।। আলফাজ আনাম ।।
ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর প্রচারের ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। দেশটির সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং গণতন্ত্রের অবনমনের অন্যতম একটি কারণ হলো ভুয়া খবর প্রচার। ভারতে ভুয়া খবরের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ ধরনের খবর প্রচার করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন চালানোর পরিবেশ তৈরি করা হয়। বিশ্বের বহু দেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া খবর ছড়ানোকে একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফলে ভুয়া খবরের বিস্তার ও প্রভাব কমানোর জন্য ফ্যাক্ট চেককে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। কিন্তু ভারত এমন এক দেশ, যে দেশের মূলধারার গণমাধ্যম ভুয়া খবর তৈরি ও প্রচার করে থাকে।
ভারতের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে ভারতের গণমাধ্যম সাংবাদিকতার ন্যূনতম নীতি মেনে চলতে রাজি নয়। দীর্ঘদিন থেকে ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে ভুয়া খবর প্রচারের কৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডিস ইনফো ল্যাব তাদের এক গবেষণায় ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভুয়া খবর প্রচারের একটি নেটওয়ার্কের বিবরণ তুলে ধরে। গবেষণা সংস্থাটি জানিয়েছিল, তারা ফেইক নিউজ বা ভুয়া খবর ছড়ায় এমন ২৬০টিরও বেশি ওয়েবসাইটের সন্ধান পেয়েছে, যেগুলো যারা বিশ্বব্যাপী ভারত সরকারের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করছে। এসব ভুয়া ওয়েবসাইট ভারতকে সুবিধা দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত সমালোচনার মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, বেলজিয়াম এবং জেনেভাসহ ৬৫টি দেশ থেকে এই ওয়েবসাইটগুলো কাজ করে।
ডিজইনফোল্যাবের গবেষণায় বলা হয়, বেশিরভাগ ভুয়া ওয়েবসাইটের নাম রাখা হয়েছে বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র এবং সংবাদমাধ্যমের ভুয়া সাইটের নামে। এ ছাড়া বিজনেস ইনসাইডার ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মাইক্রোসফটের এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ভুয়া খবর ছড়ায় ভারতেই। মাইক্রোসফটের জরিপ অনুযায়ী, ৬০ শতাংশেরও বেশি অনলাইনে ভুয়া খবরের মুখোমুখি হয়েছেন; যেখানে এ হারের বৈশ্বিক গড় ৫৭ শতাংশ। ভারতের ভুয়া খবরের নতুন এক রূপ দেখছে বাংলাদেশের মানুষ। গত বছরের ৫ আগস্ট ভারতের অনুগত হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় নেমে পড়ে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যম।
এর আগে দুই মাস ধরে বাংলাদেশে তীব্র ছাত্র আন্দোলন চললেও, সে খবর ভারতের গণমাধ্যমগুলোয় তেমন কোনো স্থান পায়নি। কিন্তু হাসিনার পতনের পর থেকে ভারতের গণমাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে ইসলামপন্থিদের আন্দোলন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়। ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের আগে এনডিটিভির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে বলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থির করে তোলেন, তবে চারপাশে এর প্রভাব পড়বে। মিয়ানমার, সেভেন সিস্টার, পশ্চিমবঙ্গসব জায়গাতেই এর প্রভাব পড়বে। এটা হবে অগ্ন্যুৎপাতের মতো, যার প্রভাব পড়বে চারপাশে।’ ড. ইউনূসের এই বার্তা ভারতের জন্য সুখকর ছিল না। এরপর থেকে ভারতীয় মিডিয়ার একটি অংশের টার্গেটে পরিণত হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে শেখ হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে গেছেন। সেখানে তিনি ভারত সরকারের নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন। শুধু তাই নয়, হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ও গণহত্যার নির্দেশদাতা মন্ত্রী ও এমপিরাও আছেন ভারতে। হাসিনা ও তার সহযোগী অনেকের পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। তাদের ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় ভারতে আশ্রয় নেওয়া ছাত্র-জনতার হত্যাকারীরা কী অবস্থায় ভারতে অবস্থান করছে, সেটি একটি গুরুতর প্রশ্ন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল, শেখ হাসিনা ভারতে থাকলেও তিনি যেন নিশ্চুপ থাকেন। কিন্তু দেখা গেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে তার দলের নেতাকর্মীদের দেশের ভেতরে অস্থিরতা সৃষ্টির নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করার পর তাকে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ করে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারতের পক্ষ থেকে তাতে সাড়া দেওয়া হয়নি। কিন্তু এরপর থেকে ভারতের গণমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য সব গাঁজাখুরি প্রচারণা চলছে।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে ভুয়া খবরের পাশাপাশি এমনসব খবর প্রচার করা হয়, যেগুলোকে গাঁজাখুরি বললেও কম বলা হবে। যেমনÑ জি-নিউজ ২৮ ডিসেম্বর একটি খবর প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল, Analysing Mohammad Yunus’s Alleged Operation Octopus In Bangladesh. এতে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে ইরানের রেভ্যুলেশনারি গার্ডের মতো ইসলামিক রেভ্যুলেশনারি আর্মি নামে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন গঠন করা হচ্ছে। যেটি হুতি ও হিজবুল্লাহর মতো কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। এরপর ফার্স্টপোস্টের ইউটিউব চ্যানেলে পালকি শর্মা আরেকটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন, যার শিরোনাম ছিল Bangladesh Appoints Terror Group Leader as Home Secretary. এই রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের বর্তমান স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি একটি ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা। তিনি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে দাবি করা হয়।
