জাইকার অসম্পন্ন সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০১৪ সালের অক্টোবরে শুরু হয়েছিল ‘হাওর এলাকার বন্যা ব্যবস্থাপনার ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন’ প্রকল্প। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটি নিয়ে ২০১৭ সালে সমীক্ষা চালায় ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম)। তাদের দেওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী এর সব কিছু পরিবর্তন করে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে নতুন সংশোধনীতে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ফলে প্রথমদিকের সব অর্জনই কার্যত জলে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শেষ হওয়া ওই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৭৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে জাইকা ৫৯৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ও সরকার ৩৮৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।
আইডব্লিউএমের সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগাম বন্যায় ১০ বছর রিটার্ন পিরিয়ড মাত্রার বন্যা সমতল বিবেচনা করে প্রকল্পের পরিকল্পনা ও ডিজাইন করা হয়। অথচ বন্যা সমতলের ডিজাইন মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হলে সেটা হবে চরম বিপদগ্রস্ত। অর্থাৎ ১০ বছরে গড়ে বন্যার পানি যে উচ্চতায় উঠেছে তার চেয়ে বেশি হলে পুরো হাওর ও আশপাশে তা ছড়িয়ে পড়বে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এই একই কারণে বাঁধ ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা থাকা সত্ত্বেও ২০১০ ও ২০১৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সম্মুখীন হতে হয় হাওরবাসীকে। এ ছাড়া আলাদা আলাদা প্যাকেজ করে বেশিরভাগ ঠিকাদারকে সক্ষমতার বেশি কাজ দেওয়া হয় বলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন (আইএমইডি) বিভাগের এক প্রতিবেদনেও তা উঠে আসে। যদিও আর্থিক স্বল্পতার কারণে আটটি হাওরকে প্রকল্পের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
বাপাউবো মহাপরিচালক ইঞ্জিনিয়ার এএম আমিনুল হক অবশ্য বলেন, ‘মেঘনা নদীর উজানে প্রায় ২৯টি এলাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এর কাজ শেষ হলে পুরো সামগ্রিক এলাকায় একসঙ্গে বন্যা প্রতিরোধ হবে। আগামী বছরগুলোর হিসাব করেই নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থাপনা রাখা হয়েছে। আর কজওয়ে (বিশালাকার বাঁধ) নির্মাণের ফলে বন্যার পানি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
কজওয়ে নিয়েও আপত্তি তোলা হয়েছে আইডব্লিউএমের প্রতিবেদনে। সেখানে বলা হয়েছে, পানি ব্যবস্থাপনার জন্য নির্মিত কজওয়ের ওপর দিয়ে জনগণের একপাড় থেকে অন্যপাড়ে যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। এমনকি সেটি পরিচালনা ও পাহারার জন্যও নেই যথেষ্ট লোকবল। ফলে বন্যার আগ মুহূর্তে কজওয়েগুলো যথাসময়ে বন্ধ করা নিয়ে সংশয় দেখা যায়। এ ছাড়া পাহারা না দিলে আগাম বন্যার কারণে হাওরের বাইরের জনগণ সেগুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ায় দুপাশই প্লাবিত হয়। আর বর্ষার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংরক্ষণের কোনো পদ্ধতি না থাকায় ভবিষ্যতে প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ব্যাহত হতে পারে। সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহের হাওরগুলোর অনেক স্থানেই রয়েছে পাউবোর ‘ডুবন্ত বাঁধ’। কিন্তু দুর্বল পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় আগাম বন্যা পিছু ছাড়েনি ওই এলাকার।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আলাদা আলাদা প্যাকেজে ঠিকাদারদের চুক্তিতে হাইড্রোলিক স্ট্রাকচার অন্তর্ভুক্তি হয়েছে। অথচ অনেক ঠিকারদারই এটি বাস্তবায়নে সক্ষম নয়। এদিকে ২২টি হাওরে বন্যার ঝুঁকি থাকলেও আর্থিক স্বল্পতার কারণে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি আটটিকে। ফলে প্রকল্প বাস্তবায়ন শেষেও ওই আটটি হাওরাঞ্চলে বন্যা ঝুঁকি থেকে যায়। তবে প্রকল্পের ভৌত কাজের বিভিন্ন ডিজাইন ভালো হওয়ায় অবকাঠামো টেকসই হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আগাম বন্যা প্রতিরোধে বোরো ধান রক্ষা পাবে। এতে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি রবিশস্য ও শাকসবজি চাষ করাও সম্ভব ওই অঞ্চলে। প্রকল্পের মোট এলাকা ১ লাখ ৮৫ হাজার ৪৭৫ হেক্টর। এর মধ্যে আবাদি এলাকা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯২ হেক্টর। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে প্রায় ৮ লাখ ৭৮ হাজার ২৫০ টনের অধিক বোরো ধান উৎপাদন হবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।