রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট দানে বিরত থেকে বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতরে সমালোচনার পড়েছে।
রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার যে নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার কথা বলেছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
বিরোধীদল বিএনপিসহ বিভিন্ন দল আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের সমালোচনা করছে।
নিরপেক্ষ অবস্থানের কথা বলে সরকার রাশিয়ার আক্রমণের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কিনা – সেই প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি।
সরকার বলছে, নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ এই যুদ্ধকে সমর্থন করছে না। কিন্তু দেশের ভেতরে রাজনৈতিক উদ্দেশে বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের পর থেকেই বাংলাদেশ সরকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার কথা বলে আসছিল।
এরই মাঝে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের নিন্দা জানিয়ে আনা প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ।
এ নিয়ে দেশের ভেতরে সমালোচনার মুখে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, এ ধরনের ভূমিকার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার এখানে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে।
মোমেন এই নিরপেক্ষ অবস্থানের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলেননি। তবে এতে সমালোচনা আরও বেড়েছে। সরকার অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে বিভিন্ন দল।
সরকারের নিরপেক্ষ অবস্থানের সমালোচনা কেন?
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নিরপেক্ষতার কথা বলে আওয়ামী লীগ সরকার কার্যত রাশিয়ার আক্রমণের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কিনা – এই প্রশ্ন তাদের রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারের এই কৌশলের কারণে বাংলাদেশের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
এখানে একটা স্বাধীন জাতির ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে রাশিয়া। এখনে তাদের (বাংলাদেশ সরকার) স্পষ্ট একটা অবস্থান নিতে হবে।
তিনি উল্লেখ করেন, এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার অবস্থান না নিলে আসলে ঐ দেশের (ইউক্রেনে) মানুষের ওপর যে নির্যাতন হচ্ছে এবং মানুষ হত্যা হচ্ছে, এই হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করা হবে।
জাতিসংঘের যে উদ্যোগ, সে উদ্যোগকে সমর্থন করা উচিত ছিল।
বিএনপি মহাসচিব এই ইস্যুতে দেশের ভেতরে আলোচনা না করা বা ঐকমত্য সৃষ্টির উদ্যোগ না নেয়ার অভিযোগ তুলেছেন সরকারের বিরুদ্ধে।
তিনি বলেন, সরকার কারও সাথে পরামর্শ না করেই এমন অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেজন্য কোন ঐকমত্য হয়নি।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এমন অভিযোগও তোলেন যে এ অবস্থান নেয়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকার নিজেদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের মনোভাব কী হতে পারে – এ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা আলোচনা চলছে।
পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি করার জন্য বিতর্ক করা হচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধ নয়, শান্তি চায় এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পক্ষে। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নানা অভিযোগ বা সমালোচনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোন ব্যাখ্যা দেয়নি।
এদিকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সিনিয়র মন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেছেন, বিএনপিসহ বিভিন্ন দল পশ্চিমাদের সহানুভূতি পেতে রাজনৈতিক উদ্দেশে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করছে বলে তারা মনে করেন।
তারা (বিএনপি) রাজনৈতিক সুবিধা নেয়ার জন্য পশ্চিমা বিশ্বকে খুশি করার জন্য এই বিতর্ক করছে।
ড. রাজ্জাক আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মতবিরোধ বা মতানৈক্যের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত সেই স্বাধীনতার পর থেকে নিরপেক্ষ ভূমিকা অনুসরণ করে আসছি। এছাড়া বিভিন্ন দেশে গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শান্তি রক্ষায় কাজ করছে।
আওয়ামী লীগের নেতা ড: রাজ্জাক বলেন, এসব দিক বিবেচনা করে আমরা (বাংলাদেশ সরকার) এখন নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে চেয়েছি। তার অর্থ এই নয় যে, আমরা কোন দেশকে সমর্থন করছি ভা যুদ্ধকে সমর্থন করছি।
বক্তব্য স্পষ্ট নয়, সেজন্য নানা প্রশ্ন
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কী হবে-এনিয়ে দেশের অভ্যন্তরে আলোচনা না করার কারণে এই ইস্যুতে বিতর্ক বাড়ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
তারা বলেন, দেশের ভেতরে আলোচনার মাধ্যমে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য সৃষ্টি করে তারপর এই যুদ্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার তাদের অবস্থান নিলে ভাল হতো।
কিন্তু বিশ্লেষকরা এটাও বলেছেন যে, আফগানিস্তান বা ইরাক যুদ্ধসহ অতীতে কোন সরকারই কখনই আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক করেনি। সেজন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব নয় বলেও তারা মনে করেন।
তবে সাবেক একজন পররাষ্ট্র সচিব সচিব শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, অবস্থানের ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য স্পষ্ট না হওয়ায় তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে।
তিনি বলেন, নিরপেক্ষ আমরা কেন থাকলাম – সে ব্যাখ্যা অবশ্য সরকারই দেবে। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন যে, আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় এই অবস্থান নেয়া হয়েছে। কিন্তু এটা যদি স্পষ্ট করতেন যে, আমাদের জাতীয় স্বার্থটা কোথায় এবং ভোটদানে বিরত থেকে তা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে কিনা।
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, এ ধরনের সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিকভাবে আমাদের যে নৈতিক অবস্থান ছিল, সেখান থেকে আমরা কতটা সরে আসলাম – এ ব্যাপারেও ব্যাখ্যা স্পষ্ট হওয়া উচিত ছিল।
বাংলাদেশের অবস্থানের পেছনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি আছে কী?
তবে বাংলাদেশ সরকারের এমন অবস্থানের পেছনে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের রাজনীতির বিবেচনাও থাকতে পারে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন।
তিনি বলেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্থায়ন অব্যাহত রাখা বা অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ এই অবস্থান নেয়নি। বরং এই অঞ্চলের রাজনীীতির বিবেচনায় ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে মিল রেখে বাংলাদেশ অবস্থান নিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, আমাদের দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়া এবং পশ্চিমাদের সাথে যোগাযোগ কিন্তু একই ধারায় আছে। কোনটাকেই বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো চলতে পারবে না।
সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি বাংলাদেশ যে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, এটার পেছনে এই অঞ্চলের বিরাট রাজনৈতিক কারণ আছে মনে করেন অধ্যাপক ইয়াসমিন।
এদিকে, বিএনপির নেতারা মনে করছেন, যুদ্ধের সময় লম্বা হলে অবস্থান স্পষ্ট করার প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমাদের একটা চাপের মুখে পড়তে পারে। কিন্তু সরকার এবং আওয়ামী লীগ নেতারা তা মনে করেন না।