|| লীনা দিলরুবা ||
মহামারি নিয়ে এডগার অ্যালান পো ১৮৪২ সালে গ্রাহাম ম্যাগাজিনে একটি গল্প লেখেন, গল্পটির নাম দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ। সমালোচকদের মতে এ গল্পটি পৃথিবীর প্রথম গথিক উপন্যাস হোরাস ওয়ালপোলের দ্য ক্যাসেল অব অট্রান্টোর প্রভাবে লেখা।
মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো পঠন-পাঠনের ব্যাপ্তি, দার্শনিক চিন্তার দিক দিয়ে বিশ্বসাহিত্যে নিজের জন্য একটি গৌরবমন্ডিত স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। এই স্বীকৃতি তাঁকে দিয়েছে কাল এবং সমগ্র বিশ্ব।
এডগার অ্যালান পো’র জন্ম (১৮০৯) আমেরিকার বোস্টন শহরের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে। অল্প বয়স থেকে পো’র স্বাধীন চিন্তাশক্তি বিকশিত হয়। কাছাকাছি সময়ে বাবা-মা দুজনই মারা যাবার কারণে ভার্জিনিয়ার রিচমন্ডে জন আ্যালান-এর পরিবারে আশ্রিত ছিলেন তিনি । ছোটবেলা থেকে অনেকটা নিঃসঙ্গতার মধ্যে বেড়ে ওঠেন পো। তখনই তাঁর মধ্যে এক অন্তর্লীন জটিল মনস্তত্ত্ব দানা বেঁধে ওঠে। চারদিকের অবক্ষয়, মনোবিকলন, আর্থিক দৈন্যদশার নিবিড় যোগ তাঁকে এতটাই বিমূঢ় করে রেখেছিল তিনি যেন ছিলেন অনেকটা নিস্পৃহ। কিন্তু এই মনোবিকলনই স্পর্শকাতরতা বাড়ায়। মানুষের আত্মিক যন্ত্রণার গভীরে প্রবেশ করার সক্ষমতা তৈরি হয়।
বিপুল প্রতিভাধর এই মার্কিন কবি, ছোট গল্পকার, সম্পাদক, সমালোচকের প্রথম সাহিত্য প্রকাশ কবিতার মাধ্যমে। ১৮২৭ সালে তাঁর প্রথম কবিতার বই টেমারলেন অ্যান্ড আদার পোয়েমস প্রকাশিত হয়। তবে ততদিনে তিনি নানান ধরনের ভাষা শিখতে থাকেন। কবিতায় তিনি বিশ্বসাহিত্যে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত কবিতা হেলেন, দ্য র্যাভেন ।
ক্রমে তিনি ছোটগল্পে মনোনিবেশ করেন। পো’র অনেকগুলো গল্প অন্তর্ভেদি, মনস্তাত্ত্বিক, রহস্যময়, মৃত্যুর গন্ধমাখা, এবং আতঙ্কতাড়িত।
দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ গল্পের পটভূমিকা একটি রাজ্য। যুবরাজ প্রসপ্যারো সে রাজ্যের অধিপতি। হঠাৎ করে সেখানে এক অদ্ভুত ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়ে। “তীব্র ব্যাথা, তারপর মাথা ঘোরা, তারপর রন্ধ্রপথে প্রচুর রক্তপাত, তারপর বিলুপ্তি। ভিক্টিমের শরীরে বিশেষ করে মুখমণ্ডলে রক্তলাল ক্ষতচিহ্নগুলো আসলে কীটের অভিশাপ যা তাকে মানুষের সবরকম সাহায্য আর সহানুভূতি পাওয়ার পথ রুদ্ধ করে দেয়।” – এভাবেই ছোটগল্পটিতে ভয়াবহ এই রোগকে বর্ণনা করেছেন পো।
কোনোরকম আগাম নোটিস না দিয়েই মানুষ মরছে। সমস্ত জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে রোগ। প্রসপ্যারো সর্বসাধারণের নেতা, কিন্তু ভাবলেন নিজের কথাই। হয়ে উঠছিলেন সুখী। ভয়হীন এবং চালাক। যখন তাঁর রাজ্যের অর্ধেক লোক মারা গেল তখন তিনি তার পারিষদ, তাদের পরিবার সহ একহাজার লোককে নিয়ে এক দুর্গে আশ্রয় নিলেন। সেখানে আমোদ-প্রমোদের কোনো কমতি রাখলেন না। নাচ-গান-পানীয়, কোনোকিছুর অভাব নেই। দুর্গটিকে বাইরে থেকে এমনভাবে আবদ্ধ করলেন, যেন কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে। কেউ আসবে না মানে, রোগও আসবে না। তারা নিশ্চিন্তে ভেতরে আত্মগোপন করে থাকতে পারবেন।
এভাবেই চলছিল সব। পাঁচ-ছয় মাস পরে, বাইরে মহামারি তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, প্রসপ্যারো দুর্গের ভেতরে আমোদে আর উৎসবে সময় পার করছেন। এর মধ্যেই আয়োজন করলেন মুখে মুখোশ লাগিয়ে একটি নাচের অনুষ্ঠানের।
তিনি দুর্গে যে উদ্ভট পরিমণ্ডল সৃষ্টি করেছিলেন, সেখানে ছিল সাতটি ঘর। সবগুলো ঘরের দরজা খুলে দিলে এক ঘর থেকে অন্য ঘর দেখা যায়। বাঁক ঘুরে ঘুরে সেখানে যেতে হয়। জানালাগুলো রঙিন আর গথিক আকারের। এক-একটি জানালা এক-এক রঙের, ঘর আর আসবাবপত্রের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে রঙ করা। যেমন পুবদিকের শেষ ঘরটি নীল। জানালাগুলো নীল, কাঁচও নীল। তার পাশের ঘর ধোঁয়াটে। ঘরের সবকিছু সেই রঙের । তিন নম্বরটি সবুজ। চতুর্থটি কমলা। পঞ্চমটি শাদা। ষষ্ঠটি বেগুনি। সপ্তমটি কালো। কিন্তু এখানে ব্যতিক্রম যে, এই ঘরের আসবাবপত্র ঘরের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে কালো নয়, বরং লাল। এই ঘরটিতে এমন এক ভুতুড়ে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে, কেউ ভয়েও এখানে প্রবেশ করছে না। ঘরের দেয়ালে রয়েছে দেয়াল ঘড়ি। মিনিটের কাঁটা ঘুরে ঘণ্টায় দাঁড়ালে এক মর্মস্পর্শী বাজনা বেজে ওঠে। সাহসী মানুষরাও সেই বাজনার সুরে বিহ্বল হয়ে যায়। এখানেই শুধু এমন স্তদ্ধতা। নইলে বাইরের মহামারির সামান্যতম বিষয়ও এই দুর্গের কেউ টের পায় না। চারদিকে শুধু আনন্দ, আর উৎসব। নারী পুরুষের যুগল নৃত্য, মোহনীয় এক পরিবেশ।
এরমধ্যেই ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে পৌঁছলে এক আগন্তুককে দেখে সবাই কেমন এক অনুভূতিতে থমকে যায়। যেন এক নীরন্ধ্র অন্ধকার! নিশ্ছিদ্র প্রকোষ্ঠে এই আগন্তুক কোথা থেকে এল! তার মুখেও মুখোশ। কিন্তু অন্যরকম। কেমন এক ভুতুড়ে মুখোশ পরে লোকটা হেঁটে বেড়াচ্ছে। কেউ কাছে ঘেঁষতে চাইছে না তার। প্রসপ্যারো রেগে গেলেন, কে এই লোক ! এখানে কীভাবে এল ! তিনি নির্দেশ দিলেন আগন্তুককে পাকড়াও করতে। তাকে যেন শুঁলে চড়ানো হয়। কিন্তু কেউই তাকে ধরতে পারল না। কাছেও গেল না। প্রসপ্যারোর ঝলসে ওঠা তীক্ষ্ম তরবারি আঘাত করতে যায় তাকে। কিন্তু সেই অকপট স্পর্শ জায়গামত পৌঁছয় না। ফল হয় উল্টো। আগন্তুকই প্রসপ্যারোর জীবন নাশ করে।
দুর্বোধ্য চমকের মতোই যেন প্রসপ্যারোর মৃত্যু ঘটে। সভাসদ বিমূঢ় হয়ে পড়ল। তারা এবার সাহস করে আগন্তুকের মুখোশ খুলে ফেলে। কিন্তু এ কে! এখানে তো কোনো মুখ নেই! কেবল মড়ার মতো কুঁকড়ে যাওয়া এক অবয়ব!
