মুহম্মদ হুমায়ুন কবির। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব (২০১০-১৩)। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনার ডেটা ফর ইম্প্যাক্ট প্রজেক্টের সিনিয়র স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে কাজ করছেন। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ১০০ দিন অতিক্রান্ত হওয়ার প্রেক্ষাপটে তিনি জুমে মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান।
প্রশ্ন: বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ১০০ দিন পার হয়েছে। পরিস্থিতি কেমন মনে করছেন?
উত্তর: ব্যক্তিগতভাবে আগে বলব যে আতঙ্কে আছি। বয়স ষাটের বেশি, আমি ঘর থেকে বের হই না। সামাজিকভাবে দেখলেও তাই দেখি। সবাই একটা শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। দেশ-বিদেশ সবখানেই এক অবস্থা। তবে সংক্রমণ মোকাবিলায় আমাদের ব্যবস্থাপনা যা হওয়া উচিত ছিল, সেটা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। যা যা পদক্ষেপ নিতে পারিনি, সেগুলো দ্রুত নেওয়া দরকার।
প্রশ্ন: লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজের বাংলাদেশবিষয়ক সর্বশেষ সমীক্ষার (প্রতিদিন সাত শত মারা যাবে) বিষয়ে কী বলবেন?
উত্তর: মডেলিংয়ের সাহায্য আমাদের নিতেই হবে। বিভিন্ন ধরনের গাণিতিক মডেল বিভিন্ন ধরনের পূর্বাভাস দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তো খালি চোখেই দেখছি, প্রতিদিনই বাড়ছে। আর তাই আমাদের স্বাস্থ্যকাঠামো কী অবস্থায় আছে, তার কথা আসবে। প্রাতিষ্ঠানিক প্রস্তুতি আমাদের কতটুকু ভালো? আমি ঢাকার অবকাঠামোর দিকে তাকিয়ে বলব না। এটা যদি সারা দেশে ছড়িয়ে যায়, সেটা ধরে নিয়েই ঢাকার বাইরেও সুচিকিৎসার যথাপ্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রশ্ন: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন বা সংক্রামক ব্যাধি আইনের প্রয়োগ বা এর আওতায় কমিটিগুলোর যেভাবে কাজ করার কথা, সেটা দৃশ্যমান নয়। আমলাতন্ত্রের আচরণ অদ্ভুত ঠেকছে।
উত্তর: আপনি যে দুটি আইনের কথা বলেছেন, তা সম্প্রতি সংশোধিত হয়েছে। কোয়ারেন্টিনে ছুটির কথা আমাদের সার্ভিস রুলে আছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে নেতৃত্বদান। তবে অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাঠামোতে অনেক দুর্বলতা আছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ার মোটামুটি অনুপস্থিত ছিল। বিশেষায়িত সব ধরনের হাসপাতাল ঢাকায়। জেলায় কারও হৃদ্রোগে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা সেখানে হয় না।
প্রশ্ন: আওয়ামী লীগপন্থী স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতা ডা. ইকবাল আর্সলান স্বাস্থ্য খাতের আমলাতন্ত্রকেই দায়ী করেছেন। বলেছেন, চিকিৎসকদের পরিবর্তে তঁারাই এখন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছেন। সিভিল বু্যরোক্র্যাট হিসেবে এই সমালোচনাকে কীভাবে দেখেন।
উত্তর: কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের সহায়তা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তার কাজগুলো করে। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ও তাই করে। আর শুধু স্বাস্থ্য খাতই নয়, পরিবার পরিকল্পনা, ওষুধ প্রশাসন তদারকির কাজও মন্ত্রণালয়কে করতে হয়। তবে হাঁ, ব্যাপক প্রশাসনিক সংস্কার দরকার। সেদিকে এখন যাব না। তিনি ভুল কি ঠিক, সেদিকেও যাব না। তবে একটা প্রশ্ন উঠবে, মন্ত্রণালয় কি বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে যথাযথ পরামর্শ পেয়েছে, নাকি পায়নি? হয়তো আপৎকালীন যেটা দরকার ছিল, সেটা হয়নি।
প্রশ্ন: লকডাউনের পরে লাল-সবুজের জোন এল, তাতে আবার ছুটি এল। তাহলে আইন যে বলছে মহামারিতে দুর্যোগ এলাকা ঘোষণা করতে, সেটা আর কী ঘটলে প্রযোজ্য হবে?
