শিক্ষাবিদ ও সমাজ-বিশ্লেষক আবুল কাসেম ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। সাহিত্যের পাশাপাশি রাজনীতি ও সমাজ তাঁর লেখা ও চিন্তার বিষয়। কথা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির বর্তমান সংকট এবং ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনোজ দে।
মনোজ দে: পরপর দুটি নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর এবারের নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দল অংশ নিচ্ছে না। বাংলাদেশের রাজনীতি কোন পথে চলেছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ২০১৪ আর ২০১৮—এই দুটি নির্বাচন নিয়েই কেবল প্রশ্ন ছিল এমন নয়। বাংলাদেশে অনেক আগে থেকেই প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হয়েছে। জেনারেল এরশাদের সময় ১৯৮৮ সালে একটা ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছিল। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অনেক দল সেই নির্বাচন বর্জন করেছিল। তারপরও নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করেছিল। সে সময় ঢাকার বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরেফিরে দেখেছি, এরশাদের অনুগত গুটিকয় লোক ছাড়া, কেউ ভোট দিতে যায়নি। কাজেই নির্বাচন বর্জন করার ব্যাপারটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। আবার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব কটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ নির্বাচনের সময় ছাত্রলীগ পরাজয় বুঝতে পেরে ট্রাকে করে ব্যালট বাক্স নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে পরাজিত প্রার্থীদের বিস্তর অভিযোগ ছিল। জিয়াউর রহমানের সময়ে নির্বাচনকে অর্থহীন ও হাস্যকর নির্বাচনে পরিণত করা হয়েছিল।
মনোজ দে: বাংলাদেশের রাজনীতির এই অবস্থার পেছনে দায়টা কার? এ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো উপায় দেখেন কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যে ধারার রাজনীতি করছে, সেই ধারাই মূলত এর জন্য দায়ী। আগে দায়টা এককভাবে নিত, এখন দুই দলই কিছু সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে জনসাধারণের মনভোলানো কিছু বক্তব্য দেওয়া ছাড়া বিএনপির এখন কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য নেই। একসময় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল, কিন্তু গত ১৫ বছরে তাদের একটানা শাসনামলে সেই রাজনৈতিক বক্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলোও খুব ঝুঁকি নিয়ে অগ্রসর হয়নি। এসব কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি ভুল পথে এগিয়েছে। অর্থাৎ দিন দিন বাংলাদেশের রাজনীতি গণতন্ত্রবিরোধী ক্ষমতার লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়েছে। এখন যে ধারায় রাজনীতি চলছে, ভবিষ্যতে তাতে খুব ভালো কোনো সম্ভাবনা দেখি না।রাজনীতি করার জন্য যে শিক্ষাদীক্ষা, চিন্তাভাবনা ও ক্ষমতায় যাওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি দরকার, সেটি আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক, জাতীয় পার্টি হোক কিংবা বামপন্থী দল হোক—আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো সেটি বিশ্বাস করে না। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই তারা সভায় বক্তব্য দেয়, বিবৃতি দেয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো দল গঠনের দিকে একেবারেই মনোযোগ না দিয়ে নেতাদের ভাবমূর্তি তৈরির রাজনীতি করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিবারতন্ত্র। এ ধরনের রাজনীতি গণতন্ত্রসম্মত নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি নষ্ট হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে সেখান থেকে স্বাভাবিক রাজনীতি বিকাশের সম্ভাবনা দেখি না।
