• মোদির মুসলিম বিরোধী মন্তব্য  উত্তাপ

পশ্চিমবঙ্গ নিউজ ডেস্ক: ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি আবার স্বরুপে ফিরেছেন। এবার আর আকারে-ইঙ্গিতে নয়, তার বিরুদ্ধে তোলা ধর্মীয় মেরুকরণ এবং নির্বাচনের আদর্শ আচরণবিধি মেনে না চলার অভিযোগের মাঝেই লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এবার সরাসরি মুসলিমদের নিশানা করেছেন। মঙ্গলবার তেলেঙ্গানাতে একটি সভায় তিনি জানিয়েছেন কংগ্রেস যদি তফসিলি জাতি ও জনজাতি, দলিত, ওবিসি-র সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিতে চায়, তাহলে প্রধানমন্ত্রী কিছুতেই তা হতে দেবেন না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সময় থেকেই এই একই রাজনীতি করে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মুসলমান শব্দটা ব্যবহার না করে ইঙ্গিতে বোঝাতেন।

তেলেঙ্গানার জাহিরাবাদের প্রচারসভা থেকে নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘যত দিন আমি বেঁচে আছি, দলিত জনজাতিদের সংরক্ষণকে ধর্মের ভিত্তিতে মুসলিমদের হাতে তুলে দেব না, দেব না, দেব না! কংগ্রেস এবং তাদের যত সহযোগী রয়েছ, তারা কান খুলে এই কথাটা শুনে নাও।’ এত বিতর্কের পরও কেন একই পথে হাঁটছেন প্রধানমন্ত্রী, সে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

ভারতে সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে ভারতের রাজস্থানে একটি রাজনৈতিক সমাবেশে মুসলিমদের লক্ষ্য করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সর্বশেষ মন্তব্য ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) জয়ী হবে বলে আশা করা হলেও মোদির মন্তব্য দেশটিতে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

বিবিসিসহ ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মোদির ইসলামফোবিক বক্তব্যের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিরোধী দলের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিম নেতৃত্ব। ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ ওঠা ওই বক্তব্যে মোদি অভিযোগ করেছিলেন—বিরোধী দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দেশের সম্পদ মুসলিমদের মধ্যে বিতরণ করবে। তিনি মুসলমানদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং তারা বেশি সন্তানের জন্ম দেয় বলেও মন্তব্য করেন। মোদি বলেন, ‘যখন তারা (কংগ্রেস) ক্ষমতায় ছিল, তারা বলেছিল—সম্পদের ওপর মুসলিমদের প্রথম অধিকার। তারা আপনার সব ধন-সম্পদ একত্র করে তাদের মধ্যে বণ্টন করবে, যাদের বেশি সন্তান আছে। তারা অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বিতরণ করবে।’ মোদির এই ধরনের বক্তব্যে সমাবেশে উপস্থিত বিজেপি সমর্থকেরা উচ্ছ্বসিত করতালির মধ্য দিয়ে সমর্থন প্রকাশ করে। এ সময় মোদি তাঁর সমর্থকদের জিজ্ঞাসা করেন, ‘তাদের কষ্টার্জিত সম্পদ যদি অনুপ্রবেশকারীদের দিয়ে দেওয়া হয়, তবে তারা কি তা মেনে নেবেন?’

বিরোধী দল ভারতের নির্বাচন কমিশনকে মোদির মন্তব্য তাঁর আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছে কি না তা তদন্ত করার জন্য অনুরোধ করেছে। এদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যরাও ঘৃণাত্মক মন্তব্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদির নিন্দা করেছেন। ভারতীয় মুসলিম সাংবাদিক রানা আইয়ুব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘এটি একটি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি, নির্লজ্জ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য।’ অল ইন্ডিয়া মজলিশ-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুসলিমিনের সভাপতি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেছেন, ‘মোদি আজ মুসলমানদের অনুপ্রবেশকারী এবং অনেক সন্তানের বাবা বলে অভিহিত করেছেন। ২০০২ সাল থেকে আজ পর্যন্ত মোদির একমাত্র গ্যারান্টি ছিল মুসলমানদের কলঙ্কিত করে ভোট পাওয়া।’ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়গে মোদির মন্তব্যকে ‘ঘৃণাত্মক বক্তব্য’ এবং ‘মনোযোগ সরানোর জন্য একটি সুচিন্তিত চক্রান্ত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। চরমপন্থায় অভিযুক্ত রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাসেবী সংঘকে (আরএসএস) ইঙ্গিত করে তিনি বলেছেন, ‘আজ প্রধানমন্ত্রী সংঘের মূল্যবোধ থেকে যা শিখেছেন, তা করেছেন। ভারতের ইতিহাসে, কোনো প্রধানমন্ত্রী তাঁর পদের মর্যাদাকে মোদির মতো এত নিচে নামাননি।’ কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে মঙ্গলবার নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করে বলেছেন, কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পথে রয়েছে এবং সেই কারণে ‘মঙ্গলসূত্র‘ আর ‘মুসলমানদের‘ প্রসঙ্গ বারে বারে নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদেরও অনেকে মনে করেন বিজেপি সাম্প্রদায়িক ইস্যুকেই সামনে এনে ভোটে জিততে মরিয়া। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক ও লেখক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, ‘সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্নটাই যাতে না থাকে তার চেষ্টা করছে বিজেপি। ওরা চায় অন্য ইস্যু নয়, সাম্প্রদায়িকতার ইস্যুটা সামনে রেখে ভোট হোক।’ দু’দফা ভোটের পর নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়েছে বিজেপি, তেমনটাও মনে করছেন অনেকে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. বিশ্বনাথ চক্রবর্তী নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার বক্তব্য, ’ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি যারা করছে তাদের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশন কেন পদক্ষেপ নিচ্ছে না?’

