ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর একটি বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ। হজরত খানজাহান আলীর (রহ.) শ্রেষ্ঠ কীর্তির এই মসজিদ উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের অন্যতম নিদর্শন। লাল পোড়া মাটির ওপর সুনিপুণ লতাপাতার অলংকরণে শোভিত মসজিদের ভেতরে-বাইরে সৌন্দর্যের প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। মসজিদে বসে রাজ্য পরিচালনা করতেন খানজাহান আলী। ৬০০ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি।
খানজাহান আলীর জন্ম ও পরিচয়
খান উল আজম উলুঘ খান ই জাহান ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে এক মুসলিম পরিবারে জন্ম নেন। হজরত খানজাহান আলী নামে পরিচিত ছিলেন। তার বাবার নাম আকবর খাঁ এবং মায়ের নাম আম্বিয়া বিবি। বাবার কাছেই প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে দিল্লির বিখ্যাত ওলিয়ে কামেল পীর শাহ নেয়ামত উল্লাহর কাছে শিক্ষাজীবন শুরু হয়। কোরআন, হাদিস ও ফিকহ শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞানার্জন করেন। শিক্ষাজীবন শেষে তুঘলক সেনাবাহিনীতে কর্মজীবন শুরু হয়। অল্প সময়ে প্রধান সেনাপতি হন। ১৩৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২৬-২৭ বছর বয়সে জৈনপুর প্রদেশের জাবিতান (গভর্নর) পদে যোগ দেন। পরবর্তী সময়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারে বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে বর্তমান বাগেরহাটে চলে আসেন। এরপর যশোর-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা ও বরিশালের কিছু অংশ নিয়ে গড়ে তোলেন একটি রাজ্য। রাজ্যের নাম দেন খলিফাতাবাদ।
জানা গেছে, সুলতানি আমলে ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বাগেরহাট শহর থেকে সাত কিলোমিটার পশ্চিমে সুন্দরবনঘেঁষা গ্রামে অবস্থিত। দিল্লির সুলতানদের প্রতিনিধি হিসেবে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে সুন্দরবন অঞ্চলে একটি সমৃদ্ধ নগরী গড়ে তুলে নাম দেন খলিফাতাবাদ। ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি এই অঞ্চলে বিভিন্ন স্থাপনা গড়েন তিনি। রাস্তাঘাট, দিঘি, মসজিদ, হোজরা খানা ও সরাই খানাসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেন। ভূমিক্ষয়ের ফলে কালের আবর্তে একসময় হারিয়ে যায় এই মসজিদ।
আধুনিককালের ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, ১৮৭১ সালে আগাছার তলদেশ থেকে এই মসজিদ আবিষ্কার করা হয়। শুরুতে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল মসজিদটি। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ একাধিকবার সংস্কার করা হয়েছে। ৬০০ বছর ধরে নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ষাট গম্বুজ মসজিদ নাম দেওয়া হলেও মূলত গম্বুজের সংখ্যা ৮১টি। ষাটটি পিলারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকায় ষাট গম্বুজ মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে বলে ধারণা ইতিহাসবিদদের। চৌচালা বিশিষ্ট ছাদের ঠিক মাঝখানে পূর্ব-পশ্চিমে সাতটি গম্বুজ। এর এক পাশে সাত সারিতে পাঁচটি করে ৩৫টি। অপর পাশে সাত সারিতে পাঁচটি করে ৩৫টি। চার কোনায় মিনারের ওপর চারটিসহ ৮১টি গম্বুজ রয়েছে। পশ্চিম পাশের দুটি মিনার পূর্বপাশের মিনার দুটি অপেক্ষা মোটা। যার মধ্যে গম্বুজের ওপরে ওঠার জন্য দুটি সিঁড়ি রয়েছে। একটিকে আন্ধারকোঠা বলা হয়। অপরটিকে রওশনকোঠা বলা হয়।
