আব্দুল কুদ্দুস, কক্সবাজার: কক্সবাজার শহর থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর উখিয়ার হাকিমপাড়া (ক্যাম্প-১৪) আশ্রয়শিবির। এই শিবিরের এ ব্লকের একটি পাহাড়ি ঢালুতে তৈরি একটি ত্রিপলের ছাউনির ঘরে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে থাকেন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ শরীফ। ৯ দিন আগে তাঁর তিন বছর বয়সী মেয়ে মুনতাহারার স্ক্যাবিস (চুলকানি-চর্মরোগ) হয়েছে। মাথা ও দুই হাতের আঙুলে বড় বড় ঘা হয়ে আছে। চুলকানির যন্ত্রণায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে মেয়েটি।
বাবা মোহাম্মদ শরীফ বলেন, আড়াই মাস আগে তাঁর স্ত্রীর প্রথম রোগটি হয়। এরপর ছয় সদস্যের পরিবারে চারজনই আক্রান্ত হন এই চর্মরোগে। ওষুধ খেলে কিছুদিন ভালো থাকে, চুলকানি কমে যায়। কয়েক দিন পর আবার শুরু হয় চুলকানি। চুলকানির যন্ত্রণায় কারও ঘুমও হচ্ছে না।
সম্প্রতি আশ্রয়শিবিরের সি, ডি ও এফ ব্লক ঘুরে মোহাম্মদ ফোরকান, আয়েশা বিবি, নুরুল আমিনসহ অন্তত ৩০ জন রোহিঙ্গার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘরে একাধিক নারী-শিশু-কিশোর এ রোগে আক্রান্ত। আয়েশা বিবি ও নুরুল আমিন বলেন, এমন কোনো রোহিঙ্গা পরিবার নেই, যেখানে চর্মরোগী নেই। একজন থেকে আরেকজনে ছড়িয়ে পড়ছে এ রোগ। রোকেয়া বেগম নামের আরেক রোহিঙ্গা গৃহবধূ বলেন, ২০ থেকে ২৫ দিন আগে চর্মরোগে আক্রান্ত হয় তাঁর দেড় বছর বয়সী এক শিশু। মাথার তালুতে বড় বড় দাগ পড়েছে, ব্যথা ও যন্ত্রণায় সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে থাকে।
দ্রুত ছড়ানোর কারণ
আশ্রয়শিবিরে ১৪ ফুট দীর্ঘ ও ১০ প্রস্থের আয়তনের ছোট একটি ঘরে থাকে রোহিঙ্গা আয়াত উল্লাহর পরিবার। মধ্যখানে বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘরটি দুই কক্ষে ভাগ করা। সেখানে গাদাগাদি করে থাকেন পরিবারের আটজন সদস্য। একটি কক্ষে চলে রান্নাবান্নার কাজও। কক্ষের কোনায় বসানো গ্যাস সিলিন্ডার চুল্লি। অন্য পাশে টানানো কাপড়চোপড়। এমন পরিস্থিতিতে স্ক্যাবিসে আক্রান্ত পরিবারের সদস্যকে আলাদা রাখার সুযোগ নেই জানিয়ে আয়াত উল্লাহ বলেন, এক মাস ধরে তাঁর এক কিশোরী মেয়ে ও স্ত্রী স্ক্যাবিসে আক্রান্ত। অন্য সদস্যরা যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আক্রান্তদের দূরে রাখার জায়গা নেই।
বালুখালী ক্যাম্পের বাসিন্দা আবু হানিফ, মধুরছড়া ক্যাম্পের রমজান আলী বলেন, ত্রিপলের ছাউনির নিচে গাদাগাদি করে লাখ লাখ রোহিঙ্গার সময় কাটছে। ঘরে ঘরে চলছে পানির সংকট। পানি না থাকায় এবং স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার না করায় আশ্রয়শিবিরগুলোতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। শিবিরগুলোতে একটি শৌচাগার ও গোসলখানা ভাগাভাগি করে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১৫টি রোহিঙ্গা পরিবার। এক পরিবারে ৫ থেকে ১০ জন সদস্য। গোসলে তাঁরা একে অপরের সাবান ব্যবহার করেন। একটি নলকূপ থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করেন ৩০০ থেকে ৪০০ জন রোহিঙ্গা। এমন ঘেঁষাঘেঁষি করে বসবাসের ফলে এ রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গরমে রোগীদের বিস্তার বাড়ে, তখন যন্ত্রণাসীমা ছাড়িয়ে যায়।
হাকিমপাড়া আশ্রয়শিবিরের মেডিসিন সেন্স ফ্রন্টিয়ার্সের (এমএসএফ) একটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, চর্মরোগের চিকিৎসা নিতে এসেছেন শতাধিক রোহিঙ্গা। কারও হাতে, কারও পায়ে, কারও মাথা বা শরীরের বিভিন্ন স্থানে চর্মরোগের কারণে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। আক্রান্তদের বেশির ভাগ নারী-শিশু। হাসপাতালের চিকিৎসক এবং এমএসএফের মেডিকেল অ্যাকটিভিটি ম্যানেজার কামার উদ্দিন বলেন, আশ্রয়শিবিরে ছড়িয়ে পড়া এ রোগের নাম স্ক্যাবিস। স্ক্যাবিস একধরনের ছোঁয়াচে চর্মরোগ, সাধারণ লোক যাকে খোসপাঁচড়া বলে থাকেন। ত্বকে বাসা বাঁধে এমন একধরনের কীটের কারণে এটি হয়ে থাকে। এটি ত্বকের মধ্যে বাসা বাঁধে এবং ডিম পাড়ে।