মনোজ দে: দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর আমরা ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে এলাম। একটি গণতান্ত্রিক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলো। সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখা গেল না কেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: শীতল যুদ্ধ চলাকালে ষাট ও সত্তরের দশকে আমরা দেখেছি দুর্বল রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক অভ্যুত্থান হতে। এসব সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ থাকত এবং অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত সরকারগুলোকে সমর্থন দিত। ১৯৮০–এর দশকের মাঝামাঝি এসে যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থান থেকে সরে আসে। ফলে বাংলাদেশেও নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটি অনিবার্যতা তৈরি হয়েছিল।১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিদেশি অনেক রাষ্ট্র থেকে পর্যবেক্ষক এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিলেন, যুক্তরাজ্য থেকে এসেছিলেন; ফ্রান্স, জার্মানি ও জাপান থেকে এসেছিলেন। এসব দেশ থেকে যেসব পর্যবেক্ষক ও প্রতিনিধিরা এসেছিলেন, তাঁরা নির্বাচন করতে সাহযোগিতা করেছিলেন। বাইরের শক্তি ছাড়া নির্বাচন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারত—সেটি বিশ্বাস করা কঠিন। পরের নির্বাচনগুলোর আগেও আমরা দেখেছি, জাতিসংঘসহ বাইরের শক্তিগুলো নানাভাবে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে।
মনোজ দে: আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান আমরা নিজেরা কেন করতে পারব না? এর পেছনে কি আমাদের মানসিকতা দায়ী, নাকি ঐতিহাসিক কোনো কার্যকারণ আছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: এর পেছনে নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক দুটি কারণই থাকতে পারে। একসময় কলকাতা ছিল জ্ঞানবিজ্ঞান, চিন্তাচেতনার দিক থেকে সবচেয়ে অগ্রসর এলাকা। জাপান, চীন ও ইন্দোচীনের রাষ্ট্রগুলো কিংবা ইরান, ইরাক, মিসর থেকে একেবারে দক্ষিণ আমেরিকা পর্যন্ত কলকাতার সমকক্ষ কোনো নগর ছিল না। ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে যখন রাজনীতি শুরু হলো, তখন আমরা বাঙালি নেতাদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, এ রকম কয়েকজনের নামই পাই। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিন্তু তাঁদের হাতে থাকেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব চলে যায় উত্তর ভারতের নেতাদের হাতে।অনেকে মনে করেন, নৃতাত্ত্বিকভাবে বাঙালি এমন একটি জনগোষ্ঠী, যাদের রাজনৈতিক যোগ্যতা ও রাজনৈতিক মানসিকতা নেই। রাজনীতিতে আমরা দীর্ঘস্থায়ী কৃতিত্বের পরিচয় দিতে পারি না। সংঘশক্তি গড়ে তুলতে পারি না। আবার অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, এখানকার যে আবহাওয়া, কম পরিশ্রমে বেশি খাদ্য উৎপাদনের যে বৈশিষ্ট্য এবং খাদ্যাভ্যাস (ভেতো বাঙালি বলে পরিচিত), সে কারণে এখানকার মানুষ শারীরিক গঠনেও শক্তিশালী হয় না, মানসিক দিক থেকে দুর্বল চিত্তের হয়।বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বিকাশ না হওয়ার পেছনে নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক, এ দুটি কারণের কথা বলা হয়। আমরা যদি ইংরেজ শাসনবিরোধী আন্দোলন দেখি, সেখানেও দেখব, বাঙালিরা পারে না কেন, এ বিষয়ে আলোচনা এসেছে। উনিশ শতকে প্রথম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালি কেন রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারে না, সেই প্রশ্ন উত্থাপন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাভাবনা আছে। ফলে তাঁদের চিন্তা থেকে আমাদের এ প্রশ্নের অনুসন্ধান করা জরুরি।
মনোজ দে: রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাব সমাজে নানাভাবে পড়ছে। তরুণেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তরুণদের একটি বড় অংশ দেশ ছাড়তে চাইছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো বটেই, এমনকি কলেজগুলোর ভালো শিক্ষার্থীরা দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল। তাঁরা মনে করছেন, এই দেশের রাজনীতি ভালো হবে না, এই দেশের জনজীবনের অবস্থা ভালো হবে না। তাঁরা ভাবছেন, এ দেশে আইনের শাসন আছে, সে কারণে দেশ টিকে আছে; কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাপারে ন্যায্যতা নেই। তরুণেরা ভাবছেন, রাজনীতিটা এখানে স্বেচ্ছাচারিতার পর্যায়ে চলে গেছে। এখানে থাকলে তাঁদের জীবনের সুস্থ-স্বাভাবিক উন্নতি সম্ভব নয়। তরুণদের একাংশের মধ্যে এই চিন্তাটা আগে থেকেই আছে। তবে গত ১০-১৫ বছরে সেটি প্রকট আকার নিয়েছে। কী কারণে তরুণেরা বিদেশে চলে যেতে চান, সেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। খুব মোটাদাগে এর উত্তর হলো, দেশে সুস্থ রাজনীতির চর্চা নেই। আর সুস্থ রাজনীতি না থাকলে তার নেতিবাচক প্রভাব তরুণদের ওপর পড়বেই।
