।। পিনাকী ভট্টাচার্য।।
আজকের বাস্তবতায় বাকশালের একটা নির্মোহ পর্যালোচনা প্রয়োজন। কারণ নামে না হোক বেনামে বর্তমানে শেখ হাসিনা বাকশালের দিকেই অগ্রসর হচ্ছেন। আমরা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের জন্য নানা বিষয়কে অভিযুক্ত করি, কিন্তু বাকশাল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল সম্ভাবনাকে অংকুরেই বিনষ্ট করেছিলো। কীভাবে করেছিলো তা আজকের নতুন প্রজন্মের পাঠকের সামনে তুলে ধরতে চাই।
বাকশালের সাথে সিপিবির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, আমি সিপিবি দিয়েই বাকশালের আলোচনা শুরু করতে চাই। তাহলে আমরা বুঝতে পারবো, কেন কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বামদলগুলো শেষ বিচারে আওয়ামী লীগের পাশেই দাড়ায়।
শেখ মুজিব সারা জীবন তিনি বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে, অবশেষে কেন একদলীয় ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসনের দিকে ঝুঁকেছিলেন, সেটার বস্তুনিষ্ঠ কারণ খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয় (?)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনও জানতেন না, তিনি কার সাথে পরামর্শ করে ‘বাকশাল’ গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। অনেকে বলেন, তাঁকে এই বুদ্ধি দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই অনুমান অসঙ্গত নয় যে সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টি তাদের স্থানীয় পার্টনার সিপিবির মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘস্থায়ী সংকটের জন্ম দিয়েছে।
বাকশাল ও সিপিবি
‘বাকশাল’ নিয়ে সিপিবির উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। বাকশাল গঠিত হবার পরে, সাংগঠনিকভাবে নগণ্য প্রতিনিধিত্ব সত্ত্বেও তারা ‘বাকশাল’ কর্মসূচি এগিয়ে নিতে অতিমাত্রায় আন্তরিক ও উৎসাহী ছিল। এমনকি বাকশালে যোগ দেয়ার জন্য তারা নিজেদের দলকে বিলুপ্ত করে দেয়।
‘শ্রমিক শ্রেণির দল’ দাবিদার কোনো দেশের ‘কমিউনিস্ট পার্টি’র অপর একটি বুর্জোয়া দলে রাতারাতি এবং স্বেচ্ছায় বিলীন হয়ে যাওয়ার এমন ঘটনা আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে বিরল। যদিও দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর প্রকাশিত এক দলিলে সিপিবি দাবি করেছে, বাকশালে যোগ দিলেও পার্টি ‘গোপনে তার সংকুচিত একটি কাঠামো’ বজায় রেখেছিল।৩ এতে প্রমাণিত হয়, ‘বাকশাল’-এর সাংগঠনিক কাঠামোর বিষয়ে সিপিবি’র অস্বস্তি ছিল।
বাকশাল গঠনের ক্ষেত্রে সিপিবির যে সক্রিয় ভূমিকা ছিল, সেই বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকেই স্বীকারোক্তি পাওয়া যায়। দল বিলুপ্ত করে বাকশালে যোগদানের বিষয়ে সিপিবি’র সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় ভোটাভুটিতে যোগদানের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পড়েছিল।
বাকশাল কর্মসূচি ঘোষণার কয়েকদিন পর ১৯৭৫-এর ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনাসভায় বিলুপ্ত সিপিবি ও সেই সময় বাকশালের নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ ‘বাকশাল’কে একটি ‘বিপ্লবী প্রক্রিয়া’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বাকশাল নিয়ে দৃশ্যমান আলাপ নিজের রাজনৈতিক সহকর্মীদের সঙ্গে না করলেও সিপিবি’র সঙ্গে ছয় মাস ধরে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৭৪-এর জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবের সঙ্গে সিপিবির কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং মুজিবের নেতৃত্বে (সিপিবির ভাষায়) সৎ ও সমাজতন্ত্রমনাদের নিয়ে যে একটি একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে সে বিষয়ে সিপিবি ওয়াকিবহাল ছিল এবং নিজেদের পার্টিকে তারা সেভাবেই প্রস্তুত করছিল।