একসময় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আজান দেওয়া হতো। সেই সঙ্গে শত্রুদের গতিবিধির ওপর নজর রাখা হতো। বর্তমানে মাইকে আজান দেওয়া হয়। চারদিকে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা পূর্বপাশে দেয়ালের সঙ্গে যে তোরণ রয়েছে তাকে সিংহদ্বার বলা হয়।
মসজিদের পূর্ব দিকে একটি বড় দরজাসহ ১১টি দরজা রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে ছোটবড় মিলিয়ে ১৪টি দরজা রয়েছে। পশ্চিম দিকে একটি ছোট দরজা রয়েছে। যা দেখে বোঝা যায়, এটি বিচারালয় ছিল। খানজাহান আলী এবং তার শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখান থেকে মসজিদে যাতায়াত করতেন। সর্বমোট এই মসজিদে ২৬টি দরজা রয়েছে। এটি শুধু মসজিদ নয়; বিচারালয়ও বটে।
মসজিদে বসে ধর্মের দাওয়াত দিতেন এবং সঙ্গী এবং কর্মকর্তাদের নিয়ে সমাবেশ করতেন খানজাহান আলী। মধ্যযুগে বাংলাদেশে অতি প্রাচীন আমলের এত বড় মসজিদ আর কোথাও দেখা যায়নি বলে জানা যায়।
গবেষকরা বলছেন, জলবায়ুর ক্ষতি থেকে মসজিদটি রক্ষায় স্তম্ভের নিচে চার ফুট পর্যন্ত পাথরের আস্তরণ দেওয়া হয়েছে। মসজিদের দুই পাশে সাতটি করে সামনের অংশে ১০টি, মেহেরাবের পাশে একটি দরজা রয়েছে। কারও কারও মতে, ষাটটি স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত বলে এটিকে ষাট গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।
ষাট গম্বুজ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ আখতারুজ্জামান বাচ্চু বলেন, ‘ধর্ম প্রচারক হজরত খানজাহান আলী এখানে বড় বড় দিঘি খননের মধ্য দিয়ে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছিলেন। এসব পানি কৃষিকাজে ব্যবহার হতো। সহজ যোগাযোগ ও যাতায়াতের জন্য অনেক রাস্তাঘাট নির্মাণ করেছেন। ইসলাম যে শান্তির ধর্ম সেটি তিনি ধর্ম প্রচারের মধ্য দিয়ে শিখিয়ে গেছেন। সামাজিক ও এই অঞ্চলের উন্নয়নে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। এখানে বসেই রাজ্য শাসন করতেন তিনি।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘এই মসজিদ নির্মাণ সহজ কাজ ছিল না। তার সঙ্গে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠী ছিলেন। তারাই মূলত তার শক্তি ছিলেন। তিনি যেমন আধ্যাত্মিক ছিলেন, তেমনি ন্যায়পরায়ণ শাসকও। এই অঞ্চলে যেসব স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে, তার মধ্যে সেরা স্থাপনা ষাট গম্বুজ মসজিদ।’
আঠারো শতকের শেষের দিকে অযত্ন ও অবহেলায় মসজিদটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। কয়েক দফায় সংস্কার করা হয়। পরে এটি তার পুরনো সৌন্দর্য ফিরে যায়। এখন প্রতিদিন মসজিদ দেখতে ভিড় জমান শত শত দর্শনার্থী।
৬০০ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এটি
খানজাহান আলী গবেষক মো. আরিফুল ইসলাম আকুঞ্জি বলেন, ‘মসজিদের পুরাকীর্তির গায়ে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব সবার। ঐতিহাসিক এই স্থাপনার কোনও কিছু যাতে হারিয়ে না যায় সেদিকে সবার নজর রাখতে হবে। এটির সৌন্দর্য রক্ষায় পর্যটকদেরও সচেতন হবে হবে।’
বাগেরহাট প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের কাস্টোডিয়ান মোহাম্মদ যায়েদ বলেন, ‘ষাট গম্বুজ মসজিদের পুরাকীর্তির গায়ে অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। প্রতিদিন মসজিদটি দেখতে আসেন অসংখ্য পর্যটক। মসজিদের সৌন্দর্য দেখে সবাই মুগ্ধ হন। এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।’
ষাট গম্বুজ মসজিদের খতিব মাওলানা হেলাল উদ্দীন বলেন, ‘মসজিদের দক্ষিণ পাশের জাদুঘরে ঠাঁই পেয়েছে হজরত খানজাহান আলীর সময়কার শতাধিক নিদর্শন। গত কয়েক বছর ধরে মসজিদে দক্ষিণাঞ্চলের ঈদের সবচেয়ে বড় জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মসজিদ কালের সাক্ষী।’