্রামীর নাম ছিল। তালিকাটি গেজেট আকারে প্রকাশ হয় ২০১২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু সেখানে এমন কিছু নামও ছিল যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পূর্ণাঙ্গ নয় এবং বিতর্ক রয়েছে-এমন অভিযোগে তালিকা প্রণয়নের কাজটি স্থগিত করা হয়।
পরে হাইকোর্টের নির্দেশনায় ঢাকাসহ দেশের সব জেলায় কমিটি গঠন করে তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শুধু ঢাকায় ভাষাসৈনিক আহমদ রফিককে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল। কমিটিতে আরও ছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ও ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন। কিন্তু সেই কমিটির মাত্র একটি বৈঠক হয়েছিল, যাতে কাজের পদ্ধতির জটিলতা নিয়েই শুধু আলোচনা হয়। এরপর থেকে তালিকা প্রণয়নের কাজটি কার্যত বন্ধ রয়েছে এবং বিষয়টি সরকারিভাবে সম্পন্ন করার সে অর্থে আর কোনো উদ্যোগ নেই। সেই সময় তালিকা প্রস্তুত করার বিষয়টি জটিল হিসাবে উল্লেখ করে ভাষা সংগ্রামী আহমদ রফিক বলেছিলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে চেষ্টা করা হলেও বিষয়টি নিয়ে হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়। নানান জায়গা থেকে ভাষাসংগ্রামীর দাবি করেন নানাজন। পরবর্তী সময়ে আহমদ রফিক যুগান্তরকে বলেন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণে অবহেলা হয়েছে। সেটা সব আমলেই। মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ১৬ খণ্ডে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র সংরক্ষণ, সংকলন বা ইতিহাস ধরে রাখার জন্য কিছুই হয়নি। এমনকি বর্তমানে ইচ্ছা থাকলেও আর সেটা করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের বন্ধুবান্ধব যারা সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, আন্দোলন সংগঠিত করেছেন বা নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের বেশিরভাগই আজ প্রয়াত। আমার মতো দু-চারজন বেঁচে আছেন।