উত্তর: আমি ওভাবে এর উত্তর দেব না। কারণ, আমি তো কাঠামোর মধ্যে নেই। কোনো কাজে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় থাকলে, একটি কমিটি ব্যবস্থা কাজ করার কথা।
প্রশ্ন: আইনে এ রকম আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি সাজানো আছে। এগুলোর সমন্বিত ও সক্রিয় কাজগুলো সেভাবে দৃশ্যমান নয়। রেড জোনে বাসা, গ্রিনে অফিস, সমন্বয় কীভাবে?
উত্তর: আসলে কিছু এলাকা এতটাই ঘনবসতিপূর্ণ হতে পারে যে সেখানে দুই ভাগ করাটাই দুরূহ। আমার প্রশ্ন হলো, ঢাকায় জোনিং বাস্তবসম্মত কি না। নাকি ঢাকা শহরকেই একটি ইউনিট হিসেবে দেখা উচিত।
প্রশ্ন: বিশেষজ্ঞ কমিটি কারফিউ দিতে বলেছিল। সরকার মানুষকে বারণ করছে, তারা শুনছে না। কিন্তু বিপর্যয় ঘটলে রাষ্ট্র কি এটা বলে পার পাবে যে মানুষ কথা শোনেনি, আমি কী করব?
উত্তর: না। রাষ্ট্রকে আদেশ জারি করলেই হবে না, সেটা তাকে অবশ্যই এনফোর্স বা কার্যকর করতে হবে। আমি এখানে আপনার সঙ্গে একমত। কোনো আদেশ বা সিদ্ধান্ত জারির পরে সেটাকে বাস্তবায়ন করতে যে পদ্ধতি লাগে, অবশ্যই সেই পদ্ধতি কার্যকর করতে হবে। লকডাউন করে সুফল যা আমরা পেতে পারতাম, সেটাই পাইনি। সেই সময় চলে গেছে। কারণ, সমাজে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটে গেছে। এখন জোনিং করতে গিয়ে আমরা রাজধানী ঢাকার কথাই বেশি মনে রাখছি অথচ পুরো দেশকেই বিবেচনায় নেওয়া দরকার। ছুটির মধ্যে মানুষের ব্যাপক যাতায়াত আমরা এর আগে দেখেছি। উপরন্তু অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি যে যাদের উপসর্গ আছে, এমনকি তাদের জন্যও টেস্ট এখনো সহজলভ্য নয়। ঢাকার বাইরে কী ঘটছে, সেটা বলার জন্য যে তথ্য জানা থাকা দরকার, সেটা জানা নেই। টেস্ট–সংক্রান্ত যেসব তথ্য প্রকাশ্যে দ্রুত আসা দরকার, সেটাও আসছে না। তিন দিন আগে যার নমুনা নেওয়া হয়েছে, তার তথ্য আজকের তথ্যের মধ্যে মেশানো অবস্থায় জেনে আমার লাভ নেই। গতকালের সঙ্গে আজকের ব্যবধানটি কী, সেটা জানা–বোঝা খুবই জরুরি।
প্রশ্ন: প্রতিদিনের ব্রিফিংয়ের বদলে বুলেটিন দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিনকার চিত্র একতরফা পেতে হচ্ছে। বলা হয়, মহামারি রুখতে স্বচ্ছতা লাগবেই।
উত্তর: কোনো দ্বিমত নেই। স্বচ্ছতা লাগবে। তথ্য দিলেই হবে না, তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। তথ্য হবে অবাধ, তথ্য হবে পর্যাপ্ত এবং তথ্য হবে তাৎক্ষণিক। আমরা এর আগে মডেলিংয়ের কথা বলেছি। সে জন্যও কিন্তু তথ্য দরকার। তবে আমাদের টেস্ট যা দরকার, তার থেকে অনেক কম হচ্ছে। আর পর্যাপ্ত টেস্ট না হলে তো আপনি পর্যাপ্ত তথ্য পাবেন না। আমরা দেখছি, কোভিডে অনেকের মৃত্যু হলেও তা যথাযথভাবে শনাক্ত করা হচ্ছে না। এখন এমন অনেক মৃত্যু দেখতে পারছি, যা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। কিন্তু তা প্রচুর দেখতে পাচ্ছি। যদি প্রচুর টেস্ট হতো, তাহলে আমরা প্যান্ডেমিকের ট্রেন্ডটা ধরতে পারতাম। বুঝতে পারতাম আমরা কিসের সঙ্গে মোকাবিলা করছি।
