মাসুদ রানা: আমরা সিলেট ঘোরার সময় অনেক সময় বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে থাকি। কোথায় কিভাবে ঘুরবো, কি খাবো, কোথায় থাকবো! বিষয়গুলো সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে ঘুরতে গেলে একদিকে যেমন সময়ের অপচয় হয়, একই সাথে অতিরিক্তে অর্থেরও গচ্চা যায়। তাই খুব ভালভাবে জেনে যাওয়াই শ্রেয়। যেটার অভাব হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আমরা ঘোরার সময়। সিলেটের বিছানাকান্দি ও রাতারগুলে ঘোরার বাস্তব ও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য শেয়ার করব আপনাদের সাথে।
সিলেটে যাওয়ার আগে খুব ভালভাবে প্ল্যান করে নিবেন কোথায় কোথায় যাবেন। ঢাকা থেকে রওনা দিলে ট্রেনে যাওয়ায় শ্রেয়। তবে বাসে গেলে এনা পরিবহনে যাওয়াই ভাল হবে। সিলেটে পৌছানোর পর যত সকাল সকাল বের হওয়া যাবে ততই বেশি জায়গা কাভার করা সম্ভব হবে। আমাদের ইচ্ছা ছিল রাতারগুল-বিছানাকান্দি-পান্থুমাই পাহাড়-জাফলং-তামাবিল-লালাখাল হয়ে সিলেট ফেরার। ঘোরার জন্য সারাদিনের জন্য একটি সিএনজি ভাড়া নিয়ে নেওয়ায় শ্রেয় হবে। সারাদিনের জন্য ১৮০০-২০০০ টাকার মতো নিবে। তবে আপনি একদিনে সবকটি জায়গা ঘুরতে পারবেন না। আপনার ইচ্ছা থাকলেও সিএনজির গ্যাস আপনাকে সহযোগিতা করবে না। আপনি একদিনের রাতারগুল হয়ে বিছানাকান্দি-পান্থুমাই ঘুরতে পারবেন। অথবা রাতারগুল হয়ে জাফলং-তামাবিল-লালাখাল ঘুরতে পারবেন। তবে খুবই দ্রুত কাজ করতে হবে।
আমরা সিলেট থেকে প্রথমে রাতারগুল যাই। সকাল ১০টার দিকে আমরা রওনা হই। ২০ কিলোমিটার পথ যেতে ১ ঘণ্টার মতো সময় লাগে। রাতারগুলে যেখানে গাড়ি থামে সেখান থেকে নৌকা ঘাট ৫০০ মিটারের মতো হেটে যেতে হবে। ঘাট থেকে নৌকা ভাড়া করতে হবে। ভাড়া নির্ধারণের সময় আপনি চরম বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে পারেন। অন্য কারোর উপর নির্ভর না করে নিজে দরদাম করে নিবেন। এভারেজে প্রতিটি নৌকার ভাড়া পড়বে ১০০০ টাকার মতো। অবশ্য মাঝিরা দাবি করবে ১৭০০-১৮০০ টাকার মতো। আপনি যতটা কমিয়ে নিতে পারেন। সাথে যত বেশি লোক থাকবে আপনার পয়সা তত উশুল হবে। ৮ থেকে ১০ জনের টিম হলে ভাল হয়। আর যদি গ্রুপে ৩-৪ জন হয় তাহলে গাড়ি থেকে নামার জায়গা থেকেই আরেকটি গ্রুপকে সাথে নিতে পারেন তাহলে আপনার পয়সা সাশ্রয় হতে পারে।
সকাল সোয়া এগারোটার দিকে আমরা রাতারগুলে প্রবেশ করি। ১৩০০-১৪০০ টাকা খরচ করে রাতারগুলে সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো অতোটা সম্পদ নেই বলেই আমাদের মনে হয়েছে। পুরোটা জায়গা ঘুরে আসতে আপনার ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। ভিতরে ছয়তলার সমান উচু ওয়াচটাওয়ারে উঠে আপনি পুরো এলাকার সুন্দর একটা ভিউ উপভোগ করতে পারবেন। গাছগাছালির ভিতর দিকে নৌকা নিয়ে ঘোরার মজাটা একেবারে খারাপ না তবে আহামরি যে সুন্দর তা ও বলতে পারছি না। ঘোরার সময় উপরি হিসেবে নৌকায় বসে লাল চা খাওয়ার ফিলিংস নিতে পারেন। নৌকায় করে ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান, প্রতি কাপ ১০ টাকা নিবে।
