বৃহৎ পরিসরে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা নিজের বর্ণমালার অধিকার রক্ষা ও ভাষার দাবিতে রক্ত দিয়ে ইতিহাসের পাতায় ভাস্বর হয়ে আছেন। যে জাতির ভাষার ইতিহাস এমন গৌরবগাথা- সেই জাতি নিজেদের ভাষা আদৌ কতটুকু শিখতে পেরেছে সাত দশক পরে এসে সেই প্রশ্ন মনে জাগে।
যে জাতীয়তাবোধের ধারণা থেকে বাঙালি বাংলা ভাষাকে নিজেদের রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, এতকাল পরে এসে নিজেদের ভাষার প্রতি বাঙালির এমন আবেগ এখন কতখানি তা একটি বড় প্রশ্ন।
ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় বাঙালির প্রথম সাংস্কৃতিক বিপ্লব যা মূলত জাতীয়তাবোধের পরিচয়ের প্রথম ধারক। যে জাতীয়তাবোধের ধারণা থেকে বাঙালি বাংলা ভাষাকে নিজেদের রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে, এতকাল পরে এসে নিজেদের ভাষার প্রতি বাঙালির এমন আবেগ এখন কতখানি তা একটি বড় প্রশ্ন।
বিদেশি ভাষা শিক্ষাকে যেখানে দক্ষতার পরিচায়ক হিসেবে দেখা হয়, সেখানে দেশি ভাষা অর্থাৎ নিজের মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে বলতে ও লিখতে পারাকে শুধু দক্ষতা না যোগ্যতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। তবে নিজেদের ভাষা নিয়ে বাঙালির হীনম্মন্যতা ও বিদেশি ভাষার প্রতি এক রকমের অন্ধ আবেশ কাজ করা বাঙালির জীবনে নতুন কিছু না। কাল কালান্তরে বাঙালি নিজের ভাষাকে ক্ষীণ চোখে বিচার করে যোগ্যতার পরিচায়ক হিসেবে মানদণ্ডে স্থান দিয়েছে বিদেশি ভাষাকে।
মূলত সিন্ধু তীরে আর্যদের আগমন ও স্থানীয় দ্রাবিড়, কোল, মুণ্ডা জাতি, যারা পরে অনার্য তকমা পেয়ে ইতিহাসে টিকে আছে তাদের ওপর আগ্রাসনের ইতিহাস বিবেচনা করা হয় তাহলে দেখা যায়, বিদেশি ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার ওপর প্রথম আধিপত্য সংস্কৃত ভাষার। ক্ষমতার পালাবদলে সংস্কৃত থেকে ফারসি, ফারসি থেকে ইংরেজি, সবসময়েই কোনো না কোনো বিদেশি ভাষা বাংলা ভাষার ওপর আধিপত্য বিরাজ করে এসেছে। তবে এসব আধিপত্যের তোয়াক্কা না করে যুগ যুগান্তরে বাংলা ভাষা হারিয়ে না গিয়ে এসব ভাষা থেকে প্রয়োজনমাফিক শব্দভান্ডার ব্যবহার করে সমৃদ্ধ হয়েছে।
তবে টিকে থাকার এ ইতিহাসের পরতে পরতে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত রয়ে গেছে এক রকমের হীনম্মন্যতা। নিজের সংস্কৃতি তথা ভাষা নিয়ে এ হীনম্মন্যতার প্রভাব যে সেই আদিকাল থেকে তা মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমের বঙ্গভাষা কবিতায় প্রকটভাবে ফুটে উঠেছিল।
এ জন্য বোধহয় কবি আবদুল হাকিম লিখেছেন, ‘যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ অর্থাৎ বাংলার অধিবাসীদের মধ্যেই এমন অনেক মানুষ আছেন যারা বাংলা ভাষার অধিকারী হয়েও নিজের ভাষাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন।
সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত হওয়ার কারণে মুসলিম শাসকদের কাছে বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানি ভাষা বলে তকমা দেয়ার এক সাম্প্রদায়িক মনোভাব মধ্যযুগেই প্রচলিত হয়েছিল। আর সেই মধ্যযুগ থেকে পাকিস্তান আমল পুরোটাই সময়েই বাংলা ভাষাকে অনেক দমম-পীড়ন সহ্য করতে হয়েছে।
তবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে রাজপথে শহীদ হওয়ার স্বাক্ষর বাংলা ভাষাকে শুধু এই মুল্লুকের রাষ্ট্রভাষা না, আন্তর্জাতিকভাবেও পাকাপোক্তভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পৃথিবীতে বহুল ব্যবহৃত ভাষার মধ্যে বাংলার অবস্থান সপ্তম। বর্তমানে সারা বিশ্বে ২৭ কোটির বেশি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে।
