আরাকান নিউজ ডেস্ক: আবারও বাংলাদেশে এসে প্রত্যাবাসনের জন্য তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে গেছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হচ্ছে তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। আর বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বলেছেন, একেক সময় একেক রকম কথা বলায় তারা মিয়ানমারকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) সন্ধ্যায় টেকনাফের একটি সরকারি রেস্ট হাউজে ১৬০ রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করে মিয়ানমারের ৩৬ সদস্যের প্রতিনিধি দল। এ দিন সকালে টেকনাফের বাংলাদেশ-মিয়ানমার ট্রানজিট জেটি দিয়ে কাঠের ট্রলারে করে বাংলাদেশ আসেন তারা। ট্রলারে ১১ জন মাঝিমাল্লা ছিলেন- যারা সবাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক।
দলটির নেতৃত্ব দেন রাখাইন প্রাদেশিক সরকারের ইমিগ্রেশন ডিরেক্টর স নাইং। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নেতৃত্ব দেন মিয়ানমার অনুবিভাগের মহাপরিচালক মিয়া মো. মাইনুল কবির। এ সময় শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত আরআরআরসি সামছু দৌজাসহ এপিবিএন পুলিশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক শেষে মাইনুল কবির বলেন, ‘প্রত্যাবাসন একটা প্রক্রিয়া। মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের চুক্তি অনুযায়ী এই আলোচনা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ। বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি যেন রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফেরত যেতে পারে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আজকে আরও কিছু বিষয় আলোচনা করেছে। এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। কালও আবার আসবেন এই প্রতিনিধি দল। কবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হচ্ছে তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে।’
রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টেকনাফের শালবাগান ক্যাম্পের রাফিয়া বেগম। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের প্রতিনিধিরা আমাদের নিয়ে গিয়ে ক্যাম্পে রাখার কথা বলেছেন। আমাদের জন্য কী কী সুবিধা দেওয়া হবে সেই ভিডিও দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা সেভাবে ফিরতে চাই না।’
নিজ ভিটায় ফেরার আগ্রহ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, লেখাপড়া, চিকিৎসা, চলাচল ও নিরাপদ জীবনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিনিধি দল দেশে (মিয়ানমার) ফিরে তাদের দাবির বিষয়গুলো কর্তৃপক্ষকে জানাবে বলে আশ্বস্ত করেন।’
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বলেন, ‘মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দুই পক্ষের মধ্যে একটা অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট আছে বলেই এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। সে সংকট দূর করার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সব এজেন্সি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বারবার বসছে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে মিয়ানমারের ৩৬ জন সদস্য এসেছেন। সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার মিনিস্টার অফ রাখাইন স্টেটের এর নেতৃত্বে তারা এসেছেন। তারা ১০০টি রোহিঙ্গা পরিবারের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তারা রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে তাদের আয়োজন সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কী প্রক্রিয়ায় তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব পাওয়ার পথে এগিয়ে যাবে, ভোটাধিকার কীভাবে হবে এসব বলেছেন। রোহিঙ্গাদের কথা শুনেছেন।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের যে প্রচেষ্টা সেটি হচ্ছে প্রত্যাবাসনটা শুরু করার পর্যায়ে চলে যাওয়া। প্রত্যাবাসনটা যাতে টেকসই হয়, মর্যাদাপূর্ণ হয়- সেটা নিশ্চিত করা।’
বৈঠক শেষে টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘তারা আমাদের আবারও ক্যাম্পে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু আমরা ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে যাওয়ার জন্য কোনোভাবেই রাজি না। আমরা জাতীয়তা, নিরাপত্তা, বাপ-দাদার ভিটেমাটি পেলে যাওয়ার জন্য রাজি।’
একই ক্যাম্পের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘মিয়ানমার ৯৮টি গ্রাম থেকে লোক নিয়ে যাবে তিন হাজারের মতো। যদি ৯৮টি গ্রামের লোক যদি ২০টি গ্রামে পাঠায় তখন যার গ্রামে সে যাওয়ার সুযোগ হবে না। আমরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত, আমাদের দেশে আমাদের মৃত্যু হোক সেটাই চাই। কিন্তু, আমাদের গ্রামে আমাদের দিতে রাজি নন তারা। আমাদের গ্রাম ছাড়া আমরা যাবো না।’
এর আগে, ১৫ মার্চ ও ২৫ মে মিয়ানমার প্রতিনিধি দল দুই দফায় বাংলাদেশে আসে। সে সময় প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গার তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে মিয়ানমার ফিরে যায় দলটি। তবে রাখাইনে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ দেখতে ৫ মে বাংলাদেশ সরকার ও রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল রাখাইন সফর করে।
এদিকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ আট লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা মিয়ানমারের কাছে পাঠিয়েছিল। এরপর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে ৬৮,০০০ রোহিঙ্গার একটি ফিরতি তালিকা পাঠানো হয়। গত বছর জানুয়ারিতে ওই তালিকা থেকে পরিবারভিত্তিক প্রত্যাবাসনের জন্য প্রাথমিকভাবে ১১৪০ জনকে বাছাই করা হয় পাইলট প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এর মধ্যে ৭১১ জন রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার সম্মতি দিলেও বাকি ৪২৯ জনের বিষয়ে তাদের আপত্তি ছিল। সে সময় ৪২৯ জনের তথ্য যাচাই-বাছাই করতেই মিয়ানমারের ১৭ জন সদস্যের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছিল।