।। রকিবুল হাসান ।।
আজকাল যন্ত্রের রিজনিং নিয়ে অনেক আলোচনা হচ্ছে। আগে যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মানুষের কর্তৃত্ব প্রশ্নাতীত ছিল, এখন সেখানে যন্ত্রও কার্যকর ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সংকট গভীরতর হচ্ছে, বিনিয়োগ ও ব্যবসায়ীরা বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন। চলমান উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে ভ্যাট বাড়ানোর মতো সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আরও চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের ব্যয় কমানো এবং প্রশাসনকে ছোট ও দক্ষ করার বিষয়টি জরুরি হয়ে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, সরকার ছোট করতে আমরা কি যন্ত্রের রিজনিং ব্যবহার করে সরকার চালাতে পারি? হ্যাঁ, অবশ্যই পারি।
ধরুন, আপনি অনলাইনে আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলেন। সিস্টেম আপনার সব তথ্য যাচাই করে দেখল যে আপনার বয়স ১৮ বছরের নিচে। তখন এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার আবেদন বাতিল করবে। এখানে সরকারি কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ল না। কারণ, নিয়ম মেনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এটা যন্ত্রের রিজনিংয়ের ছোট্ট এবং এক সাধারণ প্রয়োগ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি পুরো সরকার এভাবে চালানো সম্ভব? অনেকেই বলবেন, না। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে মানবিক বোধ জরুরি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সঠিক ডেটা ব্যবহার করলে যন্ত্রও কার্যকর ও ন্যায়সংগত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কারণ, মানুষের মধ্যে ‘বায়াস’ অনেক বেশি। এ কারণে উন্নত ইকোনমিগুলো সরিয়ে এনেছে মানুষকে ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ থেকে। সরকারি অফিসগুলো সব চলে গেছে অনলাইনে।
ধরুন, কোনো একটি এলাকায় নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এখানে যন্ত্রের রিজনিং কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে? সরকার এমনিতেই জনগণের আয় ও খরচের ডেটা সংগ্রহ করে, যেগুলোকে ব্যবহার করে দারিদ্র্যের মাত্রা নির্ধারণ করা যায়। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, দেশ–বিদেশ ভ্রমণের তথ্য ও বিদ্যুৎ-গ্যাস, মোবাইল, এমএফএস বিল থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলের তথা যেকোনো মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রম বোঝা সম্ভব। সেটা দিয়ে সবারই ‘বেজলাইন’ ট্যাক্স নিরূপণ করা যায়।
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যন্ত্রের রিজনিং ব্যবহার ছাড়া খরচ কমানো অসম্ভব। দক্ষ প্রশাসন ও যন্ত্রের রিজনিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ ও খরচ সাশ্রয়ী করা সম্ভব।
মুঠোফোনের লোকেশন ডেটা বিশ্লেষণ দিয়ে ‘অ্যানোনিমাসলি’ মানুষের গতিবিধি নির্ধারণ করে অনেক কিছু করা যায়। গুগল ম্যাপের ট্র্যাফিক ডেটা ও গণপরিবহনে থাকা মানুষের মুঠোফোন বিশ্লেষণ করে বোঝা যাবে, কোন এলাকায় রাস্তার প্রয়োজন বেশি। কর সংগ্রহের তথ্য থেকে নির্ধারণ করা যাবে, কোন অঞ্চলের আর্থিক সামর্থ্য কেমন। এই বিশ্লেষণগুলোর মাধ্যমে যন্ত্র একটি কার্যকর সিদ্ধান্ত দিতে পারে, যা কেবল কোনো আমলার ব্যক্তিগত মতামতের ওপর নির্ভরশীল হবে না।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে ট্যাক্স আদায়ের হার অত্যন্ত কম। এ ক্ষেত্রে যন্ত্রের রিজনিং ব্যবহার করে স্বয়ংক্রিয় কর নির্ধারণ ও সংগ্রহ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব। জনগণের ডিজিটাল ট্রানজেকশন, বিমান, বাস ও ট্রেনের টিকিট, ব্যাংক হিসাব, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিল ও বিকাশ লেনদেন থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ট্যাক্সের হিসাব নির্ধারণ করা যাবে। কর আদায়ের জন্য বিশাল প্রশাসনিক কাঠামোর প্রয়োজন হবে না। কারণ, সিস্টেম নিজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কর নির্ধারণ ও সংগ্রহ করতে পারবে। এভাবে সরকার ব্যয় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারবে।
বাংলাদেশ সরকার দেশের সবচেয়ে বড় নিয়োগকর্তা। তাহলে বর্তমান সরকারি চাকরিজীবীদের কী হবে? এ ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবসায়িক সেক্টরগুলোকে ধাপে ধাপে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া শুধু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ‘হিউম্যান ইন দ্য লুপ’ মডেল রাখা যেতে পারে, যেখানে কেবল জটিল বিষয়গুলোতে মানবিক হস্তক্ষেপ থাকবে।
কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থার ফলে যে পরিমাণ সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে, তা দিয়ে একটি সর্বজনীন ন্যূনতম ভাতা (ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম) চালু করা সম্ভব। যাঁরা বার্ষিক নির্দিষ্ট আয়ের নিচে থাকবেন, তাঁরা সরকার থেকে একটি অনুদান পাবেন। এটি এমনভাবে ডিজাইন করা যেতে পারে, যেখানে ৩ দশমিক ৫ লাখ টাকার কম আয় হলে সরকার অনুপাত অনুযায়ী নেগেটিভ ট্যাক্স হিসেবে অর্থ প্রদান করবে জনগণকে।
সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে যন্ত্রের রিজনিং ব্যবহার ছাড়া খরচ কমানো অসম্ভব। দক্ষ প্রশাসন ও যন্ত্রের রিজনিং প্রযুক্তির সমন্বয়ে বাংলাদেশ সরকারকে আরও কার্যকর, স্বচ্ছ ও খরচ সাশ্রয়ী করা সম্ভব।
রকিবুল হাসান টেলিকম, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক এবং ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মানবিক রাষ্ট্র’ বইয়ের লেখক