ক্যাডেট কলেজের লেখাপড়া করা নাসিমুল গনি প্রশাসনে একজন দক্ষ আমলা হিসেবে পরিচিত। যিনি বিএনপির শাসনামলে বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক এবং স্পিকারের একান্ত সচিব ছিলেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর যে তিনজন অতিরিক্ত সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসর দেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন। শুধু বিএনপি সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের কারণে তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। এ ধরনের একজন আমলাকে ভারতীয় মিডিয়া এখন সন্ত্রাসী সংগঠনের প্রধান হিসেবে তুলে ধরছে। এর আগে বর্তমান তথ্য উপদেষ্টা ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা মাহফুজ আলমকেও হিযবুত তাহরীরের নেতা হিসেবে ভারতের গণমাধ্যমে প্রচারণা চালানো হয়।
দিল্লি থেকে প্রকাশ হওয়া ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোয় এ ধরনের ভুয়া খবরের প্রচার এখন কিছুটা কমে এলেও পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেল নতুন উদ্যমে ভুয়া খবর চালিয়ে যাচ্ছে। এসব চ্যানেলে এখন নিয়মিতভাবে পালিয়ে যাওয়া আওয়ামী প্রচারবিদদের হাজির করা হচ্ছে। সম্ভবত আওয়ামী লীগের লুটপাট করা অর্থের বড় একটি অংশ পাচ্ছে কলকাতার হিন্দুত্ববাদী এই টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। গত দেড় দশকে জোরপূর্বক রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময় ভারতীয় সাংবাদিকদের পেছনে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে আওয়ামী লীগ। ভারতীয় সাংবাদিকদের ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে রেখে আওয়ামী লীগের উন্নয়ন তত্ত্ব প্রচার করা হতো। আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় না রাখলে বাংলাদেশে ইসলামপন্থিরা ক্ষমতা দখল করবে, এটা ছিল ভারতীয় সাংবাদিকদের বয়ান।
হাসিনার পতনের পরও ভারতের সাংবাদিকরা এই মনস্তাত্বিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। এখন আওয়ামী লীগের লুটের অর্থ পকেটে যাওয়ার পর তারা কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্প্রতি পশ্চিম বাংলার দুটি টেলিভিশনে এ ধরনের এক আজগুবি খবর প্রচার করা হয়েছে। এ খবরের বিষয় হলো সদ্য পদত্যাগ করা উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম, উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের নেতা খান তালাত মাহমুদ রাফি বিট কয়েনের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। এ খবরের সূত্র হচ্ছে আওয়ামী ভুয়া এক ওয়েবসাইট। হাসিনার পতনের পর ২৫ অক্টোবর খোলা হয় দ্য এশিয়া পোস্ট নিউজ নামে একটি ওয়েবসাইট। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ভুয়া খবর প্রচার করা হয়।
ভুয়া ওয়েবসাইট খোলার এই আইডিয়া আওয়ামী লীগ হয়তো পেয়েছে ভারতের তথ্যযুদ্ধের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। অবশ্য মিথ্যা প্রচারণায় আওয়ামী লীগের পারদর্শিতাও কম নয়। ২০২৪ সালের ডামি নির্বাচনের আগে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রশংসা করে ভুয়া বিশেষজ্ঞের নামে নানা ধরনের বিশ্লেষণ প্রকাশ করা হতো। সে সময় ৬০টির বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসব লেখা প্রকাশ করা হয়। সেগুলো আবার আব্দুল মোমেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দেশে প্রচারণায় ব্যবহার করা হতে। এসব লেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হতো বড় অঙ্কের সম্মানী। আসলে পুরো প্রক্রিয়া ছিল একটি জালিয়াতি। এ রকম ৩৫ জন ভুয়া বিশেষজ্ঞের নামে আওয়ামী লীগের প্রশংসা করে এসব লেখা পাঠানো হতো বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এসব লেখকের মধ্যে একজনের নাম ছিল ডরিন চৌধুরী। লেখার সঙ্গে ডরিন চৌধুরীর যে ছবি প্রকাশ করা হয়, তাও ছিল ভুয়া। ওই ছবি ভারতীয় একজন অভিনেতার। ডরিন চৌধুরী পরিচয়ে লেখা হয়, তিনি নেদারল্যান্ডসের গ্রোনিনজেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। কিন্তু এএফপির অনুসন্ধানে ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানায়, এই নামে তাদের কোনো নিবন্ধিত শিক্ষার্থী নেই।
ব্যাংকক পোস্ট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের একটি ব্লগ পোস্টে বাংলাদেশ নিয়ে নিবন্ধ লেখেন ফুমিকা ইয়ামাদা। তার পরিচয়ে বলা হয়, তিনি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ স্টাডিজের একজন বিশেষজ্ঞ। এএফপির অনুসন্ধানে জানা যায়, এই নামে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে নথিভুক্ত কেউ নেই। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক প্রচারণার ধরন দেখলে বোঝা যায়, আওয়ামী লীগের প্রোপাগান্ডা চক্রের সঙ্গে ভারতের গণমাধ্যমের সংযোগ ঘটেছে। তারা এখন যৌথভাবে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় মেতে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে কলকাতা থেকে বাংলাভাষী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো আওয়ামী ফেইক নিউজের প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করছে।
এসব ভুয়া খবরের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকার ও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলাদেশের অনেক গণমাধ্যম কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া ভারতীয় এসব ভুয়া খবর প্রচার করে থাকে। বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর উচিত হবে ফ্যাক্ট চেকের মাধ্যমে ভারতীয় গণমাধ্যমের এই নোংরা দিক তুলে ধরা। এর মাধ্যমে ভারতের মানুষ বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বুঝতে পারবে সে দেশের গণমাধ্যম সংবাদের নামে কী ধরনের অবিশ্বাস্য কল্পকাহিনি প্রচার করে চলছে।