৭ ’৭৩-এর জানুয়ারিতে ঢাকায় এবং মার্চে গোপালগঞ্জে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের হাতে দলের কর্মী ও সংগঠকদের নির্মম হত্যাকান্ডের পরেও সিপিবি’র শর্তহীন ও লাগাতার সমর্থন শেখ মুজিবকে একদলীয় শাসনে উদ্বুদ্ধ করে থাকতে পারে।
অনেকে মনে করেন, সিপিবি এ সময় পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই-এর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিল। যে অভিজ্ঞতার মূল বিষয় ছিল, সোভিয়েতপন্থি হিসেবে টিকে থাকতে হলে বাম-মধ্য ঘরানার একটি বড় সংগঠনের আনুকূল্য প্রয়োজন। সিপিআই যেটা পেয়েছিল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের তরফ থেকে।
তবে সিপিবি ও সিপিআই উভয় সংগঠনই সেই সময়ের সোভিয়েত তাত্ত্বিক আর. উলিয়ানভ্স্কি ও ভ. পাভলভের এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক উত্তরণবিষয়ক তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাদের সেই তত্ত্ব অনুসারে, এশিয়া-অফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার সদ্যস্বাধীন দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় অপুঁজিতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্রে পৌঁছতে পারে। সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর এই বিশেষ প্রক্রিয়ায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের প্রয়োজন নেই। এশিয়া-আফ্রিকা-ল্যাটিন আমেরিকার সোভিয়েতপন্থি কমিউনিস্ট পার্টিগুলো ১৯৭১ পরবর্তী সময়ে এই তত্ত্ব অনুসরণ করে সদ্যস্বাধীন দেশগুলোতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালায় এবং তা যথারীতি ব্যর্থ হয়। এই তত্ত্বের আলোকে অ-ধনবাদী পথে সমাজতন্ত্রে পৌঁছাতে করণীয়গুলো হলো: মিশ্র অর্থনীতি থেকে ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় খাতকে একচেটিয়া করে তোলা; সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিশ্ব সমাজাতন্ত্রিক শিবিরের সঙ্গে মৈত্রীবদ্ধ হওয়া, তাদের ‘সহায়তা’ নেয়া, ‘বৈপ্লবিক একনায়কতন্ত্র’ কায়েম- প্রয়োজনে অ-মার্ক্সীয় সমাজতন্ত্রীদের নেতৃত্বে; সব ধরনের পুঁজির বিরুদ্ধে দৃঢ়সংকল্প ব্যবস্থা নেয়া ইত্যাদি। বাংলাদেশে ১৯৭১-৭৫ পর্যায়ে ‘বাকশাল’ কায়েম, অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় খাতের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিতে ন্যাপ-সিপিবি-আওয়ামী লীগের ‘গণঐক্যজোট’ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি প্রধান ঘটনাবলীর পেছনে উলিয়ানভ্স্কির উপরোক্ত তত্ত্বের গভীর প্রভাব কাজ করেছে।
বাকশাল করে শেখ মুজিব নিজের দল আওয়ামী লীগকেও বিলুপ্ত করেনঃ
‘জাতীয় দল’ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কেবল যে দেশের অন্য সকল রাজনৈতিক দল ও সংগঠন বিলুপ্ত করা হয় তাই নয়, দুই যুগের পুরনো আওয়ামী লীগের অস্তিত্বও বিলীন করে দেয়া হয়। কেবল আওয়ামী লীগের বিলুপ্তিই নয়- এসময় সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান ঘটানো হয় এবং সংবিধানের মৌলিক চরিত্রও পাল্টে ফেলা হয়।
