মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ, মাদক ও চাঁদাবাজি নিয়ে রোহিঙ্গাদের দুটি পক্ষে বিরোধ; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিরোধী পক্ষ শিবিরে সক্রিয়
রাহীদ এজাজ, ঢাকা ও আবদুল কুদ্দুস, কক্সবাজার: মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যেই কক্সবাজারের উখিয়ার শিবিরে মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য নতুন করে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে। প্রত্যাবাসনের পক্ষে সোচ্চার এই রোহিঙ্গা নেতার হত্যাকাণ্ডের মাস না পেরোতেই গত শুক্রবার উখিয়ায় আশ্রয়শিবিরে সংঘবদ্ধ হামলা চালিয়ে খুন করা হয় ছয় রোহিঙ্গাকে। অভিযোগ উঠেছে, মহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের মতো ছয় খুনেও মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরসা (আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (তারা আল ইয়াকিন নামেও পরিচিত) জড়িত।
মুহিবুল্লাহ খুনে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করাসহ আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তা জোরদারের দাবির মুখে ছয় খুনের ঘটনা ঘটল। এমন পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি প্রত্যাবাসনবিরোধী আরসার নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার দিকটিও স্পষ্ট হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রকাশ্য রোহিঙ্গা শিবিরে আরসার উপস্থিতির বিষয়টি স্বীকার করা হয় না।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে উখিয়ার থাইনখালী (ক্যাম্প-১৮) আশ্রয়শিবিরের মসজিদ-মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে ছয় রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। নৃশংস এই হত্যাকাণ্ডে আরসা সমর্থক অন্তত ২৫০ জন অংশ নেয় বলে উখিয়ার বিভিন্ন শিবিরের রোহিঙ্গা মাঝিরা (নেতা) জানিয়েছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র বলছে, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে অন্তত ৩০০ মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আরসার সহযোগী উলামা কাউন্সিল ও ইসলামি মাহাস নামে পরিচিত রোহিঙ্গাদের আরেকটি সংগঠনের প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিভিন্ন শিবিরের মাঝিরা বলছেন, ইসলামি মাহাস আরসার অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করার পাশাপাশি প্রত্যাবাসনের পক্ষে রোহিঙ্গাদের সংগঠিত করে আসছে। শিবিরে ইয়াবার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজিসহ আধিপত্য বিস্তার নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ রয়েছে।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহ হত্যার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে এখন পর্যন্ত শতাধিক সন্ত্রাসী ধরা পড়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ৫২টি অস্ত্র। গ্রেপ্তার হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৫ জন আরসার সক্রিয় সদস্য বলে রোহিঙ্গা মাঝিরা জানান। তাঁরা বলছেন, মুহিবুল্লাহ হত্যার পর নিজেদের শক্তির জানান দিতে খুনখারাবির ঘটনা ঘটিয়ে আলোচনায় আসতে চাইছে আরসা।
রোহিঙ্গা শিবিরে সাম্প্রতিক অস্থিরতার বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোয় জড়িত দুষ্কৃতকারীরা রোহিঙ্গাদেরই একটি অংশ। নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ড ঘিরে একে অন্যের ওপর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নানা রকম দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে।
মুহিবুল্লাহ হত্যার এক মাস না যেতেই ছয় রোহিঙ্গা খুনের বিষয়ে জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা কখনো চাইব না আমাদের ভূখণ্ডে অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটুক। সম্প্রতি মুহিবুল্লাহ হত্যার ঘটনা দেশে-বিদেশে যথেষ্ট আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছে। ওই হত্যাকাণ্ডের পরপরই আমরা সেখানে নিরাপত্তা যথেষ্ট জোরদার করেছি। মুহিবুল্লাহ হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের আটকও করা হয়েছে। এর মধ্যে দুঃখজনকভাবে আরেকটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। এটা আমাদের জন্য অস্বস্তির।’
স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সভাপতিত্বে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক হয়। সেখানে শিবিরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নকে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়ে জনবল বাড়ানোসহ সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকের পর গত শনিবার কক্সবাজারের স্থানীয় প্রশাসনকে সমন্বয় জোরদারের পাশাপাশি কঠোরভাবে শিবিরের আইনশৃঙ্খলা জোরদারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