যুবরাজ পরাজিত হল।
এবার হল আরেক দৃশ্য! আগন্তুককে স্পর্শ করা মাত্র একে একে সবাই লুটে পড়ল মাটিতে। রক্তাক্ত মুখে মরে যেতে লাগল রোমান্টিক, প্রেমময়, কামনায় উদ্দীপ্ত থাকা মানুষগুলো।
এই জনপদে এরপর আর কোনো মানুষ থাকল না। মহামারির কাছে আত্মসমর্পন করল সবাই।
গল্প শেষ হয়।
দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ গল্পে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতার সৌধ বানিয়ে মানুষকে অবজ্ঞা করার প্রয়াস পায়। কিন্তু প্রকৃতি তাদের বেশিদিন এই মোহগ্রস্ততার মধ্যে রাখে না। কারণ, ফ্যান্টাসির ওপর কোনো কিছু টিকতে পারে না। ফ্যান্টাসি একসময় ভেঙে পড়ে। এই গল্পের বেদনাদায়ক পরিণতি এখানেই যে, যুবরাজের মৃত্যুকে কোনোভাবেই তার শক্ত দুর্গ ঠেকাতে পারে নি।
পো-র ছোটগল্পটি যদিও পুরোপুরিই কাল্পনিক, কিন্তু এর কাব্যময় প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রগাঢ়। উপস্থাপনভঙ্গি, গঠন-কাঠামোর ক্ষেত্রে গল্পটি তীব্র এবং উজ্জ্বল। সমালোচকদের মতে, বাস্তবের রোগব্যাধি থেকে অনুপ্রাণিত এই মার্কিন কবি নির্ভর করেছেন বাইবেলের প্রতীকীবাদে। গল্পের অন্যতম আকর্ষণ এর আবহে। এখানে রয়েছে সাধারণ সহজ-সরল জীবনের বিপরীতে দুর্বোধ্য, জটিল, রহস্যময় পরিবেশ সম্পর্কিত এক ভয়াল অনুভূতি।
দ্য মাস্ক অব দ্য রেড ডেথ– রূপক প্রতীক হিশেবেও বহুমাত্রিক। মানবতার বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষী মনোভাব প্রসপ্যারোকে অচঞ্চল করে তুলেছিল। সমালোচকদের মতে, প্রতীকীবাদকে বিশ্লেষণ করলে প্রসপ্যারো হচ্ছেন সামন্তবাদের শেষ প্রতিভূ। যুবরাজ কেবল ধনী নাইট আর অভিজাত শ্রেণির নারীদের তার দুর্গে আমন্ত্রণ জানান, চাষী আর আমজনতার ঠাঁই হয় না সেখানে – এভাবেই সৃষ্টি হয় একটি আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের। যুগে যুগে ধনী-গরিবের এই বৈষম্য কেবল বেড়েছেই। কিন্তু মৃত্যুকে ঠেকানোর জন্য মানবজাতির প্রচেষ্টার প্রতীক দুর্গটি ধনীদের কোনো উপকারে আসেনি । ঘৃণ্য ক্লেদাক্ত পথে হেঁটে জনতার ওপর স্টিমরোলার চালিয়ে অবদমনের চেষ্টায় কেউ জয়ী হয়নি। প্রসপ্যারোও নয়।
এর সাতটি কক্ষ জীবনের সাতটি পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করে, একইসঙ্গে সাতটি ভয়ঙ্কর পাপে প্রসপ্যারোর গা ভাসিয়ে দেয়াকেও ব্যাখ্যা করা যায় এর মাধ্যমে। শেষাংশে মুখোশপরা আগন্তুকটি মৃত্যুর অনিবার্যতারই বহিঃপ্রকাশ, যুবরাজের জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যেই তার আগমন ঘটে, যেখানে আরেক কবি জেমস শার্লি-র ‘ডেথ দ্য লেভেলার’ কবিতার স্তবকগুলোর সত্যতা প্রতিপাদিত হয়: ‘নিয়তির হাত থেকে বাঁচার জন্য কোনো বর্ম নেই; রাজার শরীরও পায় মৃত্যুর শীতল স্পর্শ।’
আর এই মুখোশ পরা নৃত্যও তাৎপর্যবাহী। পো যেন বলতে চাইছেন, মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থেকে অনিকেত বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। মানুষের মুক্তি আসবে কোন পথে? মুখোশ পরা পথে নয়।
অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর সামনে জীবন যে অর্থহীন, বর্তমান পৃথিবীর নৈরাশ্যবাদী, অভিশপ্ত সময়ে আমরা তা প্রত্যক্ষ করছি। কয়েদীদের মতো ঘরের ভেতর ফাঁদে পড়ে আছি সবাই। পৃথিবীর নিঃসঙ্গ মানুষগুলো নানাভাবে মুক্তির উপায় খুঁজে মরছে। এ-সময়ের প্রেক্ষাপটে পো’র এই গল্প তাই গভীর তাৎপর্য বহন করে। বস্তুত তিনি মানবাচরণ সম্বন্ধে এমন এক বাস্তববাদী মনোভাব গ্রহণ করেছেন যা আজকের অনেক ঘটনাপ্রবাহ ও জনপ্রতিক্রিয়ার সঙ্গে মিলে যায়।
পরাবাস্তববাদী এই গল্প গতানুগতিক গল্পের বেড়াকে ডিঙিয়ে আমাদের দৃষ্টিকে বহুদূরে নিয়ে যায়। যারা লোভ বা আত্ম-অহংকারের বশবর্তী হয়ে কাজ করেন, ইতিহাস কখনো কখনো তাদের মরণশীলতা আর শালীনতার পরীক্ষা নেয়। ধ্রুপদী সাহিত্য এবং পো-র ছোটগল্প থেকে জীবনের অনেক শিক্ষাই নেয়া যায় যা আজকের এই জরুরি আর অনিশ্চিত অবস্থায় সতর্কবাণীর কাজ করবে।