‘বাকশাল’ গঠন করে যখন দু’টি সরকারি আর সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা দু’টি স্বাধীন সংবাদপত্র, মোট চারটি ছাড়া আর সবগুলো সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হলো তখন এই বিষয় নিয়ে বিবিসি’র বাংলা বিভাগের প্রযোজক সিরাজুর রহমানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমার দেশে ফ্রি-স্টাইল চলবে না’। তিনি আরো বলেছিলেন যে, খবরের কাগজের সংখ্যা কমিয়ে যে নিউজপ্রিন্ট বাঁচবে তা বিদেশে বিক্রি করে সেই পয়সা দিয়ে খাদ্যশস্য কিনে তিনি দেশের গরিব মানুষকে বাঁচাবেন। ততদিনে কিন্তু ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ, যাতে ৩০ হাজার লোক মারা যাবার কথা সরকারিভাবেই স্বীকার করা হয়েছিল, পার হয়ে এসেছে বাংলাদেশ।
১৯৬৪ সালে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকালে শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছিলেন-‘যারা গণতান্ত্রিক আদর্শ ও ব্যবস্থায় বিশ্বাসী কেবল সাময়িকভাবেই তাদের কণ্ঠরোধ করা যায়। অত্যাচার ও নিপীড়ন যদি বন্ধ না হয়, গণতন্ত্র যদি পুনরুজ্জীবিত করা না হয়, যদি কর্তৃপক্ষ গণতান্ত্রিক আন্দোলন চলতে না দেন, তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত তেমন পরিস্থিতিতে জনসাধারণ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই বেছে নিতে পারে। আর যদি তেমনটিই ঘটে তাহলে সেটা হবে এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়।’ অথচ দেখা গেল সারা জীবন তিনি যা যা বলেছেন, চর্চা করেছেন এবং যে সব ‘গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি’র জন্য লড়েছেন, সেগুলো প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মাত্র দু’-তিন বছরেই তিনি বিরক্ত হয়ে পড়েছেন।
‘বাকশাল’ পদ্ধতিতে ভারতের সায় ছিল বলে অনুমান করা যায়। কেননা, ভারতের তৎকালীন ক্ষমতাসীনরা বাংলাদেশের বহুদলীয় গণতন্ত্রের অবলুপ্তি ও বাকশাল প্রবর্তনকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের ভেতরে বাকশালের বিরোধীতা
পাকিস্তান রাষ্ট্র স্বৈরাচারী রূপ পরিগ্রহ করতে এক দশক সময় নিলেও, বাংলাদেশে স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে আনুষ্ঠানিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং তা অতীতের চেয়েও নিকৃষ্ট রূপ পরিগ্রহ করায় জনগণই কেবল নয়, তাতে খোদ মুজিব সরকারের নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সমর্থক পরিমণ্ডলেও গুরুতর প্রশ্ন ওঠে।
তবে মুজিবের এই উল্টো যাত্রায় তাঁর আশেপাশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা খুব অল্প সহকর্মীই সেদিন স্বচ্ছ ও স্পষ্টভাবে বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। ২৯২ জন সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে কেবল জেনারেল এম এ জি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন চতুর্থ সংশোধনী মেনে নিতে না পেরে সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দেন। এছাড়া আওয়ামী লীগ দলীয় কসবার এমপি এডভোকেট সিরাজুল হকও এসময় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় ‘সরকারের গণতন্ত্র বিরোধী’ কাজের সমালোচনা করে বক্তব্য রেখেছিলেন।
সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল উত্থাপনের আগে ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সর্বশেষ যে বৈঠক হয়, সেখানে সম্ভাব্য সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন- ‘আমরা আইয়ুব খানকে দেখেছি, আমরা ইয়াহিয়া খানকে দেখেছি। আমরা শেখ মুজিবুর রহমানকে শেখ মুজিবুর রহমান খান হিসেবে দেখতে চাই না।’