সরাসরি উল্লেখ না করলেও সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারসভা থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যে কয়টি বিষয় ঘুরে ফিরে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে, বিরোধীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ, কৃষকদের প্রতি বিজেপির সমর্থন, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্যে নারীদের বেহাল দশা, উন্নয়নের খতিয়ান এবং আরো অনেক প্রসঙ্গ। উঠে এসেছে রামমন্দিরের প্রসঙ্গ অথবা কিভাবে পশ্চিমবঙ্গের মতো কয়েকটি রাজ্যে রাম নবমী বা দুর্গাপূজা করতে দেয়া হয় না। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন চালু করা, জম্মু কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার, তিন তালাক বাতিলের ফলে মুসলিম নারীরা কতটা লাভবান হয়েছেন কিংবা ভারত-পাকিস্তান সঙ্ঘাতের মতো বিভিন্ন বিষয়ও এসেছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসে ২০১৪ সালে। তখন থেকেই ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলিম কঠিন সময়ের মধ্যদিয়ে যাচ্ছেন। হিন্দুত্ববাদী নজরদারিকারীরা গরু ব্যবসায়ী সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করেছে ব্যবসায়ীদের। টার্গেট করেছে মুসলিম মালিকানাধীন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। মসজিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। অনলাইনে মুসলিম নারীদেরকে ‘নিলামে’ বিক্রি করে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অধীনে ভারতে মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে অনলাইন বিবিসিতে এসব কথা লিখেছেন স্বতিক বিশ্বাস। ‘ইনভিজিবল ইন আওয়ার ওন কান্ট্রি’: বিং মুসলিম ইন মোদিস ইন্ডিয়া- শীর্ষক প্রতিবেদনে তিনি আরও লিখেছেন, ‘জিহাদ’ ‘লাভ জিহাদ’কে ইসলামভীতি হিসেবে উস্কানি দিয়েছে উগ্র ডানপন্থি গ্রুপগুলো এবং মূলধারার মিডিয়ার কিছু অংশ। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, হিন্দু নারীদের বিয়ে করে মুসলিমরা ধর্মান্তরিত করছেন বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হয়েছে।

ভারতে মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন ঘটনার চার ভাগের মধ্যে তিন ভাগই রিপোর্ট করা হয়েছে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোতে। ‘বিং মুসলিম ইন হিন্দু ইন্ডিয়া’ বইয়ের লেখক জিয়া উস-সালাম বলেছেন, মুসলিমরা হয়ে উঠেছেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। তারা এখন নিজেদের দেশে অদৃশ্য এক সংখ্যালঘু। মুসলিমদের ব্যবহার করছে কংগ্রেস ও বিরোধী দল। তাদেরকে ব্যবহার করে বিজেপিকে পরাজিত করতে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। যদি কোনো মুসলিম প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয় এবং মুসলিমরা যদি তাকে ভোট না দেন, তাহলে কোন দল তাদেরকে প্রার্থী করবে?  এটা সত্য যে, ২০১৯ সালের ভোটে ভারতের শতকরা মাত্র ৮ ভাগ মুসলিম ভোট দিয়েছিল বিজেপিকে। মোদির দলের বিরুদ্ধে একটি ব্লককে ভোট দেয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২০ সালে বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে শতকরা ৭৭ ভাগ মুসলিম ভোট দিয়েছেন বিজেপিবিরোধী জোটকে। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে শতকরা ৭৫ ভাগ মুসলিম সমর্থন করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসকে। ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশে শতকরা ৭৯ ভাগ মুসলিম সমর্থন দিয়েছেন বিরোধী দল সমাজবাদী পার্টিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You missed