আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনীতে বর্ণবাদ, নারীবিদ্বেষ, বৈষম্য, ধর্ষণ ও সমকামী-বিদ্বেষের মতো নানা গুরুতর বিষয়ের বিশদ বিবরণ উঠে এসেছে সরকারি একটি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের ফলাফল অনুযায়ী, পুলিশ বাহিনী ‘প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ’ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে না পারায় লন্ডনের পুলিশের প্রতি জনসাধারণের আস্থা অর্ধেক কমে গেছে। এছাড়া লন্ডনের মেট্রোপলিটন এলাকাজুড়ে পুলিশের ‘গুরুতর ব্যর্থতা’ও খুঁজে পাওয়া গেছে। এ কারণে বাহিনীতে ‘মৌলিক সংস্কার’ প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা মেট বাহিনীতে ব্যাপক হারে বুলিং, বৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক সমকামিতাবিরোধী চিšতাধারা, নারীবিদ্বেষ ও বর্ণবাদের নজির পেয়েছি এবং নারী ও শিশুদের সুরক্ষা ও সহায়তা পাওয়ার অধিকার থাকলেও, পুলিশের কাছ থেকে তারা তা পায় না বলে জেনেছি। বাহিনীর নারী সদস্যরা অশুভ পরিণাম ও তাদের ক্যারিয়ারের ক্ষতি হওয়ার ভয়ে মন খুলে কথা বলতে পারছেন না। অনেক সময় তাদের উদ্দেশ্যে ‘হালকা আলাপচারিতার’ তকমা দিয়ে বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলা হয়। একজন মুসলিম কর্মকর্তার বুট জুতার ভেতর ‘কৌতুক’ হিসেবে শুকরের মাংস রেখে দেওয়া হয়েছিল এবং একজন শিখ কর্মকর্তাকে ধর্মীয় কারণে রাখা দাঁড়ি কেটে ফেলতে বাধ্য করা হয়েছিলো। কারণ তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে এ ধরনের অনুশাসনকে ‘হাস্যকর’ বলে মনে হয়েছিল। প্রতিবেদনে পুলিশ কর্মকর্তাদের এসব আচরণের আরও কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে যে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের সংস্কারে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে তাদের নিজেদের অন্যায় ও ভুলের মাত্রা স্বীকার ও অনুধাবন না করতে পারা। মঙ্গলবার (২১ মার্চ) ৩৬০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ২০২১ সালের মার্চে সারাহ এভারার্ড নামের এক তরুণীকে অপহরণের পর ধর্ষণ, এরপর হত্যা করেন লন্ডনের পুলিশ কর্মকর্তা ওয়েন কুজেনস। ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির সার্বিক পর্যালোচনা (রিভিউ) করতে গিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন প্রধান ক্রেসিডা ডিক এই পর্যালোচনার আয়োজন করেন। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের সদস্য লুইস কেসি এ পর্যালোচনার নেতৃত্ব দেন।
লুইস কেসি প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় উল্লেখ করেছেন, লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ এখনও ‘প্রাতিষ্ঠানিক বর্ণবাদ’ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেনি। মাত্র ৫০ শতাংশ জনসাধারণ ব্রিটিশ রাজধানীতে কার্যকরভাবে জনগণকে রক্ষায় পুলিশের ওপর আস্থা প্রকাশ করেছেন। বাকি ৫০ শতাংশ লোক পুলিশের ওপর এ বিষয়ে আস্থা রাখছেন না। পর্যালোচনা করতে গিয়ে আমরা পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক উৎপীড়ন, বৈষম্য, প্রাতিষ্ঠানিক সমকামীতা, নারীবিদ্বেষ, বর্ণবাদ এবং অন্যান্য অগ্রহণযোগ্য আচরণ খুঁজে পেয়েছি। নারী ও শিশুরা তাদের প্রাপ্য সুরক্ষা এবং সমর্থন পাচ্ছে না বলে জেনেছি।
এ প্রতিবেদন প্রকাশের পর লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ বাহিনীর কমিশনার ও যুক্তরাজ্যের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা মার্ক রাউলি সাংবাদিকদের বলেছেন, এ প্রতিবেদনে অনেক ধরনের আবেগের সৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি রাগ, হতাশা ও লজ্জার অনুভূতি হচ্ছে। আমরা লন্ডনবাসীদের ও যারা ফ্রন্টলাইনে আছেন, তাদেরকে দেওয়া অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছি। আমরা লন্ডনবাসীকে হতাশ করেছি। আমি খুবই দুঃখিত। তিনি আরও বলেন, পুলিশ বাহিনীর পেশাদার মান বাড়ানো হয়েছে। আমরা দ্রুত হারে কর্মকর্তাদের বরখা¯ত করছি। এখনও হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মতো অপরাধে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা বাহিনীতে কর্মরত আছেন কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এসবের সমাধান প্রয়োজন।
লন্ডনের মেয়র সাদিক খান বলেছেন, এটি মেট্রোপলিটন পুলিশের ২০০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে কালো দিনগুলোর একটি। পুলিশের প্রতি আস্থা না থাকলে জনগণ কোনো অপরাধের অভিযোগ জানাতে এগিয়ে আসবে না। আমাদের সকলের স্বার্থে পুলিশের সেবার মূল ও শাখা রদবদল নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন, পুলিশের ওপর মানুষের আস্থা ও ভরসা ‘মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্র¯ত’ হয়েছে। এখন আমাদের করণীয় হলো, এ সকল গুরুতর বিষয়ের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করা। আমরা জনগণের আস্থা ফিরে পেতে পারি। আমি জানি পুলিশ কমিশনার এটি করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
পরামর্শ হিসেবে ৩৬৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের সংস্কারের জন্য অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে শক্তিশালী নেতৃত্ব, নারী সুরক্ষা সেবা ও শিশুদের বিষয়ে নতুন কৌশল গ্রহণ করা প্রয়োজন।
উল্লেখ্য লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ সংক্ষেপে ‘মেট’ নামে পরিচিত এ সংস্থায় ৪৩ হাজারেরও বেশি কর্মী আছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রেভারম্যান লন্ডন পুলিশে তীব্র সমালোচনা করে পার্লামেন্টে বলেছেন, এ সংস্থার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলো থেকে উত্তরণে অনেক বছর লেগে যেতে পারে।