সেই সভায় জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ছাড়াও নূরে আলম সিদ্দিকী অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করলেন।
যারা এর পক্ষে বলেন তাদের যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি ছিল। বেশির ভাগ পক্ষের বক্তব্য ছিল এমন- ‘বঙ্গবন্ধু আপনি যা-ই করেন সেটাই ভালো, যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক এবং যা বলেন সেটাই শেষ কথা’।
সংসদীয় দলের সেই সভায় শেখ মুজিব সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তাদের কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেন। সংসদ সদস্যদের ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ বলেন। তরুণ এমপি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এর প্রতিবাদে বলেন, ‘আমাদের সবাইকে চোর না বলে যারা চুরি করেছে, যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ আছে তাদের বিচার করলেই তো হয়’। এমন সময় পেছন থেকে রাজশাহীর এমপি সরদার আমজাদ হোসেন চেয়ার তুলে মইনুল হোসেনকে আঘাত করতে যায়। শেখ মুজিব চিৎকার করে উদ্যত ব্যক্তিকে থামতে বলেন।
সেই সময়ের বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবের রাজনৈতিক বন্ধু, খন্দকার মোশতাক আহমদ নানাভাবেই চেষ্টা করেছিলেন সংবিধান পরিবর্তন এবং একদলীয় শাসন প্রবর্তনে শেখ মুজিবকে নিবৃত্ত করতে। তিনি শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার স্বামী এম এ ওয়াজেদ মিয়াকে বলেছিলেন, ‘এটা মারাত্মক ভুল হবে’। এ বিষয়ে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলার জন্য এম এ ওয়াজেদ মিয়ার সাথে খন্দকার মোশতাক আহমদ তিনবার আলাপ করেন।
যেদিন ‘বাকশাল’ প্রবর্তনের লক্ষ্যে চতুর্থ সংশোধনী গৃহীত হয়, তার আগের রাতেও ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে শেখ মুজিবের বাসভবনে গেলে সেখানে এম ওয়াজেদ মিয়াকে গেট থেকে কাছে আমগাছ তলায় টেনে নিয়ে যান খন্দকার মোশতাক। তাকে তখন খুব উত্তেজিত দেখালেও তিনি ওয়াজেদ মিয়াকে স্নেহের সুরে বলেন, ‘বাবা ওয়াজেদ, আগামীকাল তোমার শ্বশুর সংবিধানে যে পরিবর্তন ঘটাতে যাচ্ছেন, তা করা হলে সেটা শুধু একটা মারাত্মক ভুলই হবে না, দেশে-বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তিরও অপূরণীয় ক্ষতি হবে। তৃতীয় তলার বৈঠকখানায় গিয়ে তাঁকে একটু বোঝাও।’
তিন তলায় ওয়াজেদ মিয়া গিয়ে দেখলেন, সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছেন শেখ মুজিব। তারা চলে গেলেই ওয়াজেদ মিয়া কথাটা বলার সুযোগ খুঁজছিলেন। সেই রাতের খাবার তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গেই খান। খাওয়ার পরেই শেখ মুজিব কোনো কথা না বলে শোবার ঘরে চলে যান। ঠিক সেই মুহূর্তে শেখ ফজলুল হক মণি শয়ন কক্ষে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেন। রাত পৌনে একটায় যখন ওয়াজেদ মিয়া দেখা করার আশা ছেড়ে দিয়ে ফিরে আসেন, তখনো শেখ মুজিবের সাথে রুদ্ধদ্বার আলাপ চলছিল শেখ মণির।
‘বাকশাল’ চালুর আগে শেখ মুজিব তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী তাজউদ্দিনের কাছ থেকে একটা ফোন পেয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ‘আপনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সঙ্গে একমত নই… বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী-সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা- যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি কলমের এক খোঁচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা জারি করতে যাচ্ছেন। বাই টেকিং দিস্ স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য র্ডোস্ টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পজিশন।’