মনোজ দে: তরুণদের জন্য কি পর্যাপ্ত ও সম্মানজনক কর্মসংস্থান তৈরি করা গেছে?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ষাট ও সত্তরের দশকে আমাদের কর্মসংস্থানের অভাব ও বেকারত্ব অনেক বড় সমস্যা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা লোকদেরও কাজ করার সুযোগ অনেক কম ছিল। আশির দশক থেকে দেশে এনজিও, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনের একটি বিকাশ হওয়ায় দেশের মধ্যেই ভালো আয়-রোজগারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সে ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এনজিওগুলোর কার্যক্রম কমে গেছে। বেকারত্ব বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের মধে৵ অনিশ্চয়তা বেড়েছে। এর সমাধান চিন্তা করা জরুরি। অর্থনীতিবিদেরা এ নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু তাঁদের বাইরেও সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতাদের এ বিষয়ে মতপ্রকাশ করা দরকার। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা সেটি করছেন না। আর অর্থনীতিবিদেরা শুধু অর্থনীতির বিষয়ে মত দেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মধ্যে আমাদের অর্থনীতি কীভাবে গড়ে উঠবে, সে সম্পর্কে তাঁরা পরিচ্ছন্ন কোনো বক্তব্য দিতে পারছেন না।
মনোজ দে: মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ছিল বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলা। কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছে, আমরা তত বেশি বৈষম্য প্রবল হতে দেখছি।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বৈষম্য এতটা কেন প্রবল হলো, এর কারণকার্য অনুসন্ধান করে বের করতে হবে। অনেকে সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এ নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু গবেষণামূলক অনুসন্ধানের মাধ্যমে সেটি বলতে হবে। বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কী করা দরকার, সেটি অর্থনীতিবিদদের খুব ভালো করে বলতে পারার কথা। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক সেটি তাঁরা বলছেন না। এটি তাঁদের চিন্তার দুর্বলতার একটি দিক। বিশ্বব্যাংকের নীতির বাইরে বেরিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে।
মনোজ দে: বিশ্বে মেরুকরণ বাড়ছে। বাংলাদেশের ওপর ভূরাজনীতির চাপটাও যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু ভূরাজনীতির প্রশ্নে আমরা জাতীয় ঐকমত্য তো দেখছি না।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: পৃথিবী এখন দুটি কেন্দ্রে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে চীন ও রাশিয়া। ভারতকেও এই কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়া বলা যায়। কেননা, তারা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের লাইনে যাচ্ছে না। অন্য কেন্দ্রে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার মতো দেশগুলো। এই মেরুকরণ এখন তীব্র হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে বাংলাদেশ যেন যুক্ত হয়। এর জন্য তারা চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। কিন্তু বাংলাদেশ সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—এই নীতি নিয়ে চলছে।