কিছুটা হতাশা নিয়েই রাতারগুল দর্শন শেষ হয়। সোয়া বারোটায় আমরা রাতারগুল থেকে ফিরে আসি। যতোটা শুনে দেখতে যাই, তার ৩০ শতাংশ খুঁজে পাই বলেই মনে হলো। সেখান থেকে রওনা হই বিছানাকান্দির দিকে। ৪০ কিলোমিটারের পথ যেতে দেড় ঘণ্টার মতো সময় লাগে। সাড়ে ১২টায় রওনা দিয়ে ২টার দিকে আমরা হাদারপাড়ে পৌছি। তবে এখানে মজার বিষয়, আমরা কখনই কোন পোস্ট থেকে জানতে পারি নি যে হাদারপাড় থেকে বিছানাকান্দি প্রায় ৪ কি.মি. পথ আছে এবং সেটা কিভাবে যেতে হয় সে বিষয়ে কোন ক্লিয়ার কনসেপ্ট ছিল না। আমাদের সিএনজি ড্রাইভার আমাদের জানিয়েছিলেন, সেখান থেকে নৌকায় করে যেতে হবে। আমরা তার কথা বিশ্বাস করে ১০০০ টাকায় ট্রলার ভাড়া করে মূল পয়েন্টে যায়। সবার অবগতির জন্য জানাচ্ছি, আপনি চাইলেই এই ১০০০ টাকা বাঁচাতে পারবেন। হাদারপাড় থেকে সিএনজি বিছানাকান্দি মূল পয়েন্ট পর্যন্ত যেতে পারে। পথটা বন্ধুর হলেও সেখানে সিএনজি নিয়ে যেতে কোন সমস্যা হয় না। অথবা আপনি হেঁটেও যেতে পারেন। নৌ-ঘাট থেকে ঝর্ণার ওখানে হেটে যেতে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট লাগতে পারে।
আপনি চাইলে হাদারপাড় থেকে লাঞ্চ সেরে নিতে পারেন। খুব ভাল খাবারের ব্যবস্থা না থাকলেও তাৎক্ষণিক ক্ষুধা মিটিয়ে নেওয়ার জোগান রয়েছে। বিছানাকান্দিতে পৌছেও আমরা আশানুরূপ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হই। পর্যাপ্ত বৃষ্টির অভাবে আমরা ঝর্ণার ছিটোফাটাও দেখতে পাই নি। তবে অল্প অল্প পানির প্রবাহ বিদ্যমান ছিল। তাতেই পা ভিজিয়ে আমাদের বিছানাকান্দি দর্শন শেষ করি। সময় তখন সাড়ে চারটা। বিছানাকান্দি থেকেই আপনি পান্থুমাই পাহাড় যেতে পারেন। মোটরসাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়। মাথাপিছু গড়ে ৩০০ টাকা করে খরচ হবে। দূরত্ব ১০ কি.মি. যেতে সময় লাগবে আধা ঘণ্টার মতো। ঝর্ণার পাশেই ভারতীয় পণ্যের পশরা বসে। সাশ্রয়ী দামে ভারতীয় অরিজিনাল পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
আমাদের ইচ্ছা ছিল জাফলংও কাভার দেওয়া। সেজন্য পান্থুমাই না গিয়ে জাফলং যাওয়ার অভিপ্রায় নিয়ে হাদারপাড় ফিরে আসি। ড্রাইভারকে বলি জাফলংয়ে যাবো। তখন তিনিই জানালেন সিএনজিতে যে পরিমাণ গ্যাস আছে তাতে জাফলং যাওয়া গেলেও ফেরার উপায় থাকবে না। কি আর করা চরম হতাশা নিয়ে সিলেটের উদ্দেশ্যে ফিরে আসা।
একদিনের সিলেট ভ্রমণটা খুব বেশি ভাল গেলো তা বলা যাবে না। সিলেট ফিরে শাহ জালাল ও শাহ পরাণের মাজার দর্শন শেষে রাতের খাবারের কথা বিশেষ ভাবে না বললেই নয়। পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের নাম অনেকবার শুনেছিলাম। সকালে এখানে নাস্তা করে বের হলেও ওইভাবে টেস্ট নেওয়ার সুযোগ মেলে নি। সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করলাম রাতের খাবারে। এত কম টাকায় এত টেস্টি খাবার গলা পর্যন্ত গলাধকরণ করার সুযোগ আর কোথাও পাবেন না এটা শতভাগ নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। সিলেট গেলে পাঁচ ভাই রেস্টুরেন্টের খাবার মিস করে আসা খুবই বোকামি হবে। গলা পর্যন্ত খেয়ে সিলেট শহরটা ঘুরে হোটেলকক্ষে ঢুকে পড়ি। সময় স্বল্পতার কারণে জাফলং-তামাবিল-লালাখাল ঘোরা সম্ভব হয়নি। পরের দিন লক্ষ্য ছিল শ্রীমঙ্গল। সেখানে আমাদের আকাঙ্ক্ষার শতভাগ পূর্ণতা পায়। সেটা অন্য পোস্টে বলবো ইনশাআল্লাহ। পরিশেষে বলবো, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মণ্ডিত এসব জায়গা আমাদেরই। এগুলো পরিষ্কার রাখার দায়িত্বও আমাদের। তাই আমরা অহেতুক কোন খাবাবের উচ্ছ্বিস্ট বা মোড়ক যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ নষ্ট করা থেকে বিরত থাকবো।