শেখ মুজিব তার দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বাকশালের প্রয়োজনীয়তা ব্যখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘এই পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতন্ত্র গ্রেট ব্রিটেনে এক ভোটে সরকার রক্ষা করেছে। ভারতে ম্যাডাম গান্ধীর সরকার অল্পের জন্য টিকে আছে। এসব আমি বুঝি। কিন্তু দেশের অবস্থা যে পর্যায়ে গেছে, তাতে আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে। ২৫ থেকে ৩০টির বেশি আসন আমরা পাবো না। তখন জামায়াত অন্যান্য স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সঙ্গে জোট বেঁধে আওয়ামী লীগ ও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে কচুকাটা করবে।
এ অবস্থা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য আমি এই পথ নিয়েছি এবং এটা অত্যন্ত সাময়িক। ’৮০ সালের মধ্যে বিপুল পরিমাণ গ্যাস ও তেল আমরা আহরণ করতে পারবো। এতে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড জোরদার করা সম্ভব হবে।
১৯৮০ সালের মধ্যেই আমি ‘বাকশাল’ থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবো। সংবিধানকে আবার সংশোধন করবো। যদিও বাকশাল করেছি সংসদে আইনের মাধ্যমে, ওই একই আইনের মধ্যে বিধান রেখেছি, আমি একক সিদ্ধান্তে ‘বাকশাল’ থেকে ফিরে এসে, বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করতে পারবো।’
সেই ‘অঙ্গীকার’ কতটা জোরালো ও আন্তরিক ছিল সেটার মূল্যায়ন করা আজ কঠিন হলেও জাতীয় ইতিহাস ও চরিত্র নির্ণয়ের স্বার্থে তা বিশেষ প্রয়োজন। সেই সাথে জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতটা সুষ্ঠু অথবা অগোছালো কিংবা শুধুমাত্র ক্ষমতা ধরে রাখার সুবিধাবাদী চিন্তাধারায় নিমজ্জিত ছিল তা-ও উদ্ঘাটন করা জরুরি।
বাকশালে যোগদান করা নিয়ে চাপাচাপিঃ
যে কেউ ইচ্ছা করলে সরকারি দল ‘বাকশালে’ যোগদান করতে পারবে, এটা ছিল সরকারি ঘোষণা। আসলে যোগ না দিয়ে কারো নিস্তার পাওয়ার উপায় ছিল না। ভেতরে ভেতরে সমস্ত সরকারি-বেসরকারি দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছিল- সবাইকে ‘জাতীয় দলে’ যোগ দেয়ার আবদেনপত্রে সই করতে হবে। কর্তৃপক্ষ যাকে ‘বিপজ্জনক’ মনে করে তাকে সদস্যপদ দেবে না। কিন্তু বাংলাদেশে বাস করে চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেঁচে থাকতে চাইলে, জাতীয় দলের সদস্যপদের আবেদনপত্রে সই করতেই হবে। সর্বত্র বাকশালে যোগদানের একটা হিড়িক পড়ে গেল।
শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বাকশালে’র কেন্দ্রীয় দপ্তর উদ্বোধন করতে এলেন তাঁকে স্বাগত সম্ভাষণ জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে গোটা দেশের উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক, কৃষক ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে হাজির থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল।
সেদিন ছিল মুষলধারে বৃষ্টি। অবিরাম ধারাস্রোতে প্লাবিত হয়ে, ভেজা কাকের মতো সুদীর্ঘ মানুষের সারি- কীভাবে রাস্তায় তারা অপেক্ষা করছিলেন, যারা এ দৃশ্য দেখেছেন ভুলবেন না। মহিলাদের গাত্রবস্ত্র ভিজে শরীরের সঙ্গে একাট্টা হয়ে গিয়েছিল। সুবিশাল জনারণ্যে দেশের নারীকুলকে লজ্জা-শরম জলাঞ্জলি দিয়ে শঙ্কিত চিত্তে তাঁর আগমনের প্রতীক্ষা করতে হচ্ছিল।
বাকশালে কারা ছিলো? বাকশাল নিয়ে জাসদের প্রতিক্রিয়া কী ছিলো?