হামলার নেপথ্যে কারণগুলো
শিবিরের অভ্যন্তরের ৩০০ মাদ্রাসার মধ্যে ১৭০টির বেশির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে আরসার সহযোগী উলামা কাউন্সিলের কাছে। বাকিগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে ইসলামি মাহাস। তবে ইসলামি মাহাসের কাছ থেকে এসব মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা চালাচ্ছে উলামা কাউন্সিল। এ জন্য মাহাস নেতাদের একাধিকবার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা নেতাদের মতে, গত শুক্রবারের হামলার প্রধান কারণ মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব।
উখিয়ার শিবিরের একটি সূত্র বলছে, উখিয়ার বালুখালীর ক্যাম্প-১৩-এর ‘সি’ ব্লকে থাকেন ইসলামি মাহাসের নেতা মৌলভি সেলিম উল্লাহ। একসময় তিনি আরসার কমান্ডার ছিলেন। আরসার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনবিরোধী তৎপরতা, শিবিরে চাঁদাবাজি, মাদক ও সোনা চোরাচালান, অপহরণ, ধর্ষণ, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ায় তিনি গোষ্ঠীটি ছেড়ে দেন। পরে তিনি গড়ে তোলেন ইসলামি মাহাস। মৌলভি সেলিমের নেতৃত্বে ইসলামি মাহাস নেতারা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত গঠন করতেন। বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও নামাজের খুতবায় আরসার অপতৎপরতা নিয়ে সতর্ক করতেন। এতে ক্ষুব্ধ হয় আরসা।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডে অন্তত ১৫ জন আরসার সক্রিয় সদস্য ধরা পড়েছে। এতে ইসলামি মাহাসের ওপর আরও ক্ষুব্ধ হয় আরসা। তাদের ধারণা, মাহাসের নেতারা পুলিশকে আরসার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেন। তবে পুলিশ বরাবরই বলে আসছে, ক্যাম্পে আরসা বা আল ইয়াকিন নামে কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব নেই। তবে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা আরসা ও আল ইয়াকিনের নাম ব্যবহার করে অপকর্ম চালায়।
রোহিঙ্গা নেতারা বলেন, বিদেশ থেকে ক্যাম্পের মাদ্রাসা-মসজিদের নামে বিভিন্ন মাধ্যমে টাকা আসে। এর ভাগাভাগি নিয়েও দুই সংগঠনের মধ্যে বিরোধ আছে। এ ছাড়া শিবিরে ক্যাম্পে ইয়াবা ও সোনার ব্যবসায় ভাগ বসিয়েছে আরসা। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের অন্তত ১৪ হাজার দোকানপাট আছে; সেখান থেকে চাঁদা তোলে আরসা।
অভিযান অব্যাহত
ছয় রোহিঙ্গা হত্যায় করা মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে উখিয়ার বালুখালী শিবিরের (ক্যাম্প-১৮) রোহিঙ্গা মৌলভি আকিজ ওরফে মৌলভি অলিকে। তিনি আরসার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত। শুক্রবার ভোরে চালানো হামলার একটি অংশের তিনি নেতৃত্ব দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২২-২৫ জনের একটি দল নিয়ে মসজিদে ঢুকে গুলি চালান মৌলভি অলি, এমন অভিযোগ করছেন কয়েকজন রোহিঙ্গা মাঝি।
নাম না প্রকাশের শর্তে উখিয়ার শিবিরের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ঘটনার পরপর মৌলভি অলি, নুরুল কলিম, মৌলভি দিলদার হোসেনসহ ২০-২৫ জন সীমান্ত দিয়ে নাফ নদী পেরিয়ে মিয়ানমারের নো ম্যান্স ল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছেন।
বর্তমানে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস। রাখাইন থেকে ১৯৯১ সালে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালংয়ে এবং টেকনাফের হ্নীলায় দুটি করে মোট চারটি শিবির ছিল। এরপর ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ঢলের পর টেকনাফে আরও ৬টি এবং উখিয়ায় ২৪টি আশ্রয় শিবির হয়।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গা শিবিরে যে আরসার উপস্থিতি আছে, এটা তো সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডে স্পষ্ট। খুন করে তারা যখন জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেয়, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না এরা রোহিঙ্গাদের পক্ষের শক্তি নয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সমর্থক। এবারের ঘটনায় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে শিবিরে রাতের বেলার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কাজটা যত কঠিন হোক না কেন, শিবিরের ২৪ ঘণ্টার নিরাপত্তা বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর আরসার সঙ্গে স্থানীয় সন্ত্রাসীরাও জড়িয়ে পড়েছে। এই চক্র ভাঙা না গেলে কক্সবাজারের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও খারাপ হবে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি।