।। দিলীপ কুমার বসু ।।
‘নীলফুল গালে নিয়ে ভেজা চোখে সাঁৎরায় আলো/সকালে ঘাসের বুকে’ ইত্যাদি হাবিজাবির সঙ্গে আরও কিছু যোগ করে একটা প্রায় প্রণয়-পদ্যের যোগাড় ক’রে ফেলে এক তরুণ কিশোর। ব্যাপারটা কিন্তু কিছু না তেমন, আসল ঘটনা হ’ল যেকালে দিল্লীতে মশা বা অন্য উপদ্রব না থাকায়, হাত-পা ছড়াবার জায়গা অনেক বেশি থাকায়, সারারাত তারার নিচে মাঠের উপর চারপাই পেতে ঘুমিয়ে সে সকালে ঘুম ভাঙতে দেখেছে অনেক দিনই ঘাসের উপর নাম না জানা কিছু নীলচে আর অনেক হলদে রঙের ছোটো ছোটো ফুল এদিক-ওদিক ফুটে আছে, তাকে পদ্যে সাজিয়ে সে রূপ-কর্মী হতে চেয়েছে। এখন, এমন উদ্ভট মানুষের যখন বয়স বাড়ে, নানা চিন্তা-উসকানো প্রবন্ধ অসংযত, অনিয়ন্ত্রিত রাস্তায়, সেমিনারে উপস্থিত হবার আগ্রহে নয়, এমনিই, খেয়ালখুশিতে পড়ে ফেলে, সে হাজির করবেই আপনাদের কাছে নানা মেঘের গল্প। তার একটা শুনুন আজ:
অনেকেই খেয়াল করেছেন জীবনানন্দের সঙ্গে বিভূতিভূষণের কিছু মিল আছে। যেমন, দু’জনেই প্রকৃতির সঙ্গে একটা বড়ো ঘনিষ্ঠতা অনুভব করতেন মানুষের বাইরে নানা প্রাণী, উদ্ভিদ যার অন্তর্গত, তাদের সঙ্গে, ভালবেসে তাদের চিনে, অন্তরঙ্গ হতেন বারবার। একটা মজার উদাহরণ দি’, খুব বেশি চেনা কথার বাইরের উদাহরণ। ‘সুদর্শন’ এমন এক প্রাণী, এমন এক পতঙ্গ, যার উল্লেখ বাংলাসাহিত্যে, আমার জানামতে অন্তত, এই দু’জনই শুধু করেছেন। পথের পাঁচালির অষ্টাদশ পরিচ্ছেদের শেষে দুর্গার মুখে এর উল্লেখ পাবেন, আর আমাদের কাছে রূপসী বাংলা বলে যে কবিতা সঙ্কলন বর্তমান, তার দু’টি কবিতায়। ‘সুদর্শন’ এর অর্থ না জানা থাকায় সন্ধ্যার বাতাসে যার মঙ্গলময় ভাসাভাসি, যাকে দেখলে মানুষের হাত জোড় করে বলার কথা আমার পরিজনদের, প্রিয়জনদের সুভালাভালি রেখ, সেই ‘সুদর্শন’-সম্বলিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদে নানা অনুবাদকের হাতে কী চেহারা (নানারকম) দাঁড়িয়েছে তা দেখলে মন খারাপ আমাদের হতেই পারে।
কিন্তু, অন্য এক জিনিস নিয়ে আমাদের আজকের ক্ষ্যাপামি। আলোচ্য দু’টি মানুষই, মনে হয়, কোনপ্রকার স্লোগান না দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে চিনেই সাম্রাজ্যবাদীদের ভুবনকে, সেই ভুগোলের মাটিকে তাঁদের চেতনায় আনেননি। চাঁদের পাহাড়-এর আলভারেজ পর্তুগীজ, কিন্তু সে যেমন ক্ষ্যাপা, সেখানে সে সাম্রাজ্যবিস্তারের অভিপ্রায়ের জগতের বাসিন্দা নয়, পাড়ায় পাড়ায় ঘোরার আনন্দের জগতে পথিক। এই কথাগুলো যাঁরা পড়ছেন, খেয়াল করুন বিভূতিভূষণের জগতের মানচিত্র। তার সবচেয়ে পশ্চিমে আছে মধ্য-পূর্ব আফ্রিকা। কেনিয়া, উগান্ডা, ইত্যাদি। তারপর পূর্বের নানা সময়, সভ্যতা (‘স্বপ্নবাসুদেব’ গল্প মনে পড়ছে কি?) পেরিয়ে ভারতের নানা অংশে গল্প-উপন্যাসের ভ্রমণশেষে অপরাজিতর অপু যাবে ম্যানিলায়, ফিলিপাইনসে, মাঝে চীন-সমুদ্র, চীন আছে মরণের ডঙ্কা বাজে তে, যা এমন একটি বই যাতে পশ্চিমী সাম্রাজ্যবাদ প্রচারিত বিভীষিকাময় চীনা মানুষ ও চীনা ব্যবহারের কোনো স্পর্শ নেই, যা আমাদের সেকালের শিশুসাহিত্যে উপস্থাপিত লেখকদের অবোধ লেখনীতে অবোধ্য কারণে।
তাহলে, কেনিয়া-উগান্ডা থেকে ম্যানিলা অবধি প্রসারিত এই জগৎ। এবার জীবনানন্দে যাই। এখানেও কি আমাদের এই দুই লেখকের মিল দেখা যায়? আমরা ‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটা একটু পড়ে দেখি।
“আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে
আমার জানালার ভিতর দিয়ে শাঁই শাঁই করে,
সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো!
হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে,
দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে,
মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে,
জীবনের দুর্দান্ত নীলমত্ততায়!” (বাঁকা হরফ আমার করা)
আলো আর অন্ধকার দু’পিঠ, দুই-ই দুর্দান্ত, বলীয়ান, দিগন্ত প্লাবিত করে দেয়া বিরাট গভীর, সজীব উচ্ছ্বাস। উচ্ছ্বাসের, এই গভীর উত্তুঙ্গ হাওয়ার রাতের ব্যাপ্তি আছে সময়ে, যেখানে আছে অনন্ত মানবেতিহাসের যাত্রায় পুরোনো বেবিলন, এশিয়া, মিশর, বিদিশা প্রবাহিত কালবোধ, আর স্থানের ব্যাপ্তি সেখানে চারণস্থান রৌদ্রালোকিত তৃণভূমি উগান্ডা-কেনিয়া একদিকে, অন্যপ্রান্তে অন্ধকারের বাঘিনীর বিচরণভূমি। এই বাঘিনী কোথাকার? আমি এবং যারা পড়ছেন, বাঙালি, সহজেই মনে করব ‘সুন্দরবন’। সংগত ভাবনা। যদি সুন্দরবন না হয়, আর সে কোথায় হবে? হয়ত বা বার্মা, বার্মা পেরিয়ে মালয়েশিয়া?
এর বাইরে জীবনানন্দ দেখতে পাবেন, সাতটি তারার তিমির-এ, “রক্তিম গির্জার মুন্ড”, ফিলিপাইন্সেই আবার।
হুবহু একই ভূখন্ড। এই মিল কি কাকতালীয় এই দুই বাঙালি রচনাকারের? না, আরেক রকম মিল, যা ঔপনিবেশিক মননকে সহজে অগ্রাহ্য করা এক জীবনবোধের নির্বাচন?
২.
এইবারে, এতসব ভূমিকার পরে, আসলে যে কথা বলতে চাই সেটিতে আসি। মনে হচ্ছে ভূমিকাটা দরকার ছিল, এই ধান ভানতে বসে। জীবনানন্দ সম্পর্কে আলোচনায়, এবং নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা-বিদ্যাচর্চায় আমরা ‘প্রভাব’ বস্তুটার খুব আলোচনা করি, পরীক্ষায় এ নিয়ে বিবিধ প্রশ্ন (কখনো বা গোটা ‘পেপার’) দেখতে পাই। উত্তর দেবেন যে পরীক্ষার্থীরা, শ্রেণীকক্ষে তাঁদের প্রস্তুতও করেন মাস্টারমশাই। এ তাত্ত্বিক আলোচনা এখানে উঠবে না যে সেটা কতদূর প্রয়োজন, বা সংগত, বছরের ক্লাসগুলির সীমিতসময়ে শ্রেণীকক্ষে এ বস্তুর আলোচনা বিদ্যাচর্চায় অনিবার্য কিনা। আমরা জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ নিয়ে দু-এক কথা ওঠাব শুধু।
কবি সম্পর্কে আলোচনায় উৎসাহী পাঠকেরা জানেন, ঐ কবিতার উপর কীটসের ‘On First Looking into Chapman’s Home’ কবিতার প্রভাব বিখ্যাত আলোচকরা লক্ষ্য করেছেন। প্রধান কারণ, দুই কবিতায়ই এক নাবিকের অভিজ্ঞতা বর্ণিত, এবং দুইজনেরই দীর্ঘ যাত্রাশেষে সহসা অপূর্ব কিছু খুঁজে পাওয়ার কথা রয়েছে।-স্পেনীয় সাম্রাজ্যবিস্তার অভিযানের নায়ক করতোস–এর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা আবিস্কারের মুগ্ধতাকে (ঘটনার পরবর্তী ইতিহাসের ব্যাখ্যা অপ্রয়োজনীয়, কারণ, আপনাদের জ্ঞাত, নয়তো সহজেই তা অনুমেয়) কীটসের সময়ে দাঁড়িয়ে তরুণ কবির মনে হয়েছিল হোমারের চ্যাপম্যানকৃত ইংরেজি অনুবাদ আবিষ্কার ও পাঠের অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করাই যেতে পারে।ব্যক্তিগতভাবে কীটসের বহু বহু কবিতায় আমার অচলা ভক্তি; এ-ও তবু সত্য যে ইংরেজ কবিদের ঐ সময়ে বিভিন্ন উপনিবেশে ইউরোপীয় দেশগুলির সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপ সম্পর্কে খুব একটা ধারণা ছিল না।
“My flag is not Unfurled on admiral stuff, and to philosophies I days not yet”