অবাক করা বিষয় হলো, জাসদের তরফ থেকে মুজিবের বাকশালের জোরালো বিরোধিতা হয়নি। সম্ভবত এই বিষয়ে বিরোধিতায় তাদের নৈতিক ভিত্তি ছিল না। কারণ স্বাধীনতার পর পর সিরাজুল আলম খানের তিন গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া বিবৃতি দিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্যদের নিয়ে একটি ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠনেরই দাবি জানিয়েছিলেন। তারা সেদিন জরুরি অবস্থা ঘোষণারও আহ্বান জানান, যা ছিল স্পষ্টত গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রস্তাব।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে ‘বাকশাল’ ছিল তাদের তিন বছর আগেকার দাবিরই অনেকটা কাছাকাছি কর্মসূচি। কিন্তু বাকশাল কায়েমের পর প্রথম তাৎক্ষণিক আঘাত আসে জাসদের ওপরই। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাসের ৪৮ ঘণ্টা পরই পুলিশ জাসদের মুখপত্র হিসেবে পরিচিত ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’ কার্যালয় দখল করে নেয়।
বাকশালের ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাজনৈতিক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ বহির্ভূত মাত্র ১০ জনকে স্থান দেয়া হয়। এদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন সাবেক ন্যাপ (মো) ও সিপিবি’র। বাকি তিনজনের মধ্যে আতাউর রহমান খান তার সংসদ সদস্যের পদ বহাল রাখার লক্ষ্যে বাকশালে যোগদান করেন। অন্য দু’জন ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেতা মং প্রুয়ে সাই এবং বর্ষীয়ান বামপন্থি কৃষকনেতা হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ২০ জন ঊর্ধ্বতন আমলা, ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ‘ইত্তেফাক’ ও ‘বাংলাদেশ অবজারভার’-এর সম্পাদক এবং সেনবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর প্রধানদেরকেও বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
অবশ্য অনেকেই অভিযোগ করেন যে, তারা চাপের মুখে কেন্দ্রীয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে স্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এবং জোর করে তাদের সম্মতি আদায় করা হয়।
বাকশাল কীভাবে সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছিলো?
আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের যিনি রচয়িতা সেই টমাস্ জের্ফাসন্ পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সংবিধান সংশোধন করার এখতিয়ার সিনেটের হাতে থাকতে পারে না। আইনসভার সদস্যরা নিজেরাই এই সংবিধানের, অর্থাৎ জনগণের অভিপ্রায়ের আইনি সনদ কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সুতরাং তারা নিজেরা যদি সংবিধান সংশোধন করতে যান তাহলে তাদের নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের যা উৎস তাকেই অস্বীকার করা হয়, নিজেদেরকেও অস্বীকার করা হয়। সুতরাং সাধারণ সিনেটের কাছে সংবিধান সংশোধনের এখতিয়ার থাকতে পারে না। সংবিধান সংশোধন করতে হলে আবশ্যিকভাবে নতুন করে জনগণের অনুমোদন নিতে হবে।
সে কারণেই সংবিধানের ৪র্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে একদলীয় শাসনব্যবস্থা ‘বাকশাল’ কায়েম করাটা ছিল সংবিধান-বিরোধী পদক্ষেপ এবং সংবিধানের ঘোরতর লঙ্ঘন। বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদে এমপিগণ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করেই সেদিন সংবিধানের অপরিহার্য মৌলিক শর্ত ও নৈতিকতার বৈশিষ্ট্য ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিলেন।
৭৫ সালের ২৬শে মার্চ এক ভাষণে বাকশাল করার পেছনে শেখ মুজিব তাঁর চারটি লক্ষ্য ছিল বলে প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন। এগুলো হলো- দুর্নীতি দমন, উৎপাদন বৃদ্ধি, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য রচনা । তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে প্রতিটি গ্রামে কো-অপারেটিভ গড়তে হবে। জমি রাষ্ট্রায়ত্ত করা না হলেও ফসল পাবে সবাই। আর জাতীয় ঐক্য গড়ার জন্য দেশে একটিমাত্র দল থাকবে। তাঁর ভাষায়, তিনি চান ‘শোষিতের গণতন্ত্র’। বোঝা যায়, তিনি বাকশাল গঠন করেছিলেন সোভিয়েত আদর্শে। পার্থক্য এই যে, ‘কমিউন’ না করে তিনি ‘কো-অপারেটিভ’ গড়ার কথা বলেছিলেন, জমির মালিকানা যেখানে ব্যক্তিগত।
যারা দলীয় রাজনীতি করতেন না, তেমন বুদ্ধিজীবীদের, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাকশালে যোগদানের জন্য কেবল উৎসাহিত নয়, রীতিমতো ভয়-ভীতি দেখানোর ঘটনাও ঘটে। অবিশ্বাস্য হলেও বাকশালে যোগ দেওয়ার জন্যে সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও উৎসাহিত করা হয়। বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী এক সেনা সমাবেশে বলেন যে, দেশে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ সফল করার জন্য বাকশালে যোগ দিয়ে সেনাবাহিনীকেও সহযোগিতা করতে হবে।
শেখ মুজিবের নিজের দলের বেশির ভাগ নেতা বাকশাল সমর্থন করেননি। শেখ মুজিব নিহত হবার মাত্র সাত দিন আগে মুজিব সংসদ সদস্যদের মতামত জানার জন্য যে গোপন ব্যালট করেছিলেন, তাতে ৩০৭ জন সাংসদের মধ্যে ‘বাকশাল’ পদ্ধতিকে সমর্থন করেছিলেন মাত্র ১১৭ জন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের অভাবে সেই সময়ের সকল প্রতিবাদ প্রকাশ পাচ্ছিল গুপ্ত হত্যা এবং বোমাবাজির মাধ্যমে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আরম্ভ করে মে মাস পর্যন্ত কয়েকজন সংসদ সদস্যসহ ‘বাকশালে’র বহু স্থানীয় নেতা নিহত হন- যশোর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, গাইবান্ধা, টাঙ্গাইল ও টুঙ্গিপাড়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। এমন সব অরাজকতাকেই ‘বাকশাল’ প্রবর্তনের কারণ হিসাবে শাসকদলের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছিল।
বাকশালের সারকথা ছিল এই যে, দেশে একটিমাত্র রাজনৈতিক দল থাকবে; তার নাম হবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’, সংক্ষেপে ‘বাকশাল’। বলতে গেলে ‘বাকশাল’ ছিল আওয়ামী লীগেরই পরিবর্তিত রূপ ও নাম। যদিও এই দলে সিপিবি ও ন্যাপ (মো) যোগ দিয়েছিল, কিন্তু কার্যনির্বাহী কমিটিতে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দলের প্রতিনিধি ছিল না। নতুন দলটির প্রতীক ছিল আওয়ামী লীগেরই প্রতীক ‘নৌকা’। ১১৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটিতে অপর দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব ছিল অতি নগণ্য। যেমন, সিপিবি’র ছিলেন মাত্র একজন- মো. ফরহাদ। তাও তিনি ছিলেন ৭৭ নম্বর সদস্য।
এই একটিমাত্র দলে চেয়ারম্যানই হবেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী; যদিও ওই চেয়ারম্যান কীভাবে নির্বাচিত হবেন তার কোনো বিধান করা হয়নি। অর্থাৎ, শেখ মুজিব নিজেই যে হবেন নতুন দলের চেয়ারম্যান, এটা এত বেশি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়া হয় যে, তার জন্য কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উল্লেখ করারও প্রয়োজনবোধ করেননি নতুন দলের উদ্যোক্তারা।
চেয়ারম্যানের পর সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন কাঠামো হলো একক দলটির কার্যনির্বাহী কমিটি। সাধারণ সম্পাদকসহ যার ১৫ জন সদস্যের সকলকে চেয়ারম্যানই মনোনীত করবেন। একক এই দলের শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মহিলা ও যুব বিষয়ে অঙ্গ সংগঠন থাকবে। তার বাইরে দেশে আর কোনো শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, মহিলা ও যুব বিষয়ে সংগঠন থাকতে পারবে না। পার্লামেন্ট নির্বাচনে কেউ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাইলে, তাকে চেয়ারম্যানের অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমতি নিতে হবে। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে গঠনতন্ত্র পাল্টাতে পারবেন এবং চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের একমাত্র ব্যাখ্যাদানকারী হবেন।
বাকশাল ব্যবস্থায় জেলার মূল প্রশাসক হিসেবে যে সব গভর্নর নিয়োগ পাবেন, তারাও হবেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের মনোনীত।