এ রোগের চিকিৎসকেরা বলেন, সাধারণত বিছানা ভাগাভাগি ও একই কাপড় বিভিন্ন জন ব্যবহার করলে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। রোগের প্রধান উপসর্গ চুলকানি। চুলকানির কারণে ক্ষত হতে পারে এবং দ্রুত চিকিৎসা না পেলে কিডনি পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যাওয়ারও শঙ্কা থাকে।
৩ মাসে চিকিৎসা নিল ৪০ হাজার
এমএসএফের তথ্য বলছে, গত তিন মাসে (১৪ মার্চ থেকে ২০ জুন) এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস আক্রান্ত রোহিঙ্গা রোগী। এ ছাড়া অন্যান্য আশ্রয়শিবিরের হেলথ সেন্টারগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছে আরও ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোগী। এর মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি।
স্ক্যাবিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে বলে এমএসএফ থেকে জানানো হয়েছে। গত তিন বছরের মধ্যে চলতি সালে রোগের বিস্তার ছড়াচ্ছে বেশি। ২০১৯ এবং ২০২০ সালে গড়ে ৪৩ হাজার চর্মরোগীর চিকিৎসা দিয়েছে সংস্থাটি। ২০২১ সালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৩ হাজারে। চলতি বছরে এর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। গত তিন মাসে শুধু হাকিমপাড়া ও জামতলী হেলথ সেন্টারে ৩৬ হাজার স্ক্যাবিস রোগীর চিকিৎসা হয়েছে। এ ছাড়া ক্যাম্প ৮ ডব্লিউ এবং গোয়ালমারা হেলথ সেন্টারে ৪ হাজার ২০০ জন স্ক্যাবিস রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি কুতুপালং, বালুখালী, উচিপ্রাং আশ্রয়শিবিরেও স্ক্যাবিস রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছে এমএসএফ।
এমএসএফ চিকিৎসকেরা বলছেন, চলতি সালের শুরুতে স্ক্যাবিস রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একটি অস্থায়ী স্ক্যাবিস ট্রিটমেন্ট সেন্টার চালু হয়েছে। যেখানে আক্রান্তদের আলাদা করে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্ক্যাবিস পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। বর্তমানে ১০ দশমিক ২ শতাংশ রোহিঙ্গা স্ক্যাবিস রোগে আক্রান্ত বলে এক জরিপে জানা গেছে। স্ক্যাবিস ধীরে ধীরে মহামারি আকার ধারণ করতে যাচ্ছে বলেও ইঙ্গিত দেন চিকিৎসকেরা। বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে শিশু সাত লাখের বেশি।
আশ্রয়শিবিরে চর্মরোগ আগের তুলনায় বাড়ছে জানিয়ে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী চিকিৎসক আবু তোহা এম আর ভূঁইয়া বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেখানে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দেড় লাখ রোহিঙ্গার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরের পাশেই উখিয়া রাজাপালং ইউনিয়নের কুতুপালং গ্রাম। এ গ্রামে অন্তত ৩০ হাজার বাংলাদেশির বসতি। স্থানীয় রাজাপালং ইউপি সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের স্ক্যাবিস রোগ স্থানীয়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ছে। এতে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন। দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে তিনি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাসহ স্বাস্থ্য বিভাগে যোগাযোগ করছেন।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, স্ক্যাবিস মহামারি আকারে ছড়ানোর শঙ্কা নেই। এটি স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। রোগ নিয়ে স্থানীয়দেরও আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই। রোহিঙ্গারা ছোট্ট একটি ছাউনির নিচে ৫ থেকে ১০ জন গাদাগাদি করে থাকেন, ক্যাম্পের পরিবেশও ঘনবসতির—গিজগিজ অবস্থা। একজনের হলে দ্রুত অন্যজনে ছড়িয়ে পড়ে এ রোগ। চিকিৎসা নিলে ভালো হয়ে যায় এ রোগ।