দেশের প্রায় সিংহভাগ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষায় কথা বললেও এখনো দেশের প্রায় প্রতিটি খাতের দাফতরিক ভাষা ইংরেজি। দেশে শুদ্ধ ইংরেজি শেখার জন্য মানুষের মধ্যে যে উত্তেজনা কাজ করে। যেভাবে দেশে ব্রিটিশ কাউন্সিল গড়ে উঠেছে, আইএলটিএস হয়ে উঠেছে জনপ্রিয় পরীক্ষা, ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোকে ধরা হয় সম্ভ্রান্তের প্রতীক হিসেবে; সেই অনুসারে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষা শিক্ষা অনেক বেশি পশ্চাৎপদ।
ভাষা শিক্ষা প্রসঙ্গে মাতৃভাষাকে এড়িয়ে বিদেশি ভাষার ওপর নির্ভরশীলতা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, িদেশে রুচি ও জ্ঞানের দুর্ভিক্ষের সবচেয়ে বড় কারণ নিজ ভাষায় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা না দেয়া। যতদিন না নিজ ভাষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হবে, ততদিন পর্যন্ত জ্ঞানের বিকাশ লাভ করা যাবে না। যদি কেউ জ্ঞান লাভ করতে চায় হোক তা বিশ্বজনীন, সেখানেও মাতৃভাষা সবচেয়ে বড় মাধ্যম। মাতৃভাষার মাধ্যমে বিদেশি ভাষার অনুবাদ পারে শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করতে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শব্দতত্ত্ব প্রবন্ধ সংকলনে বাংলা ভাষা ও বাঙালির এই ভাষা ব্যবহারের আচার প্রসঙ্গে বলেন, প্রত্যেক ভাষার নিজের একটা ছাঁচ আছে। উপকরণ যেখান হইতেই সে সংগ্রহ করুক, নিজের ছাঁচে ঢালিয়া সে তাহাকে আপনার সুবিধামতো বানাইয়া লয়। সেই ছাঁচটাই তাহার প্রকৃতিগত, সেই ছাঁচেই তাহার পরিচয়। উর্দু ভাষায় ফারসি আরবি কথা ঢের আছে, কিন্তু সে কেবল আপনার ছাঁচেই চতুর ভাষাতত্ত্ববিদের কাছে হিন্দির বৈমাত্র সহোদর বলিয়া ধরা পড়িয়া গেছে। আমাদের বাঙালি কেহ যদি মাথায় হ্যাট, পায়ে বুট, গলায় কলার এবং সর্বাঙ্গে বিলাতি পোশাক পরেন, তবু তাঁহার রঙে এবং দেহের ছাঁচে কুল-লক্ষণ প্রকাশ হইয়া পড়ে।
আধুনিক বাংলাভাষায় বিদেশি শব্দের ব্যবহারকে ঢালাওভাবে কুরুচিপূর্ণ বলার কোনো উপায় নেই। কিন্তু যখন বাংলা উচ্চারণ ও বাচনভঙ্গিতে ইংরেজির মিশেলে বাংলিশ করা কিংবা বলিউডের সিনেমা দেখে বাংলার মাঝে মাঝে ভাঙা ভাঙা হিন্দি ব্যবহার করা; আর এসব করে নিজেকে স্মার্ট ভাবার যে প্রবণতা তাই মূলত রক্ত দিয়ে পাওয়া বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির আজ অবধি বিদ্যমান হীনম্মন্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
বাঙালি ঢালাওভাবে যেভাবে ইংরেজি ব্যাকরণ পড়ে ঠিক সেভাবে বাংলা ব্যাকরণ তাদের টানে না। সাধু-চলিত-আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণের সঙ্গে কয়েক পদের বিদেশি ভাষা মিশিয়ে বর্তমানে বাংলা ভাষা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে করে ঠিক শুদ্ধ বাংলা কাকে বলা যায় তা চিন্তার বিষয়।
বাংলা ভাষার বর্তমান দশা, ব্যবহার ও মর্যাদার দিকে তাকালে নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের সেই ধ্রুপদী কবিতার লাইন- ‘তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ এর মর্ম হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। আর্য, তুর্কি, আফগান, ব্রিটিশ, পাকিস্তানিদের পর এবার বাঙালি নিজেই নিজের ভাষার বিশুদ্ধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আর প্রতি ২১ ফেব্রুয়ারি এসে বারবার উত্থাপিত হচ্ছে সেই একই প্রশ্ন, ভাষার জন্য রক্ত দিলাম, সেই ভাষা কতটুকু শিখলাম?