সেই সময়ে শেখ মুজিব একটিমাত্র সংসদীয় আসন থেকে নির্বাচিত একজন সংসদ সদস্য ছিলেন। সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার বিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের সমর্থন লাভ করায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ও ক্ষমতা লাভ করেন। এই ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু ’৭৫-এর ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হলো, তাতে সংসদীয় পদ্ধতির অবসান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির হাতে নির্বাহী সমস্ত ক্ষমতা এবং আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বভার অর্পণ করা হলো।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এই একদলীয় নয়া পদ্ধতিতেও বিধান করা হয়েছিল যে, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। কিন্তু ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শেখ মুজিব স্পিকারের কাছে নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। এভাবে নতুন বিধানে নির্দেশিত জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের ব্যবস্থাও অগ্রাহ্য করা হলো। শুধুমাত্র একটি বিলের মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব নতুন ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হিসাবে রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন। সমুদয় রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে আরোহণ করলেন।
চতুর্থ সংশোধনীর এই বিধান একই সাথে পাস ও প্রবর্তন করা হয়েছিল এবং ওই সময় বহাল রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেয়া হয়নি- যা ছিল সংবিধানের অপরিহার্য নির্দেশ। কেননা চতুর্থ সংশোধনী পাস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যমান বা বহাল রাষ্ট্রপতি মুহম্মদুল্লাহকে পদচ্যুত ঘোষণা করা হয়েছিল। চতুর্থ সংশোধনীতে বলা হলো, এই বিধান জারির পর থেকে শেখ মুজিব বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থাকবেন- যেন তিনি রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। আরো বলা হলো, ধরে নিতে হবে যে, তিনি রাষ্ট্রপতি পদে ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।
বাকশাল কীভাবে রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছিলো?
বাকশাল মূলত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গড়ে ওঠা ‘রিপাবলিক’ বা ‘প্রজাতন্ত্র’র ভিত্তিকে তছনছ করে দেয়। আরো স্পষ্ট করে বললে, বাংলাদেশ নামের যেই রাষ্ট্র ১৯৭১-এ তৈরি হয়েছিল, সেই রাষ্ট্রকেই কার্যত ধ্বংস করে দেয়। বাকশাল মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে গঠিত রাষ্ট্রকে ধ্বংস করেছিল দু’ভাবে।
এক. বাকশাল যে আইনে হয়, সেই চতুর্থ সংশোধনী আইন-১৯৭৫-এ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১ সংশোধন করে বলা হয়েছিল, “Effective participation by the people through their elected representatives in administration at all levels shall be ensured” shall be omitted । যার বাংলা করলে দাঁড়ায়- সংশোধনের আগের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১-তে প্রশাসনের সর্বস্তরে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণের যে কথা বলা ছিল, এখন তা বাতিল করে দেয়া হলো। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা সোজা বাংলায় শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা, আর রাষ্ট্রীয় কাজে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে জনগণের অংশ নেয়ার ক্ষমতা থাকলো না।
দুই. সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিকের আদালতে যাবার যে মৌলিক অধিকার ৪৪ অনুচ্ছেদে স্বীকৃত ছিল, বাকশাল সংশোধনীতে সেই ৪৪ অনুচ্ছেদকেই বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। একই সাথে ১০২ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টকে দেয়া অধিকার অর্থাৎ সংক্ষুব্ধ কোনো নাগরিকের আবেদন শুনতে এবং প্রতিকার দিতে নির্বাহী বিভাগকে আদেশ দেবার আদালতের ক্ষমতাকেও একই সাথে বাতিল করা হয়। সোজা কথায়, চতুর্থ সংশোধনী আইন রাষ্ট্রের নাগরিকের সংক্ষুব্ধ হবার মৌলিক অধিকার রদ করেছিল এবং রাষ্ট্রকে লাগামহীন ক্ষমতা দিয়েছিল। এমন লাগামহীন ক্ষমতা পেলে তা আর রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র থাকে না। জনগণও আর নাগরিক থাকে না। এটা হয়ে যায় রাজত্ব বা রাজতন্ত্র আর জনগণ হয়ে যায় মধ্যযুগের রাজা-বাদশাহ্ ও সম্রাটদের আজ্ঞাবহ, অনুগত প্রজা।
বাকশাল বাংলাদেশের মানুষকে ‘নাগরিক’ থেকে ‘প্রজা’তে নামিয়ে এনেছিল, আর বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে রিপাবলিক থেকে ‘রাজতন্ত্রে’ অধঃপতিত করেছিল।
লেখক: পেশায় ডাক্তার, কলামিষ্ট ও লেখক