প্রশ্ন: কোথায় যাচ্ছি আমরা? হাসপাতালগুলোকে দুভাগ করে চিকিৎসার পরিপত্র আছে, কিন্তু বাস্তবে তা কাজ করছে না।
উত্তর: সরকার চাইলে পরিস্থিতি অনুযায়ী যেকোনো পদক্ষেপ নিতে পারে। সব সময় আইনে থাকারও দরকার নেই। আগামী দু–এক মাসও যদি এভাবে চলতে থাকে এবং বর্তমানে রোগীর যে সংখ্যা, তাদের ভালো চিকিৎসা দিতে না পারলে সংখ্যা দ্বিগুণ হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? আমরা একটা বড় ঝুঁকির দিকে অগ্রসর হচ্ছি।
প্রশ্ন: আপনি বড় ঝুঁকি বলছেন, একজন বড় বিশেষজ্ঞ অনানুষ্ঠানিক এক আলোচনায় আমাদের বলেছেন, আমরা অথই সমুদ্রে আছি।
উত্তর: মাত্রাভেদে বলতে পারেন। আমরা সাগরে পড়েই গেছি, সেটাই বলতে চেয়েছেন কি না।
প্রশ্ন: তাহলে আমাদের অবস্থা এখনই সাগরে পড়া।
উত্তর: আমাদের অসংখ্য রোগী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সবাই যাতে পরীক্ষা করাতে পারেন, সেই সুবিধা তাড়াতাড়ি আরও বাড়াতেই হবে। টেলিমেডিসিনে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্ন: শুরুতে আপনি ব্যক্তিগত আতঙ্কের কথা বলেছিলেন। আজ (১৬ জুন) শেরেবাংলা নগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি কর্তৃপক্ষ তাদেরই সব ডাক্তার ও নার্সদের নিজেদের ‘প্রশাসন ও হিসাব বিভাগে’ প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পরিপত্র জারি করেছে। এটা কিসের লক্ষণ?
উত্তর: অতিমারির সময়ে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবনা বাড়ছে। মানুষ হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে, চূড়ান্ত পর্যায়ে যারা সামলাতে পারছে না, তারা আত্মহননের পথও বেছে নিচ্ছে। আমার মনে হয়, ব্যক্তিগতভাবে আমার মতো অনেকেই কোভিডের সংক্রমণের ভয়ে ভীত বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। যার প্রভাব আমাদের সামাজিক জীবনেও পড়ছে। এবং তা যে প্রাতিষ্ঠানিক আচার-আচরণকে প্রভাবিত করবে না, তা বলা যায় না। স্বাস্থ্যসেবা লাভের ক্ষেত্রে এ সমস্যাগুলো আমরা দেখছি। চিকিৎসকদের সুরক্ষা সরকারি ও বেসরকারি—দুই ক্ষেত্রেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি সাধারণ লোকজন যেন নিরাপদ ও নিশ্চিন্ত বোধ করে, তার উপায় সরকারকে দ্রুত বের করতে হবে।
আপনাকে ধন্যবাদ।