– এ কবি তার জীবনের অনভিজ্ঞতার কথা যথার্থ বলেছেন একটা প্রমাণ তার ঐ পংক্তিগুলিতেই থেকে গেছে। যে জাহাজের কল্পনা ওখানে কাব্যদেহ নির্মাণ করছে, সেটির উদ্দেশ্য কী তা আজকের দিনে আমাদের কাছে স্পষ্ট, সেদিনের ইংরেজ কবির কাছে নয়।
ঐ যে ‘দারিয়েন’ যোজক দেখা, আটলান্টিক আর বিপুল প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যের ঐ পানামা খাঁড়ির দিকে বিস্মিত নয়নপাত, যে ছবিটি রৌদ্রস্নাত নীলও বটে, তার সঙ্গে মিল খোঁজা হয়েছে, তার প্রভাব খোঁজা হয়েছে বাঙালি কবির যে আবিষ্কারের সঙ্গে, সেটি এখন দেখি:
“সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি […] ধূসর জগতে
[…] আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে,
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,”
[…]
“[…] অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে”
সেই মানুষটি। বনলতা সেন। তার অনুষঙ্গে আসে, তার রূপবর্ণনায়, ‘বিদিশার দিশা’ ‘শ্রাবস্তী কারুকার্য’। প্রাচীন ইতিহাস। রাত্রি আসে সেখানে, এর পরে, বারংবার। চিল তার ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে। সার্বিক অন্ধকারের আবহে জোনাকির আলোয় এক গল্পের পান্ডুলিপি রচিত হয়, যেখানে মুখোমুখি ব’সে বনলতা –রচয়িত্র? চরিত্রী দুই-ই?
উপানিবেশের নির্জিত মানুষ, সেই ভূখন্ডের, যে এলাকার পরিচয় এক সময়ে দেয়া হত ‘তৃতীয় বিশ্ব’ ব’লে, যে ভূখন্ডের অন্য আর এক অংশ কোর্তেসরা জিতে নেবেন সাম্রাজ্যবিস্তারের অভীসম্পায় সেই বিশ্বের একজন, ক্লান্ত আশ্রয় আর মান্তি খুঁজছে, এমন এক মানুষ তা খুঁজে পাচ্ছে বনলতার মধ্যে দু’দন্ডের জন্য। নতুন জমি অধিকারের, প্রাপ্তির যে আনন্দ উত্তেজনা কোর্তেসের জগতে, ইউরোপীয় জগতে ইংরেজ কবির লেখায় বর্ণিত, এর উল্টোটা এ-জিনিস।
কীটসের সঙ্গে জীবনানন্দের মিলের জায়গাটা আলো আর অন্ধকার, যন্ত্রণা আর আনন্দের বিন্যাসের উপস্থাপনায় কিন্তু সেকথা অন্য, সে কবিতা বিচার ‘মৃত্যুর আগে’ আর `Ode to a Nightingale’ পাশাপাশি রাখলে হয়ত সহজে প্রত্যক্ষ করা যায়। মিল এদের আছে। কিন্তু এখানে নেই, এভাবে নেই যেমনভাবে এই ‘প্রভাব আলোচনায় আছে। অথচ, মননে কোন স্বরাজের অভাবে জানি না, কোন নতমস্তক মনোভাবের কারণে জানি না, আমরা কিছুতেই এ প্রশ্নটা করি না যে ‘নাটোরের বনলতা সেন’ কে কেন তুলনা করা হয় ‘দারুচিনি দ্বীপের ভিতর’ ‘সবুজ ঘাসের দেশ’ এর সঙ্গে। কেন ভারতীয় উপমহাদেশের আবহে নির্মিত নায়িকার ঐ ভূগোলেই চলমান প্রেমিকের সঙ্গে মিলন ঘটে যায় হঠাৎ দারুচিনি দ্বীপ ইন্দোনেশিয়ায়। বাংলাদেশের নাটোর কীভাবে দারুচিনি দ্বীপের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়, কোন মিলনমন্ত্রে।
অথচ, এটি কবিতা থেকে উঠে আসা অতিসঙ্গত একটি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন। আর, এর উত্তরেই হয়ত জানা যেতে পারে উপনিবেশিত মানুষের সাধারন বিষাদ ও ঐক্যের জোনাকির আলোয় পড়া, ঐ আলোয় গড়া এক পান্ডুলিপি। তার পর ভোরের আলো, ঘাসফুল, ইত্যাদি। জীবনানন্দ বারবার বলেছিলেন কবিতার মর্মে থাকতে হবে ইতিহাসচেতনা।