অর্থনীতি ও সামরিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো শক্তিশালী। আমাদের দেখতে হবে, পশ্চিমা শক্তিগুলো কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে এবং চীন-রাশিয়া কীভাবে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। এ দুটি বিষয় বিবেচনা করে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কী হবে, সেটি কার্যকরভাবে স্থির করতে হবে। একসময় জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল। এর মূল কথা ছিল, আমরা সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষেও নয়, আমেরিকার পক্ষেও নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সঙ্গে গেছেন। মাওলানা ভাসানীও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের প্রবল সমর্থক ছিলেন। এখন ভূরাজনৈতিক যে রেষারেষি, তা থেকে বের হয়ে আসার জন্য আবার জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে। সেই উদ্যোগ যেকোনো দেশই নিতে পারে।
মনোজ দে: জোরালো না হলেও একটা সময়ে আমরা নাগরিক সমাজকে ভূমিকা রাখতে দেখেছি। নাগরিক সমাজের সেই পরিসর কেন এতটা সংকুচিত হয়ে গেল?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: বুদ্ধিজীবী বলে পত্রপত্রিকায় এখন আর কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। এখন বলা হয় ‘বিশিষ্টজন’। এই পরিবর্তনটা কেন হলো, সেটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কেন একসময় বুদ্ধিজীবী শব্দটা চালু হয়েছিল আর কেনই–বা সেটি বাদ দেওয়া হলো, এর কার্যকারণ খুঁজতে হবে। এই চিন্তা আমাদের দেশের কারও কাছ থেকে এসেছে বলে মনে করি না। এটি পশ্চিমা বড় শক্তিগুলোর দিক থেকে আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।১৯৮০–এর দশকে নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি আন্দোলনের ভূমিকা আমরা দেখেছি। কিন্তু ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকে তারা তেমন কোনো ভূমিকা পালন করতে পারেনি। নাগরিক কমিটি নামে দু–তিনবার কমিটি হয়েছে। এর মাধ্যমে এই সুশীল সমাজের রাজনীতি এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই রাজনীতি জনগণের মধে৵ তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ তাদের একেবারেই সহ্য করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন স্বাধীন চিন্তাশীলতা। প্রয়োজন চিন্তার জগতে তর্কবিতর্কের মধ্য দিয়ে সত্যের দিকে অগ্রসর হওয়া।
মনোজ দে: বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে কোনো আশা দেখছেন কি?
আবুল কাসেম ফজলুল হক: ৫২ বছর ধরে যে ধারাবাহিকতায় রাজনীতি চলে আসছে, সেই ধারায় আশাপ্রদ হওয়ার মতো কিছু দেখি না। এতগুলো বাইরের শক্তির চাপ আমাদের স্বাধীনতা–সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী। এখন তো আর আগের মতো সেনা দিয়ে দেশ দখল করতে হয় না। অর্থনৈতিক দিক থেকে, সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি জাতিকে দুর্বল করে পরাশক্তিগুলো নিজেদের কর্তৃত্বাধীন করে নেয়। বাংলাদেশকে যদি স্বাধীন–সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে যেতে হয়, তাহলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শ্রমিক-কৃষকের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে ধীরে ধীরে তাঁদের উন্নতির উপায় বের করতে হবে। এই ধারার রাজনীতিতে যেতে হলে সম্পূর্ণ নতুন রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে আসতে হবে। নিও লিবারেল ডেমোক্রেসি নামে লিবারেল হলেও কৃষক-শ্রমিকদের প্রতি এই রাজনীতি মোটেই উদার নয়। এটা মূলত উচ্চবিত্ত বা অভিজাত শ্রেণির গণতন্ত্র। বাংলাদেশে সেই গণতন্ত্রটাও নেই।বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুর্বলতা অনেক বেশি। সর্বজনীন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন দল, নতুন রাজনীতি, নতুন নেতা দরকার। রাজনীতিকে জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা, রাজনীতির ওপরে সবার ভালো-মন্দ নির্ভর করে। একটি বিষয় হলো, দলভিত্তিক আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সরকার—এটিই আমাদের জানামতে সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা। এই প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ যদি যেতে পারে, তাহলে নির্বাচন নিয়ে যে বিরোধ, সেটি অনেকটাই কমে যাবে।
মনোজ দে: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবুল কাসেম ফজলুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।