হাসনাত আরিয়ান খান: বহুল আলোচিত ও বহুল প্রতিক্ষিত লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা ও নির্বাচন গতকাল উৎসব মুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। বস্তুত দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভা বলা হলেও তিন বছর পর এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। করোনা মাহামারি’র কারণে গত বছর এটি করা সম্ভব না হওয়ায় কমিটির মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়েছিলো এবং বিশেষ সাধারণ সভার মাধ্যমে সেটা অনুমোদন করা হয়েছিলো। বিলেতের বাংলা মিডিয়ার প্রতিনিধিত্বশীল সবচেয়ে বড় সংগঠন লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব নির্বাচন ২০২২ উপলক্ষে নির্বাচনের শেষ দিন অর্থাৎ গত ২৯শে জানুয়ারি ‘দ্যা গ্রেইট বেঙ্গল টুডে‘ এর পক্ষ থেকে আমরা একটা জরিপ করেছিলাম। সেই জরিপ অনুযায়ী দু‘একটা পদে ব্যতিক্রম ছাড়া নির্বাচনের ফলাফল যা হবার তাই হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের জরিপের সাথে নির্বাচনের ফলাফল প্রায় মিলে গেছে। শনিবার জরিপ কাজ শেষে ঘুমোতে গিয়ে দেখি অনেক রাত হয়ে গেছে। রবিবার নির্বাচনের দিন ঘুম থেকে উঠে দেখি প্রায় দুপুর হয়ে গেছে। নামাজ পড়ে নাস্তা করে তড়িঘড়ি ট্রেনে উঠে দেখি আমার মত আরও অনেকেই লেইট করেছেন। হান্নান ভাই, হোসেন ভাই, সুভাস দা, আহমেদ ভাই, জামাল ভাই, রহমান ভাই ও বাবুল ভাই নতুন কয়েকজন সদস্যের সাথে ট্রেনের ফাঁকা কামরায় বসে আছেন। উনারা আমার আগের স্টেশন থেকে উঠেছেন। আমি পূর্ব পরিচিতদের সাথে কুশল বিনিময় করে নতুন সদস্যগণের সাথে পরিচিত হলাম। প্রথম পরিচয়ের পর বিদেশিরা বলে, ‘নাইস মিটিং ইউ।‘ আমরা বাংলাদেশিরা বলি, ‘আপনার দ্যাশের বাড়ি কই?’ সবচেয়ে ভাইটাল প্রশ্ন হলো, ‘আপনার মেট্রিক কোন সাল?’ একবার একজন প্রায় আধা ঘন্টা আমার সম্বন্ধে যত প্রশ্ন করা যায় সবগুলো করে, উত্তর পেয়ে, বিদায় নেওয়ার সময় উঠে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘তাহলে আপনার পরিচয়টা দিলেন না!’ কারণ প্রথম প্রশ্নের উত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার দ্যাশের বাড়ি ‘বাংলাদেশ’। তিনি আমার উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তিনি আরও স্পেসিফিক জানতে চান। এই স্পেসিফিক উত্তর আমি কাউকেই দিইনা, কারণ বিদেশে আমি ঢাকা, চট্রগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা বা ময়মনসিংহের মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে চাইনা এবং সেভাবে কারো সাথে মিশতে চাই না। আমার ভেতর কোন আঞ্চলিকতা নেই। আঞ্চলিক পরিচয় নিয়ে আমি চলতে পছন্দ করি না। দেশের বাইরের বাঙালি এবং বাংলাদেশিদের সাথে আমি একজন বাঙালি এবং বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হতে চাই। এই পরিচয় নিয়েই আমি সবার সাথে সমানভাবে মিশতে চাই। সবাইকে ভালোবাসতে চাই এবং সবার ভালোবাসা পেতে চাই। এই কারণে দেশের বাইরের আঞ্চলিক সমিতিগুলোর আমি নিন্দা জানাই, একই সাথে আঞ্চলিক চ্যারিটি সংগঠনগুলোকে আমি সব সময় স্বাগত জানাই। বাংলাদেশের বাইরে আমার আলাদা আর কোন দ্যাশের বাড়ি নাই। এই প্রশ্ন আমাকে করে লাভ নাই। এটা একটা দুরারোগ্য ব্যাধি। ‘দ্যাশের বাড়ি‘ না জানলে কোনমতেই ‘পরিচয়‘ কমপ্লিট হয় না উনাদের। আমি একজন বাঙালি এবং বাংলাদেশি এই পরিচিয়টুকু উনাদের জন্য যথেষ্ট না। যাই হোক, সাংবাদিক বলেই হয়তো ট্রেনে তাঁরা এই ধরনের কোন প্রশ্ন আমাকে করলেন না। ফলে খুব সহজেই সবার সাথে আমার খুব জমে গেলো। নতুনদের মাঝে আবার দুইজন কবি। গত বইমেলায় একটা কবিতার বই বের করে একজনের ঘরে ঘটি বাটি যা ছিল, সব বিক্রি হয়ে গেছে। আরেকজন এবারের বই মেলায় একটা কবিতার বই বের করেছেন। প্রথমজনের কাছে ঘরের ঘটি বাটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার কথা শোনে তিনি কিছুটা চিন্তিত। চিন্তিত গলায় আমাকে বলছেন, লেখক বা কবি বই মেলাতে উপস্থিত না থাকলে নাকি বই বিক্রি কম হয়? আমি বললাম, ‘তাজ্জব ব্যাপার! শিব্রাম চক্কোত্তির ভাষায় বলতে হয়- দুধ কেনার জন্য গাভির চেহারা দেখতে হবে কেন?‘ তিনি আমার কথায় মজা পেলেন এবং কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। অন্যেরা হো হো হাসলেন। ট্রেনে যেতে যেতে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নির্বাচন নিয়ে হুলুস্থুল দেখে একবার মনে হলো, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে ঢুকে পড়েছি। যে কোনো নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের বাঙালিদের আগ্রহ ব্যাপক। এটা অবশ্যই ভালো লাগার। লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অনুষ্ঠান মঞ্চের ছবি দেখে সবাই মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেন। কেউ ভালো হয়েছে বললেন, কেউ সুন্দর হয়েছে বললেন আবার কেউ বাজে হয়েছে বললেন। কেউ আবার ফ্যাকাশে লাগছে, অক্ষরগুলো পড়া যাচ্ছেনা বললেন। একজন আবার স্টেইজ ডিজাইনারের নাম জানতে চাইলেন, ডিজাইনারকে তিনি নাকি স্টেইজ ডিজাইন শেখাবেন! রহমান ভাই বললেন, ‘খান ভাই আপনাকে নিয়ে একটা মিথ আছে। মিথটা হলো- আপনি ইমপ্রেসন ইভেন্ট ভেন্যুর গেইটে পা দিয়েই যে প্রার্থীদের মুখ হাসিখুশি দেখেন তারাই নাকি নির্বাচনে জিতেন। গত দুইবারের নির্বাচনে আপনি যে তিনজন প্রার্থীকে ইমপ্রেসন ইভেন্ট ভেন্যুর গেইটে পা দিয়েই দেখেছেন তারা তিনজনই নাকি জিতেছেন! কিন্তু এবারে আপনি একজন অপয়ার সাথে যাচ্ছেন। হোসেন ভাই হচ্ছেন অপয়া। হোসেন ভাই যাকে প্রথম দেখেন তিনি নাকি হারেন।‘ হোসেন ভাই রহমান ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপনি নিজেই অপয়া এটা না বলে আমার উপর চাপিয়ে দিলেন! একটা গল্প শোনেন- শিকারে বেরিয়ে পথে প্রথমেই নাসিরুদ্দিনের সামনে পড়ে রাজামশাই খেপে উঠলেন। লোকটা অপয়া। আজ আমার শিকার পণ্ড। ওকে চাবকে হটিয়ে দাও। রাজার হুকুম তামিল হলো। কিন্তু শিকার হলো জবরদস্ত। রাজা নাসিরুদ্দিনকে ডেকে পাঠালেন। কসুর হয়ে গেছে নাসিরুদ্দিন। আমি ভেবেছিলাম তুমি অপয়া। এখন দেখছি তা নয়। নাসিরুদ্দিন তিন হাত লাফিয়ে উঠলেন। আপনি ভেবেছিলেন আমি অপয়া? আমায় দেখে আপনি ছাব্বিশটা হরিণ মারলেন আর আপনাকে দেখে আমি বিশ ঘা চাবুক খেলাম। অপয়া যে কে, সেটা বুঝতে পারলেন না?’ হোসেন ভাইয়ের গল্প শোনে সবাই মজা পেলেন এবং মুচকি হাসলেন। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় ট্রেনের পুরো কামরা ফাঁকা। আমরা ছাড়া কামরায় আর কোন যাত্রী উঠা বা নামার লক্ষণ নেই। আমরা লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব সদস্যরা ভোটে দিতে যাচ্ছি সবাই। সবার মাঝে নির্বাচনী আমেজ দেখে সুভাস দা এবার নির্বাচনী কৌতুক বলতে শুরু করলেন:- শামীম সাহেব ভোটে দাঁড়িয়েছেন। গণনা শেষে দেখা গেল, তিনি তিনটি ভোট পেয়েছেন। বাড়ি ফিরে দেখেন, বউ ঝাঁটা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন! শামীম সাহেবকে দেখেই চিৎকার জুড়ে দিলেন, ‘মিনসের ঘরে মিনসে! তুমি একটা ভোট দিছো, আমি একটা দিছি। আরেকটা দিল কে?’ কৌতুক শোনে সবাই হাসতে শুরু করলেন। সবার হাসি শেষ না হতেই তিনি আরেকটা কৌতুক বলতে শুরু করলেন- নির্বাচনে রহিম দাঁড়িয়েছেন আনারস মার্কায়, আর জব্বারের মার্কা ছাতা। একদিন রাস্তায় কথা হচ্ছিল তাঁদের। রহিম বললো: বুঝলা জব্বার, ভোটে কিন্তু আমিই পাস করব। কেন জানো? আমার দলের কর্মীরা যখন রিকশায়ও ওঠে, রিকশাওয়ালার খোঁজ খবর নেয়। রিকশা থেকে নামার সময় তাঁকে ১০ টাকা বকশিস দেয়। আর বলে, ‘ভাই, ভোটটা কিন্তু আনারস মার্কায়ই দিয়েন।’জব্বার বললো: না রে রহিম, ভোটে আমিই জিতব। কারণ, আমার লোকেরা রিকশায় উঠেই রিকশাওয়ালাকে গালিগালাজ করে। রিকশা থেকে নামার সময় ১০ টাকা কম দেয়। আর বলে, ‘ওই ব্যাটা, ভোটটা কিন্তু আনারস মার্কায় দিবি।’এই কৌতুক শেষ হতেই ওয়ান মোর ওয়ান মোর রব ওঠায় তিনি আরেকটা কৌতুক শোনালেন- আফ্রিকান ব্যবসায়ী ফার্নান্দেজ। নিজ গ্রামে নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু বেচারা ছোট থেকে বড় হয়েছেন শহরে। গ্রামে কখনো যাননি, এমনকি নিজ গ্রামের ভাষাও ঠিকঠাক জানেন না। তাতে কী? ঢাকঢোল পিটিয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। একদিন গ্রামের মঞ্চে তাঁকে বক্তৃতা করতে দেখা গেল, ‘আমি নির্বাচিত হলে আপনাদের সব দুঃখ-দুর্দশা দূর করব।’গ্রামের লোকজন সমস্বরে বলে উঠল, ‘হোয়া হোয়া’! ফার্নান্দেজ আরও বললেন, ‘গ্রামের মাটির সব ঘর ভেঙে পাকা ঘর তৈরি করে দেব।’আবারও সবাই বলে উঠল, ‘হোয়া হোয়া’। ইনিয়ে-বিনিয়ে আরও বহু প্রতিশ্রুতিই দিলেন তিনি। প্রতিটি বক্তব্য শেষেই গ্রামের লোকের একই কথা, ‘হোয়া হোয়া’। ফার্নান্দেজ তো গ্রামের ভাষা বোঝেন না। তিনি ধরেই নিলেন, সবাই নিশ্চয়ই তাঁকে সমর্থন জানাচ্ছেন। খুশি মনে তিনি বক্তৃতা শেষ করলেন। ফেরার পথে কাঁদামাটি পেরিয়ে যাচ্ছিলেন ফার্নান্দেজ, সঙ্গে এক গাইড। পথিমধ্যে চোঁখে পড়ল একগাদা গরুর গোবর। গোবরের গন্ধে ওয়াক থু করে নাক কুঁচকে ইশারায় ফার্নান্দেজ জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কী?’ গাইডের উত্তর দিলেন, ‘হোয়া হোয়া’! কৌতুক শেষ হতেই আবারও ওয়ান মোর মোর রব ওঠায় সুভাস দা এবার পূর্ব লণ্ডনের স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে কৌতুক শোনালেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে পূর্ব লণ্ডনের টয়েনবি হলে সেই নেতা স্টেইজে উঠেছেন বক্তৃতা দিতে। রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে উনার পরিস্কার কোন ধারণা নাই। কিন্তু স্টেইজে ডাকা হয়েছে, মাইক পাওয়া গেছে, উনি সুযোগ ছাড়লেন না। এরপর উনি ভাষণ দিলেন- “রবীন্দনাথ টাখুর, বড়ই বালা খবি আসলায়, তার খবিতা ফড়িয়া ছুককে ফানি আসি যায়, ওই খবিতাটা- এই খানে তুর দাদির খবর ডালিম গাছর নিসে, আহ হা খান্দে যারে যার! তাইন বড়ই ফোরহেজগার আসলায়, খি সোন্দর দাঁড়ি আছিলো, মখ্খা শরিফও গিয়া হজ খোর্সিন, ফাস ওয়াখিত নামাজ ফোরতায় রবীন্দনাথ টাখুর! তাইন আবার আমরার তাহের উদ্দিন টাখুরের ফুফার ঘরের ফুয়া!” সবাই হাসতে হাসতে ট্রেনের ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। সুভাস দা‘র কৌতুক শেষ হতেই জামাল ভাই মুখের ভেতরে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে খুব জোরে শিষ কাটলেন। এবার বাবুল ভাই কৌতুক বলতে শুরু করলেন-‘ ভোট চাইতে ভোটারের কাছে গেছেন এক নেতা। নেতা বলছেন- চাচা, কথা দেন, ভোটটা আমারেই দিবেন। ভোটার বলছেন- কিন্তু ভাতিজা, আমি যে আরেকজনকে ভোট দেব বলে কথা দিয়ে ফেলছি। নেতা বলছেন- তাতে কী? কথা দিলেই যে কথা রাখতে হবে, তা তো নয়। ভোটার বলছেন- তাইলে ভাতিজা তোমারেও কথা দিলাম।‘ হাসতে হাসতে সবার পেটে খিল ধরার অবস্থা। এই অবস্থায় হান্নান ভাই কলামিস্ট ডা: জাকি রেজোয়ানা আপাকে নিয়ে একটা কৌতুক বলতে শুরু করলেন- ডা: জাকি রেজোয়ানা আপার সার্জারিতে গেছেন আপার পূর্ব পরিচিত একজন রোগী। রোগী আপাকে জিজ্ঞাসা করছেন, ওমিক্রন ভাইরাসের বেশি মিল আছে কোন কোন সিম্পটমগুলোর সাথে? ডা: জাকি আপা বলেছেন, ওমিক্রন ভাইরাসের সিম্পটমগুলোর সাথে সবচেয়ে মিল আছে আপনার স্ত্রী যখন আপনার মোবাইল হাতে নিয়ে চেক করে তার সাথে। যেমন: নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হওয়া, তীব্র ঘাম ছোটা, শরীরে দূর্বলতা শুরু হওয়া, মাথা ঘোরা আর যখন মেসেজ ঘাটতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে- তো এই মর্জিনা কে, তখন শুকনো কাশি খকখক করে শুরু হওয়া। হাসতে হাসতে সবাই ডা: জাকি রেজোয়ানা আপার সেন্স অব হিউমারের প্রশংসা করলেন। উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে নতুন এক ভাই এডাল্ট কৌতুক বলতে শুরু করলেন। উইটি জোকস যেমন ভালো, এডাল্ট জোকসও ভালো। তবে সব কিছু সব জায়গায় বলা যায় না, বলা ঠিক না। সেটা আমাদের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের জন্যেও প্রযোজ্য না। জনগণ শোনে হাসলেই হলো না, প্রেসিডেন্ট যখন স্ত্রীর ব্যাপারে বলেন জিনিস তেমন ভালো না বা রোকেয়া হলের সামনে কত টাংকি মারছি কিংবা প্রিয়াংকা চোপড়ার সঙ্গে দেখা করতে চাইছি, সেটা মানায় না। কৌতুক চলতে চলতে ট্রেন ইমপ্রেসন ইভেন্ট ভেন্যুর নিকটতম স্টেশন ওয়েস্ট হ্যাম এ চলে এসেছে। আমরা পাতাল রেল থেকে নেমে স্টেশন থেকে সবাই বের হয়ে ভেন্যুর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। যাত্রা পথে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাকিরা সবাই আমার থেকে একটু দুরত্ব বজায় রেখে আস্তে আস্তে হাঁটছেন। আমি জিজ্ঞাসা করতেই রহমান ভাই বললেন, ‘আপনি আগে যান, আমরা দেখি গেইটে আপনি কাদের দেখা পান। আপনাকে নিয়ে এই মিথগুলা আসলেই সত্য নাকি মিথ্যা আজকে নির্বাচন শেষে প্রমাণ হবে।‘ আমি বললাম, ‘এগুলো কাকতালীয় ব্যাপার। অতীতে হয়েছে বলে বার বার এমন হবে এরকম কোন কথা নেই। চলেন সবাই এক সাথে যাই।‘ কিন্তু তারা তাদের মতে অটল থাকলেন। অবশেষে আমি একাই ভেন্যুর দিকে এগিয়ে গেলাম। গেইটের কাছাকাছি যেতেই প্রথমে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদপ্রার্থী সাঈম ভাইকে দেখলাম। গেইটের ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি হাসিমুখে এগিয়ে এসে কোলাকুলি করলেন। তারপর নির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী সারওয়ার ভাইকে দেখলাম। তিনিও এগিয়ে এসে হাসিমুখে কোলাকুলি করলেন। সারওয়ার ভাইয়ের সাথে কোলাকুলি শেষ করতেই দেখি আরেক নির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী শাহজাহান ভাই কোলাকুলি করার জন্য হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। পেছন থেকে হোসেন ভাই আমার কানে কানে সাঈম ভাই, সারওয়ার ভাই ও শাহজাহান ভাইয়ের নাম নিয়ে বললেন, ‘এই তিনজন প্রার্থীর নাম লিখে রাখলাম। মিথ সত্যি হলে আজকে এই তিনজন পাশ করবেন।‘ আমি তাকে বললাম, ‘মিথ সত্যি হবে কিনা জানিনা, তবে গতবার যে তিনজনকে দেখেছিলাম সেই তিনজনই পাশ করেছিলেন। এবারও যেহেতু তিন জন প্রার্থীই দেখলাম মন বলছে তিন জনই পাশ করবেন।‘ বলেই আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় একটা হাসি দিলাম। তিনি বিস্ময় মাখা চোঁখে আমার দিকে তাকালেন। আমি তাঁর বিস্ময় বাড়িয়ে দিতে আবারও রহস্যময় একটি হাসি দিয়ে হলের ভেতরে প্রবেশ করলাম। মিলনায়তনের ভিতরে ও বাহিরে মিডিয়াকর্মীগণ গিজ গিজ করছেন। লণ্ডনের ভেতর ও বাইরে থেকে আগত সংবাদকর্মীগণের পদচারণায় পুরো মিলনায়তন মুখর হয়ে ওঠেছে। নির্বাচনকে ঘিরে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানটি ব্রিটিশ-বাংলাদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন পর সহকর্মীদের সবাইকে কাছে পেয়ে গভীর আন্তরিকতায় উষ্ণ আলিঙ্গনে একে অপরকে কাছে টেনে নিচ্ছেন। ওমিক্রন ভাইরাসের ভয়ে কেউ কেউ কনুইতে কনুই লাগিয়ে পরস্পর কুশল বিনিময় করছেন। সাজিয়ে রাখা চা-কফি বার থেকে চা-কফি বানিয়ে প্রার্থীগণ ভোটারদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। ডায়াবেটিস আছে এমন সদস্যগণ ক্যালোরি এড়ানোর জন্য চিনির বদলে আর্টিফিশিয়াল সুইটনার খুজঁছেন। খুব শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রার্থীগণ নিজেদের নির্বাচনের শেষ মুহূর্তের প্রচারণা সেরে নিচ্ছেন। প্রবেশ পথের বাম পাশে কিনু ভাই ও তাঁর সহকর্মীদের আইডি কার্ড বিতরণ করতে দেখে এগিয়ে গিয়ে নিজের আইডি কার্ড সংগ্রহ করলাম। আইডি কার্ডের সাথে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের পক্ষ থেকে একটা কফি মগ উপহার পেলাম। নিবন্ধন প্রক্রিয়া শেষ করে মেইন হলে প্রবেশ করে দেখলাম দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভার প্রথম পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে গেছে। ক্লাব সভাপতি এমাদ ভাইয়ের শুভেচ্ছা বক্তব্যের পর বিদায়ী সেক্রেটারি জুবায়ের ভাই বার্ষিক রিপোর্ট উত্থাপন করলেন। একটা সংগঠনের বার্ষিক রিপোর্ট সেই সংগঠনের নির্বাহী কমিটির পারফর্মেন্স, তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতাকে রিপ্রেজেন্ট করে। আমি একজায়গায় বসে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের বার্ষিক রিপোর্ট খুলে পড়ে কিছুটা হতাশ হলাম। রিপোর্টে তারিখ ভুল, বানান ভুল, কোন ধারাবাহিকতা নাই এবং প্রত্যেক রিপোর্টের ভাষা প্রায় এক। বার্ষিক রিপোর্টে এস.এ রাইটিং, গল্প রাইটিং, অ্যাকাউন্টস সবকিছু আলাদা হতে হয়। লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নির্বাহী কমিটির পারফর্মেন্স এমনিতে খারাপ না। বেশ কিছু ভালো ভালো কাজ উনারা করেছেন এবং আরও ভালো কিছু কাজের উদ্যোগ নিয়েছেন। তারচেয়েও বড় কথা করোনা মহামারির সময়েও উনারা ক্লাবের কাজ চালু রেখেছেন, ক্লাব সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। কিন্তু রিপোর্ট তৈরীতে উনাদের অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। সেক্রেটারি জুবায়ের ভাই, ট্রেজারার মাসুম ভাই ও এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি মতি ভাই এবার নির্বাচন করছেন না। নির্বাচন না করে যারা বিদায় নেন, লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের রেওয়াজ অনুযায়ী দীর্ঘদিন ক্লাবকে সেবা দেওয়ার জন্য উপহার হিসেবে তাদের হাতে সন্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়। নবাব ভাই ক্লাবে এই রেওয়াজ চালু করেছিলেন। সেই রেওয়াজ অনুযায়ী মাসুম ভাইয়ের হাতে সন্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি মুহিব চৌধুরী; মতি ভাইয়ের হাতে সন্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিলেন সাবেক সভাপতি নবাব উদ্দিন ও জুবায়ের ভাইয়ের হাতে সন্মাননা ক্রেস্ট তুলে দিলেন সাবেক সভাপতি বেলাল আহমেদ ও সাবেক সভাপতি সৈয়দ নাহাস পাশা। এরপর সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রেজারার মাসুম ভাই ক্লাবের আর্থিক রিপোর্ট উত্থাপন করে হাউজে উপস্থিত সদস্যগণকে অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করলেন। অনুমোদন দেওয়ার আগে সাবেক সভাপতি নবাব ভাই ও সাবেক সভাপতি নাহাস ভাই এবং জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক উদয় দা ক্লাবের আর্থিক রিপোর্টের কিছুটা সমালোচনা করলেন, রিপোর্টের কপি হাতে নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ভুলত্রুটিগুলো ধরিয়ে দিলেন, সংশোধনের পরামর্শ দিলেন। নাহাস ভাই প্রশ্ন করলেন- ‘আমরা যে অফিস করেছি, অফিসের কোন রেন্ট বা রেইট বাকি আছে কিনা? তারপর বললেন, আপনার অনেকেই বলেছেন, প্রেস ক্লাবের অফিস আমি করেছি। অফিস তো আর আমার ব্যাক্তিগত কিছু না, অফিস সবার। এখানে যারা মেম্বার আছেন, তাদের জন্যই অফিস নেওয়া হয়েছে। গত তিন বছরে অফিসের কী অবস্থা, এটা মেম্বাররা যারা যান তারা বলতে পারবেন। গত তিন বছর আমি দায়িত্বে নেই। অনেক জায়গায় জানিয়ে দেওয়া সত্বেও আমার টেলিফোন নাম্বার এখনো রয়ে গেছে। আমি হঠাৎ করে গত সপ্তাহে একটা ফোন কল পেলাম লণ্ডন ব্যুরো অব টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল থেকে। তাঁরা বললো, গত ১৮ মাসের মধ্যে কোন কন্টাক নাই, কোন যোগাযোগ নাই। কোন চিঠির উত্তর নাই, রেইট পেমেন্ট করা হয় নাই। তখন আমি বললাম ঠিক আছে, আমি এটা বর্তমান প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিবো। এরপর আমি তাদেরকে বর্তমান সভাপতির নাম্বার দিয়ে দিয়েছি। করোনা প্যান্ডামিকের সময় সরকার অনেক প্রতিষ্ঠানকে অনেক সহযোগিতা করেছে। আমার প্রশ্ন হলো, লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব কি কোন চেষ্টা করেছিলো যে সরকারের কাছ থেকে কোন ফান্ড পাওয়া যায় কিনা এই রেন্ট-রেইট এগুলো রিবেট পাওয়ার জন্য? আমি জানতে চাই।‘ সাবেক সভাপতি নাহাস ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে বর্তমান সভাপতি এমাদ ভাই বললেন, ‘খুব সংক্ষেপে বলছি। আমি আমার নাম্বারটা ফরোয়ার্ড করেছি। আমি জানিনা এখনো কেনো তাঁরা আপনাকে বিরক্ত করছে! আমাদের সাথে তাদের অনেক আগেই যোগাযোগ হয়েছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পরে পরেই লণ্ডন ব্যুরো অব টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাথে আমার যোগাযোগ হয়েছিলো। আমাদের কয়েক মাসের পয়সা দেওয়া ছিলো। কথা ছিলো, সেই পয়সাটা তারা রিফান্ড করবে ইন দ্যা মিন টাইম তারা প্রসেস করবে পুরো রিবেট দেওয়ার জন্য। গত প্রায় দুই সপ্তাহ আগে আমার সাথে কথা হয়েছে। বাই দিস টাইম তারা আমাদের পয়সাটা রিফান্ড করেনি। আমরা ভেবেছিলাম তারা যদি রিফান্ড করে মওকুফ করে তাহলে আমাদের আর দিতে হবে না। মাঝখানে প্রায় ১৮ মাস কোভিড-১৯ এর কারণে বন্ধ ছিলো অফিস। ফলে আমাদের যোগাযোগ কম হয়েছে। ফাইনালি যেটা আমাদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে তারা বলেছে তারা ৮০% রিবেট আমাদেরকে দিবে, পুরোটা দিবেনা। বাকিটা আমাদের দিতে হবে। সব মিলেয়ে আমরা ৬ মাসের মত পে করেছিলাম। বাকি টাকাটা আছে আমাদের কাছে। আমি বলেছি, আমাদের এখন নির্বাচন, আমাদের এখন বিজিএম। এটা শেষ হলে তাদের সাথে আমরা যোগাযোগ করবো। সুখবর হলো, আমরা অফিসের রেন্ট মওকুফ করার জন্য তাদেরকে ইমেইল করেছিলাম। তারা ৭ মাসের জন্য ২০% ডিসকাউন্ট দিয়েছেন। আমরা সেটাতে সন্তুষ্ট হয়নি বিধায় তারা এটা একটিভলি কনসিডার করছেন। আমাদের যে সম্পূর্ণ মওকুফ করার আবেদনটা আছে সেটা তারা আগামী মিটিংয়ে আলোচনা করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। আর লকডাউনের শুরুতে আমরা ফান্ডিংয়ের জন্য চেষ্টা করেছি। আমরা এই ক্রাইটেরিয়ায় পড়িনা বলে তারা আমাদেরকে ফান্ডিং করেনি।‘ আর্থিক রিপোর্ট মেম্বারদের জন্য তৈরী হলেও লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব যেহেতু চ্যারিটি কমিশনভুক্ত একটি সংগঠন, কাজেই এটি প্রকাশের পর পাবলিক প্রপার্টি হয়ে যাবে। যে কেউ চাইলে এই ডাটা এক্সেস করতে পারবে। কাজেই আর্থিক রিপোর্ট তৈরীর সময় সতর্ক থাকা উচিত, সুন্দরভাবে করা উচিত। ক্লাবের নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে সেক্রেটারি জুবায়ের ভাই পরামর্শগুলো গুরুত্বের সাথে নেওয়ার কথা জানালেন। ট্রেজারার মাসুম ভাই নবাব ভাই, নাহাস ভাই ও উদয় দা’র ধরিয়ে দেয়া ভুলগুলো নিয়ে অ্যাকাউন্টেন্টের সাথে কথা বলবেন বলে জানালেন। তিনি আরও বললেন, ‘দ্বিবার্ষিক সন্মেলনে মূলত অ্যাকাউন্টেসের একটা সামারি দেয়া হয়। মূল অ্যাকাউন্টসটা আমরা চ্যারিটি কমিশন বা যেখানে দেওয়ার সেখানে দেই। আমি ভবিষ্যত কমিটিকে অনুরোধ করবো যে, ভবিষ্যতে আপনারা এই আর্থিক রিপোর্টের সময় যিনি আমাদের অ্যাকাউন্টস দেখাশোনা করেন, তাকে সাথে রাখবেন। এইসব খুঁটিনাটি অনেক বিষয়ে আমরা এক্সপার্টিজ না।‘ ট্রেজারার মাসুম ভাই আরও কিছু কথা বলে পুনরায় আর্থিক রিপোর্ট অনুমোদনের জন্য অনুরোধ করলে এক পর্যায়ে হাউজে উপস্থিত সদস্যগণ আর্থিক রিপোর্ট অনুমোদন দিলেন। ক্লাব নেতৃবৃন্দ আর্থিক রিপোর্ট অনুমোদন দেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। এর মাঝে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বজলুর রশীদ, কমিশনার আজিজ চৌধুরী, কমিশনার আনোয়ার বাবুল মিয়া ও নির্বাচন কমিশনকে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়া মাহদী হাসান এসে ভোট গ্রহণ শুরু করার ঘোষণা দিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে নির্বাচন কমিশনারগণ মজা করে ভোটের একটা খালি বাক্স (ব্যালট বক্স) সবাইকে দেখিয়ে নিয়ে গেলেন। এরপর প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু হলো। এ সময় প্রেস ক্লাব সদস্যদের পক্ষ থেকে উত্থাপিত ক্লাবের বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য, প্রশ্ন ও সমালোচনা কমিটির পক্ষ থেকে লিপিবদ্ধ ও রেকর্ড করার কথা বলা হলো। জৈষ্ঠ্য সাংবাদিক ফরীদ রেজা ভাই বললেন, ‘পেটে ক্ষুধা, এই সময়ে কি কথা বলতে ভালো লাগে? অনেকে লণ্ডনের বাইরে থেকে এসেছেন। সকালে তাঁরা যাত্রা শুরু করেছেন এবং তাঁরা ক্ষুধার্ত। আমার কথাগুলো খুব সংক্ষেপে বলবো, লম্বা কোন কথা নাই। এক নাম্বার- আপনারা অনেক ভালো কাজ করেছেন, এটা ভলান্টারি ওয়ার্ক। এজন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ। দুই নাম্বার- আমি চাই প্রেস ক্লাবের কোন মিটিং শুরু হলে টাইমলি শুরু হবে এবং টাইমলি শেষ হবে। আমরা এদেশের যেসমস্ত সংগঠনে যাই সেখানে টাইমলি শুরু হয় এবং টাইমলি শেষ হয়। আমি প্রেস ক্লাবের একটা মিটিংয়ে টাইমলি গিয়েছিলাম, জুবায়েরকে বলেছি তোমরা যদি টাইমলি শুরু করতে না পারো, আমাকে বলে দিবা কোন সময়ে শুরু করবা, সেই সময়ে আমি আসবো। আমি টাইম মেইনটেইন করি ইনশাআল্লাহ। এই বৃদ্ধ বয়সেও আমি সময়মত উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করি। হতে পারে এটা আমার প্রেস ক্লাবের সর্বশেষ মিটিং। কারণ ভবিষ্যতে আমি প্রেস ক্লাবের মেম্বার থাকার চিন্তা করছিনা। এজন্য আমার কথাগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আমি বলছি, টাইমলি মিটিং শুরু করবেন এবং টাইমলি মিটিং শেষ করবেন। আপনি কাউকে মেম্বারশীপ দিবেন না, আপনাকে কারণ দর্শাতে হবে যে, এই কারণে মেম্বারশীপ দেওয়া হয় নাই। সেটা আপনাদের কনস্টিটিউটে ইনক্লুড করা দরকার। আর্টিকেল অব মেমোরেন্ডামে ইনক্লুড করা দরকার। এদেশে আবেদন করে কেউ চাকরি না পেলে প্রার্থীকে লিখে জানায় কেনো তাকে চাকরি দেওয়া হলো না। কিন্তু আমরা এগুলো করি না। এটা করা দরকার। এরকম করলে ভবিষ্যতে মেম্বারশীপ নিয়ে কোন বিতর্ক হবে না। আর ভোট দান প্রক্রিয়া জটিল না করে ইজি করেন।‘ ফরীদ ভাই কথা শেষ করলে সবাই করতালি দিলেন। জাকি রেজোয়ানা আপা মাইক নিয়ে বললেন, ‘মেম্বারশীপ নিয়ে প্রত্যেক বছর বাক বিতন্ডা যেটা হয় আমি একটু সেটা নিয়ে কথা বলতে চাই। কোন অ্যালায়েন্সকে হ্যাপী করার আমার কোন দায়বদ্ধতা নেই। আমি যে কথাগুলো বলবো সেগুলো আমার দৃষ্টিতে ক্লাবের জন্য ভালো। আমাদের এই ইউকের মাটিতে প্রতি দুই বছরে ৫০/৬০ জন বাঙালি সাংবাদিক তৈরী হয় না। প্রতি বছরই যদি আমরা ৫০/৬০ জন করে নিতে থাকি, দেখা যাবে কিছুদিন পর মেম্বারের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ক্যাপ শব্দটা ক্লিশে শোনালেও মেম্বারশীপ ক্যাপ করা প্রয়োজন।’ শামসুল আলম লিটন ভাই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি এক্সিকিউটিভ কমিটিকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছি। থ্যাংক ইউ ফর ইউর ইউনাইটেড এফোর্টস। ঐক্যবদ্ধভাবে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেন্জ আপনারা মোকাবেলা করেছেন। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।’ এরপর তিনি এক্সিকিউটিভ কমিটির পাওয়ার ব্যালেন্সের জন্য সাবেক সভাপতিদের নিয়ে একটি শক্তিশালী উপদেষ্টা কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেন এবং রাজনৈতিক দলের শীর্ষপদে থাকা ব্যাক্তিদের সদস্যপদ নিয়ে ক্লাবের গৃহিত সিদ্বান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করলেন। দ্বিবার্ষিক সাধারণ সভায় ক্লাব সদস্যগণ মেম্বারশীপ রেজিস্ট্রেশন, সাংবাদিকদের জন্য প্রশিক্ষণের আয়োজন ও সদস্যদের মৌলিক রচনা নিয়ে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব জার্নাল প্রকাশসহ বিভিন্ন কার্যকর কর্মসূচী গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে সুচিন্তিত মতামত উপস্থাপন করলেন এবং ক্লাব নেতৃবৃন্দকে অন্যান্য নানা বিষয়ে মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। ক্লাব সদস্যগণ ক্লাবের নিজস্ব প্রপার্টি কেনাসহ অতীতের বিভিন্ন সফল কর্মসূচীর কারণে বিদায়ী সকল নির্বাহী কমিটির সদস্যদের প্রশংসা করলেন। আনাস ভাইয়ের মত কেউ কেউ আবার নির্বাহী কমিটির তীব্র সমালোচনাও করলেন। ক্লাবের মেম্বারশীপ ইস্যুতে ঠান্ডা মিলনায়তন গরম করার চেষ্টা করলেন। আনাস ভাই প্রথমে কথা বলার সুযোগ দেওয়ার জন্য নির্বাহী কমিটিকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর কোট-আনকোট তিনি বললেন, ‘আমাদের যেদিন জেনারেল মিটিং এবং নির্বাচন দুইটা একসাথে হইলে… এই যে শুরু করলেন দেরিতে, এরপর খাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, ভোট শুরু হয়ে যাচ্ছে, আমরা যে সাধারণ সদস্য আমাদের যে কথাবার্তা আছে, পরে বলবেন সময় তো শেষ, তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। তো ভবিষ্যতে আপনারা দুইটা দুইদিনে করেন। জেনারেল মিটিংটা আগের দিন করেন। সবাই খোলামেলা তাদের সুখ দু:খ সবকিছু বলুক, এইটা একটা প্রস্তাব। দুই নাম্বার হইলো আমি কিছু বিষয়ে কথা বলতে চাই। এইগুলো ক্লাবের আইন কানুন বা সংবিধানের মধ্যে নাই। গত স্পেশাল জেনারেল মিটিংয়ে সদস্য হওয়ার যে ক্রাইটেরিয়া হইছে, এইটার ওপর আমার আপত্তি আছে। আমি ওই মিটিংয়ে ছিলাম না। এরপরে দেখলাম একটা এপ্লিকেশন করা হয়েছে ওই বিষয় নিয়ে। আমি সজ্ঞানে এবং সুস্থ মস্তিষ্কে কোন রকম ইয়ের বশবর্তী না হয়ে এপ্লিকেশনটাতে স্বাক্ষর করেছি। আজকের সভায় আমার দুইজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে আমি দেখতেছিনা। একজন হলেন আনসার আহমেদ উল্লাহ, আরেকজন হলেন সৈয়দ জহুরল হক। পরে শুনলাম যে উনাদের সদস্যপদ নাই। তিন নাম্বার হইলো, যারা সদস্যপদ থেকে বাদ পড়েছেন তারা একটা প্র্রেস কনফারেন্স করেছেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন, আমি যেতে পারি নাই কিন্তু তাদের নিউজ আমি কাভার করেছি। এরপরেই দেখেছি নির্বাহী কমিটির পক্ষ থেকে আমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া হয়েছে যে, যারা প্রেস কনফারেন্স করেছেন তাদের সাথে প্রেসক্লাবের মেম্বার কাদের যোগাযোগ আছে…এই ধরনের কিছু ডিটেইলস দিয়েছেন। একটা শব্দ আপনারা উচ্চারণ করেছেন যে, ইসি কমিটি এটা পর্যবেক্ষণ করছে, কারা এটার পেছনে আছে। এই শব্দ চয়নে আমি খুবই আহত হয়েছি। প্রেস ক্লাবের মত একটা সংগঠনে যদি এই ধরনের হুমকিমূলক বক্তব্য দেওয়া হয় যে ইসি কমিটি পর্যবেক্ষণ করছে! প্রত্যেকবার ইলেকশনে আমি একটা প্যানেলের পক্ষে থাকতাম, প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে ক্যাম্পেইন করতাম। এবারে আমি আসলে এই ভয়েই ক্যাম্পেইনে যায় নাই, যদি ওই পর্যবেক্ষণে আমি পড়ে যাই। পরেরবার হয়তো দেখা যাবে আমিই নাই, এই ভয়েই আমি যাই নাই। এটা খুবই আপত্তিজনক, আমি অপমানিতবোধ করছি এবং আমার মনে হয় যারা সাধারণ সদস্য আছেন তারা সবাই অপমানিত হচ্ছেন এই হুমকিতে। কারণ পকেটের পয়সা দিয়ে প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর মেম্বার হই। এটা যদি শুধুমাত্র হয় আপনাদেরকে ভোট দিয়ে নেতা বানানোর জন্য তাহলে তো এটা আমাদের প্রতি অবিচার হয়। এই ধরনের হুমকিটা ঠিক হয় নাই। এখন বলতে চাই আমি রাজনৈতিক দল নিয়ে। রাজনৈতিক দল এই প্রেস ক্লাবে আছে। পরস্পর বিরোধী চেতনায় বিশ্বাসী আমরা অনেক মেম্বার আছি। সবাই আছি। আনসার আহমেদ উল্লাহ যুদ্বপরাধ বিরোধী আন্দোলনে আছেন। আজকে আনসার আহমেদ উল্লাহ নাই। কিন্তু আনসার আহমেদ উল্লাহর আদর্শের বিপরীতে যারা আছেন তাদের সাথে আপনাদের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তাদের দেখলেই আমার ভিতরে একটা ইয়ে হয়ে যায়। এই মানসিক বিভেদটা আপনারা তৈরী করেছেন।‘ জুবায়ের ভাই বললেন, ‘আমারও প্রশ্ন হয় কষ্ট হয়।‘ আনাস ভাই জুবায়ের ভাইকে বললেন, ‘আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম। আপনি বলেছেন আপনি উত্তেজিত হয়ে যান। আমি বলেছিলাম, আমি যদি উত্তেজিত হয়ে যাই তাহলে এক গ্লাস পানি দিয়েন।‘ জুবায়ের ভাই বললেন, ‘আছে আছে পানি আছে, উনাকে কেউ কাইন্ডলি পানি দেন।‘ এই কথা শোনে কিবরিয়া ভাই আনাস ভাইয়ের দিকে বেশ কয়েকবার পিট পিট করে তাকালেন, তবে কিছু বললেন না। বুলবুল ভাই উঠে দাড়িঁয়ে কোট আনকোট বললেন, ‘মেম্বারশীপ নিয়ে অনেক কথা হলো। আমি দুটো কথা বলতে চাই। অনেকের কাছে অপ্রিয় মনে হবে। মেম্বারশীপ ক্রাইটেরিয়াটাকে স্ট্রিক্ট স্ট্রাকচারের মধ্যে আনার জন্য কিন্তু আমিসহ অনেকেই বলেছেন যে এটা আনা দরকার। আমাদের সেই চাওয়াটাকে এই কমিটি সন্মান দেখিয়ে সেটি সামনে এনেছেন। সেটির ওপর ভিত্তি করেই কিন্তু ভোট হয়েছে। আজকে যারা সদস্য হওয়ার ক্রাইটেরিয়া নিয়ে আপত্তি করছেন, ভুল বলছেন তাদের ভূমিকাটা সেদিন কী ছিলো? এখন যারা বিরোধীতা করছেন ওইদিন তারা কোনদিকে ভোট দিয়েছেন? আমার জানার ইচ্ছা আরকি। পরের দিকে এপ্লিকেশনে সিগনেচার কালেকশন থেকে শুরু করে যেসব বিষয় তাঁরা করেছেন, আমার কাছে মনে হয়েছে ওনারা ট্রেন মিস করে এখন অনেক বেশি আলোচনা করছেন। মেম্বারশীপ ইস্যুতে নেতৃবৃন্দকে দোষারুপ করে লাভ নেই। রাজনৈতিক দলের বিশেষ কয়েকটি পদে থাকা মানুষেরা ক্লাবের পূর্ণ সদস্য হতে পারবেন না। এই নিয়মটা ক্লাব সদস্যরাই বানিয়েছেন। নেতৃবৃন্দ শুধু এই নিয়মটা ফলো করেছেন। এখানে বিবদমান দুইটা গ্রুপ আছে। আপনারা শুধু শুধু এটা নিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন।‘ বুলবুল ভাইয়ের কথা শোনে আনাস ভাই মন খারাপ করলেন। আনাস ভাইকে মন খারাপ করতে দেখে বুলবুল ভাই এবার সভাপতি এমাদ ভাই ও সেক্রেটারি জুবায়ের ভাইকে বললেন, ‘যাদের সদস্যপদ দেওয়া হয়নি আপনারা তাদের সাথে একটু কথা বলতে পারতেন। নিয়মের ভেতরে থেকে ফরমটা ফুলফিল করে আনতে পারতেন বা দিতে বলতে পারতেন। কিন্তু আপনারা সেটা করেন নাই। আপনারাও এটা নিয়ে রাজনীতি করেছেন। এখানে ভোটের রাজনীতি কাজ করেছে।‘ আমার পিঠে খোঁচা দিয়ে একজন বললেন, ‘চিকন বুদ্ধির বুলবুল ভাই দুই দিকেই ব্যালেন্স করলেন।‘ আরেকজন বললেন, ‘বুলবুল ভাই শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক বানানোর চেষ্টা না করে দেশের দুই বড় দলের সাথে এভাবে ব্যালেন্স করে চললেই পারেন।‘ এক টেবিল ঘিরে দশ চেয়ারে দশ জন করে বসেছি। একটা টেবিলে মহিউদ্দিন আফজাল ভাইকে দেখলাম গালে হাত দিয়ে বসে চুপচাপ শুনছেন। টেবিলের অন্যেরা মহিউদ্দিন আফজাল ভাইকে গাল থেকে হাত নামাতে বলছেন। জাকি রেজোয়ানা আপাকে দেখলাম মেম্বারশীপ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা শুনতে শুনতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছেন। অজয় দা এসে সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি প্রার্থী সাত্তার ভাইকে খুঁজছেন। রিজভী ভাই বলছেন, সাত্তার ভাইয়ের স্ত্রী আকস্মিক অসুস্থ্য হয়ে পড়ার কারণে আসতে পারেননি বলে এপোলজি দিয়েছেন। আনাস ভাইয়ের বক্তব্য শেষ হলে পাশের টেবিল থেকে একজন তালি দিলেন। আরেকজন আনাস ভাইকে সমর্থন করে নিচুস্বরে বললেন, ‘আনসার আহমেদ উল্লাহ ভাইয়ের মত মানুষকে সদস্য করা হয়নি। তিনি ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য। অথচ স্বাধীনতা বিরোধীদের সদস্য করা হয়েছে। জুবায়েরের আশেপাশে আমি স্বাধীনতা বিরোধীদের দেখি।‘ জবাবে ওই টেবিল থেকেই আরেকজন বললেন, ‘আনসার আহমেদ উল্লাহ ভাই ‘জার্নালিস্ট ইউনিয়ন যুক্তরাজ্য‘ নামে অনুরুপ আরেকটি সংগঠনের সাথে জড়িত আছেন। এই কারণে সংগঠনের নিয়ম অনুযায়ী তাকে সদস্য করা হয়নি। আমরা উনাকে ওখান থেকে পদত্যাগ করে এখানে আসতে বলেছিলাম কিন্তু তিনি আসেননি।‘ সবার কথা শোনে আহমেদ ভাই বললেন, ‘দেশে থাকতে বাংলাদেশের কথিত চেতনাবাজদের দেখলে আমার প্রায়ই একটা কৌতুক মনে পড়ে যেতো। আজকে এখানে বার বার স্বাধীনতা বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী শব্দ শোনে পুরনো সেই কৌতুকটা আমার মনে পড়ে গেলো। ক্লাস থ্রির এক ছেলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার সময় ‘কুমির’ রচনা শিখেছে। সমস্যা হল এরপর যে পরীক্ষাই আসুক সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই কুমিরের রচনাই লেখে। যেমন: একবার রচনা এলো ‘বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য’। তো সে লিখলো- বাবা মা আমাদের জন্ম দেয়। তারা আমাদের লালন পালন করে। কুমিররাও তাই করে। জেনে রাখা ভালো যে, কুমির একটি সরীসৃপ প্রাণী। এটি জলে বসবাস করে। এর চোঁখ গোল গোল। কুমিরের পিঠ খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা……। এরপরের পরীক্ষায় রচনা এলো ‘আমার প্রিয় শিক্ষক’। সে লিখল- আমার প্রিয় শিক্ষক এর নাম মোহাম্মদ এ আরাফাত। তাঁর চোখগুলো গোল গোল। কুমিরেরও চোঁখ গোল গোল। জেনে রাখা ভালো যে, কুমির একটি সরীসৃপ প্রাণী। এটি জলে বসবাস করে। কুমিরের পিঠ খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা…….। বাংলা শিক্ষক দেখলেন এতো ভারী বিপদ। শেষে তিনি অনেক ভেবে চিন্তে রচনার বিষয় ঠিক করলেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’। লেখ ব্যাটা, এই বার দেখি কি করে তুই কুমিরের রচনা লিখিস। তো ছাত্র লিখলো- ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ এবং বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজ-উদ-দৌলা খানের মধ্যে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা খান তাঁর সেনাপতি মীরজাফর এর উপর ভরসা করে খাল কেটে কুমির এনেছিলো। জেনে রাখা ভালো যে, কুমির একটি সরীসৃপ প্রাণী। এটি জলে বসবাস করে। এর চোঁখ গোল গোল। কুমিরের পিঠ খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা, খাজ কাটা……!‘ কৌতুক শোনে হলের ভেতরে আমরা নি:শব্দে হাসছি। এ সময় আমার ডান পাশে বসা একজন আমাকে কানে কানে বললেন, খান ভাই স্বয়ং আনাস ভাইকে নিয়ে বাজারে একটা কৌতুক চালু আছে, আপনি জানেন? আমি বললাম, না, জানিনা। তিনি বললেন, ‘আনাস ভাইয়ের পত্রিকার এক রিপোর্টার সম্পাদক আনাস ভাইকে ফোন দিয়েছেন। রিপোর্টার বলছেন- স্যার স্কুলের এক ছাত্র মারা গেছে। ছেলেরা বিক্ষোভ করতেছে৷ কারা যেন গাড়িও পুড়াচ্ছে। সম্পাদক আনাস ভাই বলছেন- আরে এটাই তো নিউজ! লিড নিউজ হবে এটা। সাথে ফ্রন্ট পেইজে লাল হরফে হেড লাইন- “ছাত্র নিহত। বিক্ষুব্ধ জনপদ। ক্ষোভে কাঁপছে মানুষ।” রিপোর্টার বলছেন- ওকে স্যার। এবার আনাস ভাই তাঁর রিপোর্টারকে জিজ্ঞাসা করছেন- কোন স্কুলের ছাত্র? রিপোর্টার বলছেন- স্কুল না স্যার, মাদ্রাসা। মাদ্রাসার কথা শোনে আনাস ভাই খুশিতে ডগমগ হয়ে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠে বললেন- এটাই আজকের সবচেয়ে বড় নিউজ। লাল হরফে হেড লাইন হবে – “মাদ্রাসা ছাত্রদের তাণ্ডব। বিপর্যস্ত জনপদ। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান দেখছে বাংলাদেশ?” যাই রেহানা আপা আর গাফ্ফার ভাইকে খবরটা দিয়ে আসি।‘ তাঁর কৌতুক শোনে মুখ চেপে হাসলাম। বাম পাশ থেকে আরেকজন বললেন, ‘আনাস ভাইয়েরা শেখ হাসিনার অবৈধ রেজিম টিকিয়ে রাখতে এভাবে জাতিকে আর কত বিভক্ত করবেন আর কতদিন ডিভাইড এন্ড রুল পলিসিতে চলবেন- তা একমাত্র আল্লাহপাকই জানেন। আমাদের দরকার একটা ঐক্যবদ্ধ জাতি। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে দেশ থাকবে, দেশের সার্বভৌমত্ব থাকবে। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে গ্রেইট বেঙ্গল বাস্তবায়ন সহজ হবে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে। জয় বাংলা শ্লোগান সার্থক হবে। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে দেশে গণতন্ত্র ফিরবে, সুশাসন ফিরবে, দেশের ১৭ কোটি মানুষ প্রকৃত মুক্তি পাবে। জাতি ঐক্যবদ্ধ হলে লাখো শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। আমাদের দরকার এমন একটা লিডারশীপ যে লিডারশীপ জাতিকে বিভক্ত করবে না। মিলার বলেছেন, ‘Great leaders create a culture of trust and mutual respect.’ আমাদের লিডারদেরকে এই কালচার তৈরী করতে হবে। আর তার জন্য জাতির বিবেক খ্যাত সাংবাদিকদেরই সবার আগে সোচ্চার হতে হবে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের মধ্যে মুষ্টিমেয় কিছু দালাল ছাড়া সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। কেউ অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন। কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়েছেন। কেউ তথ্য দিয়েছেন। কেউ সমর্থন দিয়েছেন। যে যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কাজেই স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে গণহারে কাউকে স্বাধীনতা বিরোধী বলার কোন সুযোগ নেই। জেনে বুঝে যারা এটা বলেন তারা অসৎ উদ্দেশ্যে বলেন, তারা নিছক রাজনৈতিক মতলব থেকে বলেন।‘ এক টেবিল ঘিরে দশ চেয়ারে বসা দশ জনই তাকে সমর্থন করলেন। এর মধ্যে এক ভাই দাঁড়িয়ে কমন একটা প্রশ্ন রিপিট করলেন। এই প্রশ্নের উত্তর আগে দেয়া হয়েছে বলে সেক্রেটারি জুবায়ের ভাই তাকে বসতে বললেন। তিনি উত্তর শুনতে পাননি জানিয়ে বসে গেলেন। সভাপতি এমাদ ভাই সংক্ষেপে আবারও উত্তর দিলেন এবং অন্যজনকে প্রশ্ন করার সুযোগ দিতে বললেন। আমি লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবকে একটি সুদৃঢ় বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো, গঠনতন্ত্রে সময়োপযোগী পরিবর্তন, প্রেস ক্লাবের সদস্যপদ প্রদান প্রক্রিয়ায় আরও স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ নিয়ে কিছু বলতে যাবো, ঠিক এসময় এ বছর প্রেস ক্লাবের নতুন মেম্বার হয়েছেন এমন এক সদস্য ভাই মাইক চেয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোট আনকোট বললেন, ‘প্রেস ক্লাব আমার আবেদনের প্রেক্ষিতে এবছর আমাকে নতুন সদস্য করেছে। আমাকে সদস্যপদ দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা। এখানে স্বচ্ছতার প্রসঙ্গ এসেছে। ২০১৮ সালে আমি সবরকম শর্তপূরণ করে সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলাম। আমার আবেদন পত্র সেদিন প্রত্যাখান করা হয়েছিলো। আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি কেনো আমার আবেদনপত্র প্রত্যাখান করা হয়েছিলো! সেখানে ১৫ জন কমিটিতে ছিলেন। ওই ১৫ জন সদস্য নি:সন্দেহে যাচাই-বাছাই করেছেন। আমার বিশ্বাস আপনারা আপনাদের দায়িত্বের প্রতি অবিচার করেছেন। একইসঙ্গে আমার প্রতি অবিচার করেছেন। আমি একমাত্র সদস্য সেই ১৫ জনের মধ্যে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আপনাদের সদস্য পদের জন্য আবেদন করেছিলাম। আপনারা আমাকে প্রত্যাখান করেছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে যেটাকে বলা হয় সর্বাধিক প্রচারিত ইত্তেফাক, আমি সেই কাগজে কাজ করেছি একটানা চার বছর, আপনারা সেটাকে আমলে নেননি। আপনারা অবিচার করেছেন। আজকে আপনারা ফেয়ারনেসের কথা বলছেন, স্বচ্ছতার কথা বলছেন, স্বচ্ছতা আপনাদের মধ্যে সেদিন ছিলোনা। আমি তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ করছি…।‘ ভদ্রলোকের বক্তব্যের প্রথম অংশ শোনে অনেকেই তার প্রতি সহানুভূতি দেখালেন। কিন্তু দ্বিতীয় অংশ শোনে অনেকেই হতাশ হলেন। একজন বললেন, ‘নির্বাহী কমিটির সদস্যদের চাইতে তিনি নিজেকে বেশি যোগ্য মনে করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্তেফাকের কথা বলছেন। নিজেকে অশ্লীলভাবে জানান দিচেছন। অন্যদের চাইতে নিজেকে অনেক বড় মনে করছেন। নির্বাহী কমিটির ১৫ জন সদস্যকেই তিনি অপমান করছেন, লজ্জা দিয়েছেন। নিজেকে তিনি জাহির করছেন।‘ আরেকজন বললেন, ‘ভদ্রলোক এমনভাবে বলেছেন, যা শোনে বিবিসির মোয়াজ্জেম ভাইও ফিক করে হেসে দিয়েছেন।‘ পেছনের টেবিল থেকে বললেন, ‘২০১৮ সালে নাহাস ভাই সভাপতি ছিলেন, তারেক ভাই সহসভাপতি ছিলেন, জুবায়ের ভাই সেক্রেটারি ছিলেন, মাসুম ভাই, কাইয়ুম ভাই, মতি ভাই ও নাজমুল ভাই সেই কমিটিতে ছিলেন। মতি ভাই ও নাজমুল ভাই ঢাবিতে পড়াশোনা করেছেন। মতি ভাই আর নাজমুল ভাই যে ঢাবিতে পড়েছেন, এটাতো তারা কারও কাছে বলেনই না। এই নতুন সদস্য ভাইয়ের কথা শোনে নাহাস ভাই, জুবায়ের ভাইসহ কমিটির অন্য সদস্যেরা কষ্ট পেয়েছেন।‘ এসময় মঞ্চ থেকে জুবায়ের ভাই নতুন ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে নাহাস ভাইকে অনুরোধ করলে নাহাস ভাই বললেন, ‘আমি কারও ব্যাক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিবো না।’ এরপর নাহাস ভাই বর্তমান মেম্বারশীপ ক্রাইটেরিয়া নিয়ে কিছু কথা বললেন। অজয় দা ঢাবি’র সেই ভাইকে ছা, ছপ আর ছিঙ্গারা দিতে বললেন। অজয় দা’র কথা যারা শুনতে পেলেন তাঁরা সবাই মৃদু হাসলেন। ইসলাম ভাই বললেন, ‘বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষদের মধ্যে একটা অসুস্থ ডিগ্রী ফেটিশ আছে। অশিক্ষিত লোকেদের ভেতরে এই ফেটিশটা থাকা অস্বাভাবিক না। তাদের কাছে ডিগ্রী মনে হয় জাত, ধর্ম টাইপ কিছু। ইউনিভার্সিটি যে আপনাকে কাজের জিনিস প্রায় কিছুই শেখায় না- এটা যারা ইউনিভার্সিটি পাশ করে তাদের সবারই জানার কথা। কিন্তু আমার আশ্চর্য লাগে যে, এই ছেলেরা ইউনিভার্সিটি পাশ দিয়েও, নিজেকে মেধাবী দাবী করেও এই সহজ সত্যটা বুঝতে পারে না। আমি নিজে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি করা পিওর বোদোহ দেখছি যে হাইস্কুল লেভেলের চিন্তা করতে অক্ষম। কোন লেভেলের বোদোহ চিন্তা করেন। আবার ঢাকা ইউনিভার্সিটির চৌহদ্দিতে পা না রাখা সাংবাদিক দেখেছি যে এমেইজিংলি ব্রিলিয়ান্ট! অথচ ঢাবি’তে পড়া ছাত্রদের পা যেনো মাটিতে পড়েনা! নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আল মাহমুদ ঢাবি দুচেনা, ইউনিভার্সিটি দুচেনা। আমাদের বিলেতের কবি আহমেদ ময়েজকে ফেইস করতে পারে ঢাবি’র বাংলা বিভাগে পড়া এমন কোন ছাত্র বা শিক্ষক আমি দেখিনা। ওয়ার্ল্ড র্যাং কিংয়ে হাজারের ভেতরেও না থাকা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে গর্ব করার কী আছে জানিনা। এক পূর্ব লণ্ডনেই তাদের তিন তিনটা অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আছে। কেউ কারও চেয়ে কম না। গর্বের চোটে এরা কেউ এক হতে পারছে না, একদল অন্যদলের সাথে মিশতে পারছে না। ইসলাম ভাই আরও বললেন, বাংলাদেশে পাবলিকের টাকায় চলা সব চেয়ে বড় অথর্ব প্রতিষ্ঠানের নাম এখন বিশ্ববিদ্যালয়। বিগত ১৪ বছরে বাংলাদেশের সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানও বিশ্ববিদ্যালয়, যার দীর্ঘ মেয়াদি ফল ভোগ করতে হবে বাংলাদেশেকে; বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে অন্তত একশো বছর পিছিয়ে গেছে বাংলাদেশ। দলবাজ, দলদাস, অযোগ্য, অপদার্থ, ঘাগু জ্ঞানপাপীদের আশ্রয় প্রশ্রয় দান করে গত ১৪ বছরে সত্যিকার গবেষক ও একাডেমিশিয়ানদের কার্যত একঘরে করা হয়েছে। গবেষণা ও সমাজ রূপান্তরমূলক কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে ঠেলা হয়েছে, বাধা দেয়া হয়েছে। যেই ছেলেটা কিংবা মেয়েটা প্রকৃত মেধাবী ছিল। যার হয়তো দেশকে অনেক কিছু দেয়ার ছিল; তাকে শুরুতেই দমিয়ে দেয়া হয়েছে। মেধাবীদের নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। একমাত্র দলীয় আনুগত্য ও দলবাজীর ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে। ফার্স্ট ক্লাসের জায়গা থার্ড ক্লাস নিয়ে নিচ্ছে। আগে এসব ছিলোনা তা বলছিনা। তবে এই পরিমাণে ছিলোনা। এমনকি শেখ হাসিনার ৯৬ এর শাসনামলেও অবস্থা এতটা ভয়াবহ ছিলো না। এখন সত্যিকার অর্থে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের মিনি রূপ হচ্ছে একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে তিনিই শিক্ষক নেতা, যিনি নিরঙ্কুশ আনুগত্য দেখাতে পারেন। যিনি ভিসি হওয়ার ফাইল আর সিভি হাতে নিয়ে রাষ্ট্রের বিভিন্ন দুয়ারে লজ্জাহীন দৌড়াতে পারেন! বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বলতে যারা শুধু উঁচু উঁচু দালান-কোঠা বিল্ডিং, ছা ছপ প্রজেক্ট আর টাকা বুঝেন। উনারা একে ধরেন, তাকে মারেন, অমুককে ফেলে দেন, তমুককে সরিয়ে দেন। আর ভিন্ন মত হলে “খাইছি তোরে” বলে খেয়ে ফেলেন, “পালাবি কোথায়” বলে কলার চেপে ধরেন আর “কোপা শামসু” বলে কোপাকুপি করেন। নিয়ম ভঙ্গ করে নিজের লোককে চাকরি দেন, দলবাজকে চাকরি দেন কিংবা টাকার বিনিময়ে চাকরি দেন। এরাই এখন শিক্ষকতা করেন। স্যুট কোট টাই পরে বুদ্ধিজীবী সাজেন, জাতিকে জ্ঞান দান করেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মীজানুর রহমানের কথাই ধরেন, কিছুদিন আগে তিনি বলেছেন, যুব লীগের দায়িত্ব পেলে উপাচার্য পদ ছেড়ে দিতে রাজি আছেন। বলেছেন, যুব লীগ আমার প্রাণের সংগঠন। এই সংগঠনের জন্য অনেক কষ্ট করেছি। এখন সংগঠনটি একটি সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারে আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলে তা গ্রহণ করবো।’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি, যিনি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, শিক্ষা নয়, শিক্ষার মান নয়, গবেষণা নয়, শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মচারী নয়, ভাবিত হচ্ছেন, যুবলীগ নিয়ে, এই সংগঠনের ভাবমূর্তি নিয়ে! অথচ তিনি নিজে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, সেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এখন চরম ভাবমূর্তির সংকটে নিমজ্জিত। এখানে শিক্ষার মান নেই, শিক্ষার্থীদের ক্লাস করার পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, শিক্ষক নেই, গবেষণা নেই, ভালো গবেষণাগার নেই, আধুনিক লাইব্রেরি নেই। এখানে শিক্ষার্থীদের একাংশ সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি-মাস্তানি করে, দোকানদার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মারামারি করে, প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনকে কোনো ধরনের তৎপরতা চালাতে দেয় না, এমনি কত কত অভিযোগ। এসব ব্যাপারে কোনো ধরনের কথা না বলে তিনি যুবলীগের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব পালন নিয়ে ভাবছেন! ড. মীজান যে দৃষ্টিকোণ থেকে, যে কারণেই কথাগুলো বলুন না কেন, তাঁর এই বক্তব্য মোটেও শিক্ষকসুলভ নয়। বরং শিক্ষক হিসেবে তাঁর এই বক্তব্য চরম স্খলনেরই দৃষ্টান্ত। একজন ভিসি যদি নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে না ভেবে ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগ, হকার লীগের ভাবমূর্তি নিয়ে চিন্তিত এবং বিচলিত হন, ‘উপাচার্য না যুবলীগ চেয়ারম্যান কোন পদকে আপনি বেশি গুরুত্ব দেবেন’ এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘অবশ্যই যুবলীগের পদকে গুরুত্ব দেবো’ বলেন, তাহলে দেশের উচ্চ শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হতে হয় বৈকি! এগুলো হলো, “জাতীয় বেইমানি”, “জাতীয় অপরাধ”। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মশাই তাঁর ছেলে, মেয়ে এবং শ্যালক-শ্যালিকা’র ছেলে-মেয়ে’কেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দিয়েছেন। শুধু তাই’ই না! তিনি তাঁর বউকে’ও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বানানোর চেষ্টা করেছেন! ‘ছাত্র মারা ভিসি চাই না, চাই না’ শ্লোগান দিয়ে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র ছাত্রীরা আন্দোলনে নেমেছেন। ভিসি তাঁর ক্ষমতার জোরে শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন। এই ঘটনার তীব্র নিন্দা না করে বরং শাবিপ্রবির ভিসি’র পক্ষে আরও প্রায় অর্ধশত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিগণ বিবৃতি দিয়েছেন। মানুষ ক্ষমতা পেলে উদার হয়; আমরা হই ছোট লোক। শোনা কথা, গণভবনে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নির্বাচনের জন্য সেদিন অনেক দলদাসকে ডাকা হয়েছিল। রাত ১২ টায় প্রধানমন্ত্রীর সামনে সবাই পরীক্ষা দিতে প্রস্তুত। পিএম বললেন, তোমাদের মধ্যে যে সবার আগে সংসদ ভবনের এলাকা দৌঁড়ে শেষ করতে পারবে সেই শাবিপ্রবির ভিসি হবে। এই কথা শোনা মাত্র অন্য সব দলদাস দৌড় শুরু করলেন। কিন্তু গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দীন নড়লেন না। প্রধানমন্ত্রী তাকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি ভিসি হতে চাও না? মুচকি হেসে চতুর ফরিদ প্রধানমন্ত্রীকে সালাম করে উনার চারপাশে একটা চক্কর দিয়ে বললেন, আপনিই তো আমার কাছে বাংলাদেশ! ঐ সংসদ ভবন কোন ছাড়! প্রধানমন্ত্রীর মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঐ থেকেই স্যুট, কোট, টাই পরা গার্মেন্টস ব্যবসায়ী ফরিদ উদ্দীন দুই মেয়াদে ভিসি হয়েছেন, এখনো আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। আসলে আমাদের দেশটা যারা চালাচ্ছেন, তাঁরা দেশে জ্ঞানী-গুণী-মেধাবী চান না। তাঁরা চান মোসাহেব। তাঁরা চান এমন একটা গোষ্ঠী যারা লেজ-নাড়ানোর বিদ্যায় পারঙ্গম। ক্ষমতাসীনরা বিরোধিতা চায় না, সমালোচনা চায় না, কেবল প্রশংসা শুনতে চায়, সমর্থন চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণির তথাকথিত শিক্ষক ক্ষমতাসীনদের এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসেন। জালাল উদ্দিন রুমি এদেরকে দেখেই হয়তো বলেছিলেন, ‘আমি অনেক মানুষ দেখেছি যাদের গায়ে কোনো জামা নেই। আবার অনেক জামা দেখেছি যাদের ভেতরে কোনো মানুষ নেই।‘ রুমির এই আপ্ত বাক্য মাথায় রেখে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা ভিসি আছেন তাদের নিয়ে সচেতন নাগরিকগণ একটা ভিসি মিউজিয়াম বানাতে পারেন। ঢাবি, রাবি, বেরোবি, জাবি, জবি, শাবিপ্রবি এরকম আরও প্রায় অর্ধশত ক্লাসিক ভিসিদের মোমের মূর্তি দিয়ে এই মিউজিয়াম সাজানো থাকবে। ভেতরে ডক্টরেট কক্ষ নামে বড় একটা কক্ষ থাকবে। সেই কক্ষে আজিজ, বেনজীর, মাহফুজ, মমতাজ, রুবানা, মিজান, কলিমুল্লাহ এমন সব ডক্টরেট ডিগ্রিধারী সেলেব্রিটিরা থাকবে। দর্শনার্থীরা পয়সা খরচ করে উনাদের দেখতে যাবেন, উনারাও দর্শনার্থীদের দেখতে আসার জন্য পয়সা দিবেন।‘ মওকা পেয়ে ইসলাম ভাই ছোটখাটো একটা লেকচারই দিয়ে ফেললেন। ইসলাম ভাইয়ের কাছে একজন জানতে চাইলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয়, এর যৌক্তিক ভিত্তি কী?’ ইসলাম ভাই বললেন, ‘আশ্চর্য, সবকিছুর যৌক্তিক ভিত্তি থাকতে হবে? আমরা আদর করে ‘বাবু ‘ ‘সোনা ‘ এইসব বলি না?’ প্রশ্নকর্তা, উত্তরদাতা এবং শ্রোতা সকলেই হাসলেন। বিজিএম একটু দেরিতে শুরু করায় লাঞ্চের সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের প্রশ্ন উত্তর পর্ব শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। অতিথিদের সবার ডিনারের দাওয়াত থাকলেও লাঞ্চের সময়েই অনেকে এসে পড়েছেন। প্রশ্ন উত্তর পর্ব চলার মাঝেই কেউ কেউ খেতে বসে গেছেন। চামচের টুংটাং আওয়াজের মাঝেই সদস্যগণের প্রশ্ন উত্তর পর্ব চলছিলো। সুফিয়ান ভাই মাইক হাতে নিয়ে লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবকে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দেখতে চাইলেন। তিনি বললেন, ‘এই সভ্য দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি নিয়ে আসা উচিত নয়। লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবকে প্রেস ক্লাব থাকতে দিন দয়া করে।‘ অভি ভাই চেয়ারে বসা ছিলেন। রাজনীতির আলোচনায় অধৈর্য্য হয়ে তিনি ওঠে দাঁড়ালেন। খালেদ নজরুল ভাই আনাস ভাইয়ের কথার সূত্র ধরে বলতে গিয়েও দীর্ঘ হয়ে যাবে বলে থেমে গেলেন। কেউ রাজনীতির পক্ষে বললেন, কেউ রাজনীতির বিপক্ষে বললেন। সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় উপস্থিত সদস্যগণের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলেন। শেষের দিকে এনাম চৌধুরী ভাই উঠে দাঁড়িয়ে আনাস ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন। এনাম ভাই তাঁর বিরুদ্ধে আনাস ভাইয়ের ব্যাক্তিগত ঘৃণা ছড়ানোর লিখিত অভিযোগ দেওয়ার কথা জানালেন। অভিনেতা ও মিডিয়াকর্মী সেতু চৌধুরী ভাই ক্লাবের যেকোন আয়োজনে নাটক, আবৃত্তি ও সঙ্গীত পরিবেশন করতে চাইলে কার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করতে হবে জানতে চাইলেন। আজহার ভূইয়া ভাই ক্লাবের ওয়েব সাইটে সদস্যদের নামের বানানে ভুল ও সাইট নিয়মিত আপডেট না হওয়ার বিষয়ে নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। আলী আহমেদ বেবুল ভাই, শেখ সুরত ভাই, তৌফিক মিনার আলী ভাই, হাসান ভাই, অনুপম দা ও সালাউদ্দিন শাহিন ভাইসহ আরও অনেকেই অনেক প্রশ্ন করলেন। কেউ কেউ একাই তিন চারটা প্রশ্ন করার সুযোগ পেলেন। মাইক হাতে পেয়ে কেউ কেউ একই প্রশ্ন রিপিট করলেন। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করার কোন সুযোগই পেলেন না। এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় এক সময় প্রশ্ন উত্তর পর্ব শেষ হলো। একজন বললেন, ‘শাহাবুদ্দিন বেলাল ভাই ও ইসহাক কাজল ভাই থাকলে প্রশ্নোত্তর পর্ব আরও জমতো।‘ যাই হোক, প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে সভাপতি এমাদ ভাই সমাপনী বক্তব্যের মাধ্যমে বর্তমান নির্বাহী কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করলেন। এরপর মিডিয়াকর্মীগণ সবাই খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ালেন। দুপুর দেড়টার দিকে লাঞ্চ করার কথা ছিলো, বিকেল চারটা বেজে গেছে, সবাই ক্ষুধার্ত। একজন সিরিয়াল ভঙ্গ করে খাবার নিতেই আরেকজন ‘তুমি জানো আমি জমিদার বাড়ির লোক, তোমাকে ধরে নিয়ে যেতে পারি’- এই বলে হুঙ্কার দিলেন। তখন অন্যজন ‘তুমি কি জানো আমি কসাই ঘরের পোলা; কল্লা ফেলে দিতে জানি’- এই বলে প্রত্যুত্তর করলেন। পেছন থেকে আরেকজন ‘আমরা কি বানের জলে ভাইসা আসছি’- বলে নিজের অস্তিত্ব জানান দিলেন। তাদের হুঙ্কার ও প্রত্যুত্তর শোনে সবাই মজা পেলেন। পেটে ক্ষুধা নিয়েও সবাই একচোট হাসলেন। এক সময় প্লেটে প্লেটে খাবার নিয়ে যে যার মত টেবিলে টেবিলে বসে গেলেন। একদিকে খাওয়া দাওয়া চলছে আরেকদিকে নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী মিলনায়তনের উপরের তলায় ভোট গ্রহণ চলছে। লাঞ্চ ব্রেকে মনসুর ভাইকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। নজরুল ভাই বললেন, ‘মনসুর ভাই ধরা খেয়েছেন। তিনি এক প্যানেলের প্রার্থী পরিচিত সভায় খেয়েছেন আরেক প্যানেলের প্রার্থী পরিচিত সভায় খাননি- এটা একজন দেখে ফেলেছেন এবং তাঁকে নোটিশ করেছেন। শুধু তাইনা যে প্যানেলের খাননি সেই প্যানেলের প্রার্থীগণ এখন তাঁকে চোঁখে চোঁখে রাখছেন। তিনি যে প্যানেলের খেয়েছেন ওই প্যানেলেই ভোট দিবেন বলে সবাই ধরে নিয়েছেন। মনসুর ভাই গ্যাড়াকলে পড়েছেন।‘ শরীফ ভাই ভোট দিতে যাওয়ার আগে কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাইকে খুঁজছেন। নাজমুল ভাই সবার সাথে বুক মিলাচ্ছেন। মিনহাজ ভাই ফাহমিদা নবী এসেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করছেন। মিছবাহ ভাই হান্নান ভাইয়ের সাথে স্পেক্ট্রাম রেডিও নিয়ে কথা বলছেন। আমার মুখে মাস্ক না দেখে একটু দুরে ভিড়ের মধ্যে থেকে মুরাদ ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খান ভাই মার্ক্স কোথায়, মার্ক্স কোথায়?’ আমি বললাম, ‘ভুল কইরা তারে এঙ্গেলসের বাড়িতে রাইখা আসছি।‘ মুরাদ ভাই কী বুঝলেন, জানিনা। তিনি মুচকি হেসে আবার ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। আমি বুক পকেট থেকে মাস্ক বের করে পড়ে নিলাম। পলি আপা দুর থেকে আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে ভোট চাইলেন। পলি আপা এমনিতেই সুন্দরী, আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে। বললাম, আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে। কাউকে সুন্দর বলার পর সাধারণত তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। একদল বিনয়ী, যারা নিশ্চিতও না নিজের সম্পর্কে তারা রিপ্লাই দেন- আরে না, কি যে বলেন, মজা করেন অথবা বাদ দেন তো ভাই। আরেকদল আত্মবিশ্বাসী, যারা নিজেকে সুন্দর মনে করেন, তাঁরা রিপ্লাই দেন- থ্যাংকিউ ভাই, বাসায় আইসেন, অনেকদিন দেখি না আপনাকে, আপনার লেখা কিন্তু নিয়মিত পড়ি, ভাল্লাগে অথবা ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, আপনার মন্তব্য আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। আরেক দল প্রশংসা হালকা ভয়ে নিতেও পারেন না আবার ফেরতও দিতে চান না, তারা একটু ঘুরিয়ে বলেন- ভাই আপনার দৃষ্টি সুন্দর তাই সবাইকেই আপনার কাছে সুন্দর লাগে অথবা এখন একটু স্বাস্থ্যটা খারাপ হয়েছে, নিজের যত্ন নিতে পারি না, আগের ছবি দেখাবোনে। পলি আপা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগেই সালেহ ভাই মাঝখানে ঢুকে ভোট চাইলেন। এই ফাঁকে ক্যাম্পেইনে পিছিয়ে থাকা পলি আপা অন্য ভোটারদের কাছে ভোট চাইতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। আরও দুই সুন্দরী প্রার্থী রুপি আপা ও শাহনাজ আপা যথারীতি ক্যাম্পেইন করছেন। সুন্দরী রেবেকা ভাবীকে দেখলাম বাবু ভাইয়ের জন্য ভোট চাইছেন। পলি আপা, রুপি আপা, শাহনাজ আপা ও রেবেকা ভাবী এই চার সুন্দরী পুরো অডিটরিয়ামের আলো কেড়ে নিয়েছেন। আশেপাশে সুন্দরী নারী থাকলে অনেক পুরুষই আয়নায় মুখ দেখেন, চুল ঠিক করেন। শামীম ভাই আয়নায় মুখ দেখছেন, সুমন ভাই পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুল আচড়াচ্ছেন। বাবু ভাই রেবেকা ভাবীকে ডেকে এনে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রেবেকা ভাবী বাবু ভাইয়ের জন্য আমার কাছে ভোট চাইলেন। আমি মজা করে বললাম, ‘আমি সেই ছোটবেলা থেকে সুন্দরীদের কথা শুনি। আপনি বললে শুধু বাবু ভাইকে না, বাবু ভাইয়ের পুরো অ্যালায়েন্সকে ভোট দিবো অনায়াসে।‘ তিনি হাসলেন। কাওছার ভাই আমার কানে কানে বললেন, ‘ভাবী যেভাবে ক্যাম্পেইন করতেছেন, তিনি এবার বাবু ভাইকে পাশ করিয়েই ছাড়বেন।‘ সাজু ভাইয়ের সাথে দেখা হতেই জিজ্ঞাসা করলেন, অনেকদিন হয় প্রেস ক্লাবের কোন ইভেন্ট নিয়ে আপনার লেখা দেখিনা। লেখালেখি ছেড়ে দিলেন? আমি বললাম, আজ বাসায় ফিরে লিখবো, প্রেস ক্লাবের হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপে চোঁখ রাখবেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎ চোঁখ তুলে দেখলাম, দামী কাপড়ের শার্ট, প্যান্ট, স্যুট আর ঝকঝকে জুতা ও পলিশ করা বুটের শহরে টুপি মাথায় কাঁচা পাকা দাড়ির চৌধুরী ভাই খুবই সাধারণ পোষাকে, সাধারণ জুতা পায়ে মিলনায়তনের এক কোণে মুনি ঋষির মত চুপচাপ বসে আছেন। দুর থেকে দেখলে মনে হয় তিনি ধ্যান করছেন। তাঁকে দেখেও অনেকে না দেখার ভান করছেন। পোষাক দিয়ে তাঁরা মানুষের গুরুত্ব বিচার করছেন। গাত্রবর্ণ, চেহারা, অর্থবিত্তকেই যারা সামর্থ ও চূড়ান্ত যোগ্যতা বলে ভাবেন তারা নির্বোধ। শুদ্ধ, নির্লোভ ও ঋষিটাইপ মানুষ চৌধুরী ভাইকে দেখে আমার ফার্সি কবি শেখ সাদীর কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশিরা কাপড় চোপড় দিয়ে মানুষকে যাচাই করেন। সেটা অবশ্য পৃথিবীর সর্বত্রই আছে, কিন্তু বাঙালিদের কাছে মনে হয় ফর্মাল কাপড় চোপড়, স্যুট টাই এর গুরুত্ব অনেক বেশি। যে কারণে মিলনায়তনের ভেতরে ভ্যাপসা গরম থাকার পরেও আমি আর চৌধুরী ভাই ছাড়া প্রায় সবাই স্যুট টাই পরে বসে আছেন। সহ সভাপতি পদপ্রার্থী তারেক ভাই আর আনিস ভাই তাদের দুই জৈষ্ঠ প্রতিদ্বন্দ্বী মোজাম্মেল ভাই আর রহমত আলী ভাইয়ের প্রতি সন্মান দেখিয়ে মিলনায়তনের ভেতরে ক্যাম্পেইন করা বাদ দিয়েছেন। মুসলেহ ভাই ও তাইসির ভাই দু’জনেই খুব আত্মবিশ্বাস নিয়ে ক্যাম্পেইন করছেন। কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই ও আবদুল হান্নান ভাই পরস্পরকে সন্মান দেখিয়ে ক্যাম্পেইন করছেন। আনোয়ার শাহজাহান ভাই হাতে হাতে লিফলেট দিচ্ছেন। উদয় দা স্বতন্ত্র প্রার্থী জি আর সোহেল ভাইয়ের ক্যাম্পেইন করছেন। তিনি সোহেল ভাইয়ের একটা ছবি বুক পকেটে ঝুলিয়ে রেখেছেন। ক্যাম্পেইন করতে করতে ক্লান্ত হারুন ভাই ও শেবুল ভাই এখন এক কোণে চুপচাপ বসে আছেন। জুয়েল দা চারপাশ ঘুরে ঘুরে ক্যাম্পেইন করছেন। ইউক্রেন আর মৃধা ভাইয়ের অবস্থা মোটামুটি একই রকম লাগছে। রাশিয়ার মতো প্রভাবশালী জুয়েল দা, ইউক্রেনের মতো মৃধা ভাইয়ের সব দখল করে নেওয়ার জন্য চারপাশ ঘিরে ফেলেছেন এবং সৈন্য সমাবেশ করছেন। তবে ইউক্রেনের মতো মৃধা ভাই একা না। তাঁর অ্যালায়েন্সে আমেরিকা, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মতো প্রভাবশালী এমাদ ভাই, তাইসির ভাই ও জুবায়ের ভাইটাইপ লোকজন আছেন। যারা আছেন সতর্ক অবস্থানে। ছাড় দেবেন না। বেদনার বিষয়, রাশিয়া ইউক্রেন সংকটের মাঝ খানে কাইয়ুম ভাই-পলি আপা ও তানিম ভাই সংকট কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। নতুন ভোটারদের কয়েকজন জায়েদ খানের মত চাদর গায়ে দেয়া প্রার্থী খুঁজছেন। শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী জায়েদ খান নাকি চাদরের নিচ দিয়ে ভোটার প্রতি দুই হাজার টাকা করে দিয়েছেন। প্রেস ক্লাবের সাংবাদিক প্রার্থীরাও যদি চাদরের নিচ দিয়ে কিছু দেন, এই আশায় নতুন ভোটাররা ঘুরছেন। আলী ভাই কানে কানে বললেন, ‘আফসার উদ্দিন ভাই একটু আগে বাবু ভাইকে একটা টাইয়ের প্যাকেট গিফট দিয়েছেন, প্যাকেটে প্রায় ডজনখানেক টাই আছে।‘ বাবু ভাই এত টাই দিয়ে কী করবেন জানিনা। তবে বাবু ভাইয়ের বউ রেবেকা ভাবীকে ক্যাম্পেইন করতে দেখে মনে হচ্ছে বাবু ভাই শুধু পাশই করবেন না, বরং সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন। নিচ তলায় চামচের টুংটাং আওয়াজের মাঝে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি ক্যাম্পেইন চলছে, কেউ ভোট দিয়ে এসে খাচ্ছেন, আবার কেউ খাওয়া শেষ করে ভোট দিতে যাচ্ছেন। উপরের তলায় প্রবেশ মুখে সিড়িঁর পাশে জায়নামাজসহ নামাজ পড়ার সুন্দর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। নামাজী মানুষ সেখানে নামাজ আদায় করছেন। আমি আছর নামাজ আদায় শেষে ভোট দিয়ে এসে লাঞ্চ করার কথা ভাবছিলাম। এই সময় সেলিম ভাই এসে বলছেন, নামাজ শেষ করেছেন এখন চলেন আগে খেয়ে নেই। তারপরে ভোট দেই। আগে ভোট দিলে দাম কমে যাবে। যতক্ষণ ভোট না দিবেন, প্রার্থীরা এসে আপনার কাছে ভোট চাইবেন। ভোট দেওয়া শেষ হয়ে গেলে আর কেউ এসে ভোট চাইবেন না। আমি তাঁর শিশুসূলভ কথা শোনে হাসলাম। এই সময় মাহবুব ভাই এসে আমাদের আলোচনায় যোগ দিলেন। কথা শেষে আমরা তিনজন খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। দশ মিনিটের মত লাইনে দাঁড়িয়ে ট্রেতে সাজিয়ে রাখা খাবার থেকে প্লেটে পরিমাণমত খাবার তুলে নিয়ে আমরা কাছের একটা টেবিলে খাবার রেখে চেয়ারে বসলাম। আমাদের টেবিলে আরও তিনজন খাচ্ছেন আর গল্প করছেন। আমার পাশের জনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ভোট দিয়েছেন?’ তিনি আমার কানে কানে বললেন, ‘মাত্র চারজনকে ভোট দিয়েছি।‘ বললাম, ‘কেনো?’ তিনি বললেন, ‘এই চারজন ছাড়া আর কাউকে আমি যোগ্য প্রার্থী মনে করিনা। অ্যালায়েন্স করে যে কাউকে দাঁড় করিয়ে দিলেই ভোট দিবো, আমার ভোট এত সস্তা না। দুই অ্যালায়েন্সেই জায়েদ খানের মত প্রার্থী আছে, কথা বেশি কয়, কাজ করে না। সব বেবাট, বেদিশা।‘ বলতে বলতে তিনি গোটা দুইটা কাবাব একসাথে মুখে পুরে দিলেন। আমি তাঁর বলা বেবাট ও বেদিশা শব্দে আপত্তি করলাম। বললাম, ‘আপনার যাকে ইচ্ছা ভোট দিবেন, যাকে ইচ্ছা দিবেন না, এটা আপনার স্বাধীনতা। কিন্তু কোন মানুষকে আপনি বেবাট, বেদিশা বলতে পারেন না। কাউকে অসন্মান করে কথা বলা ঠিক না।’ মাহবুব ভাই এক ভাবীর সাথে গল্প করতে করতে আস্তে আস্তে খাচ্ছেন। তিনি কিছু খেয়াল করছেন না। আমি তড়িঘড়ি খাওয়া শেষ করে দেখি টেবিলে পানি নেই। পানির কথা বলায় এমরান ভাই আমাকে পানির একটা বোতল এনে দিলেন। নজরুল ভাই এমরান ভাইকে নায়িকাদের মত করে বললেন, ‘এভাবেই সবসময় পাশে থাকবেন ভাইয়া।‘ বাবুল ভাই কেউ খাওয়ার বাকি আছে কিনা জিজ্ঞাসা করলেন। মাহমুদ ভাই এমাদ ভাইকে দেখে বললেন, ‘ভাই গত দুই বছর আপনার পারফর্মেন্স ভালো ছিলো, আপনি পাস করবেন।’ এমাদ ভাই শোনে খুব খুশি হলেন। রাতে আমন্ত্রিত অতিথিরা দুপুর থেকেই শাবিপ্রবির উপাচার্যের মতো মিলনায়তনে জেঁকে বসেছেন। কয়েকজন দাওয়াতে এসেও তাঁদের কোম্পানীর আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। গায়ে হলুদে, বিয়ের দাওয়াতে গিয়েও তাঁরা কোম্পানির আইডি কার্ড ঝুলিয়ে রাখতে পারেন বলে মনে হচ্ছে। কোথাও একটু পা ফেলার জায়গা নেই। আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে মিলনায়তনে উপস্থিত অতিথিদের পর্যবেক্ষণ করছি। সাধারণ সভা ও মধ্যাহ্ন ভোজ শেষ হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাগরিব নামাজের কথা ভেবে আমি কর্ণারের একটা টেবিলে ব্যাগ রেখে অজু করার জন্য ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি গজব পড়েছে। হাগু করে ফ্লাশ করেনা, পানি ঢালেনা এমন মানুষও জগতে আছে! কমোডে পানি ঢালার ব্যাপারেও কেউ এতো আলসেমি করে! বাসা বাড়িতে আপনি পানি না ঢেলে জিয়োল রাখেন, নো প্রবলেম, কিন্তু যেখানে অনেক মানুষ ব্যবহার করে সেখানে পানি ঢালাটা খুবই জরুরি। পাশেরটাতে গেলাম, দেখলাম এখানে পানি ঢেলেছে, তবে গোলাবারুদ সব কমোডে লেগে আছে। নিরুপায় হয়ে উপরের তলার ওয়াশরুমটাতে গেলাম। দেখলাম সেখানের অবস্থা আরও বেশি খারাপ। কারও হয়তো ডায়রিয়া হয়েছে। কমোডে একেবারে ব্রাশ ফায়ার করেছে। তায়াম্মুম করে মাগরিব নামাজ পড়ে ফিরে এসে দেখি ব্যাগ নেই। প্রেস ক্লাব থেকে প্রাপ্ত ব্যাগের ভেতরে আমার সানগ্লাস রেখেছিলাম। দেখলাম, এক সুন্দরী রমণী আমার সেই সানগ্লাস পড়ে আইফোন দিয়ে সেলফি তুলছেন। আমার আর চাইতে ইচ্ছা হলো না। ফেইসবুক মেসেন্জারে অনেক মেসেজ জমে আছে। আমি পাশের টেবিলের একটা সিট খালি পেয়ে বসলাম। বসে এক এক করে মেসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিলাম আর আড়চোঁখে সেই রমণীকে দেখছিলাম। এমন সময় দেখি আমার পাশের সিটে বসা ডাকু চেহারার একজন একমনে আমার আঙুলের নাড়াচাড়া দেখছেন। কিছুক্ষণ পর ভালোভাবে তাকিয়ে দেখি, তিনি আমার নতুন মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার ফেইসবুকের মেসেজ দেখছেন। কোনোভাবেই তাকে নিবৃত্ত করতে না পেরে আমি ডিপজলের সাথে আমার ছবিটি এনে সামনে রাখলাম। প্রথমবার একটু তাকিয়ে তারপর থেকে আর তাকাচ্ছেন না। গভীর মনযোগ সহকারে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। মনে হচ্ছে, বাইরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস দেখছেন। ইতোমধ্যে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম ও ব্রিটিশ বাংলাদেশি কনিষ্ঠ এমপি আপসানা বেগম অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। এছাড়া কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে ও দ্বিতীয় পর্বের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে এসেছেন। কেউ কেউ শুধু ফাহমিদা নবীর গান শুনতে এসেছেন। লণ্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের নির্বাচন দেখতে সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক তাসনিম খলিল ও আল জাজিরার অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার’স ম্যান এর হুইসেল ব্লোয়ার শায়ের জুলকারনাইন সামিও ‘ইমপ্রেসন ইভেন্ট ভেন্যু’তে এসেছেন। গেইটে প্রবেশের সাথে সাথে সাংবাদিকরা কেউ কেউ তাদের সাথে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বিলেতের একমাত্র নায়ক সেতু ভাইয়ের সাথেও অনেকেই ছবি তুলছেন। তিনিও হাসিমুখে পোজ দিচ্ছেন আর কেউ বাদ পড়ে গেলো কিনা ঘুরে ঘুরে চেক করছেন। একসময় তাসনিম খলিল ভাই ও জুলকারনাইন সামি ভাইয়ের সাথে কুশল বিনিময় হলো। তাঁরা দুজন নির্বাচন বিষয়ে জানতে চাইলেন। তাদের সাথে নির্বাচন নিয়ে কথা হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকতা নিয়ে কথা হলো। ঢাকার সাংবাদিকতা যেমন প্রশ্ন করার শক্তি হারিয়েছে, তেমনি সেলফ সেন্সরশিপেও অনেকটা কাবু। দেশে সাংবাদিক সংখ্যা কতো হলফ করে বলা কঠিন। সাংবাদিকদের সংগঠনও অসংখ্য। তবে বার্ষিক পিকনিক ছাড়া এসব সংগঠনের তেমন কোনো কাজ চোঁখে পড়ে না। সাংবাদিকতা মানুষের কথা বলে, জীবনের কথা বলে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা কতোটা তা বলতে পারছে তা বিরাট প্রশ্ন বটে। তাসনিম খলিল ভাই বাংলাদেশে তৈরি হওয়া নতুন ডকট্রিনের কথা বললেন। হয় আপনি সরকারের পক্ষে, না হয় বিপক্ষে। অথচ এর বাইরে বাস করে লাখ লাখ জনগোষ্ঠী। জুলকারনাইন সামি ভাই বললেন, শেখ হাসিনার সরকার অসামরিক স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। এ সরকারের অধীনে যদি কোনো স্বর্গীয় দূতকে এনেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার করে নির্বাচন করা হয়, সে নির্বাচনের ফল শেখ হাসিনার ইচ্ছারই প্রতিফল হিসেবে আবির্ভুত হবে। কথা শেষে তারা মিলনায়তনে প্রবেশ করলেন। লিটন ভাই, বুলবুল ভাই, সালাহ উদ্দীন ভাই, নোমান ভাই ও অন্যান্য সাংবাদিকদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে তাঁরা দু‘জন চলে গেলেন। কামাল মেহেদী ভাইকে মিলনায়তনে প্রবেশ করতে দেখে অনেকেই মিলন ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। ম্যানচেষ্টার থেকে আগত সাংবাদিকদের দেখে অনেকেই মিজান ভাইয়ের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তরে তাঁরা মিজান ভাইয়ের দেশে যাওয়ার কথা জানালেন। অ্যাসিস্টেন্ট ট্রেজারার প্রার্থী কাইয়ুম ভাইয়ের বিখ্যাত সেলিব্রেশন নিয়ে মিলনায়তনে অনেকেই অনেক মজা করলেন। কাইয়ুম ভাইয়ের সার্পোটারেরা বললেন, পলি আপা বা তানিম ভাই যদি পাশ করেন তাহলে দর্শকেরা কাইয়ুম ভাইয়ের বিখ্যাত সেলিব্রেশন দেখার সুযোগ হারাবেন। একজন ভোটার বললেন, কাইয়ুম ভাইয়ের সেলিব্রেশন দেখার জন্যই তিনি তাকে ভোট দিবেন। পলি আপার সাপোর্টারেরা বললেন, পলি আপাই পাস করবেন। তানিম ভাইয়ের সাপোর্টারেরা বললেন, কাইয়ুম ভাই, পলি আপা দু’জনের কেউই না, তানিম ভাই-ই বাজিমাত করবেন। মিলনায়তনের ভেতর থেকে একজন খালেদ মাসুদ নাম ধরে জোরে ডাক দিলে ক্রিকেটার খালেদ মাসুদ পাইলট এসেছেন ভেবে সবাই গেইটের দিকে তাকালেন। একটু পরে গেইট দিয়ে খালেদ মাসুদ রনি ভাই ঢুকলেন। রনি ভাইকে দেখে সবাই হাসলেন। লিটন ভাই ভিড়ের মাঝে ভাবীকে হারিয়ে ফেলেছেন। এদিক ওদিক হন্যে হয়ে খুঁজছেন। সামনে যাকে পাচ্ছেন তাকেই জিজ্ঞাসা করছেন। ভাবীকে কোথাও দেখেছি কিনা, আমাকেও জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, ‘আজকাল বউ হারালে মানুষ খুশি হয়। আপনি কেনো মন খারাপ করছেন?’ লিটন ভাই মুচকি হাসলেন। ভাবীর প্রতি লিটন ভাইয়ের ভালোবাসা অনেকেই অনুভব করলেন। হোয়াসঅ্যাপ গ্রুপে সাজিদ রানা ভাইয়ের একটা মেসেজ বের করে একজন আমাদেরকে দেখালেন। ব্যক্তি আক্রমণ করে ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পোস্ট দেওয়ায় অনেকেই তাকে বাজে ক্যাম্পেইনারের স্বীকৃতি দিলেন। একইসাথে কাউকে ব্যক্তি আক্রমণ না করে ক্যাম্পেইন করায় মাসুম ভাইকে অনেকেই সেরা ক্যাম্পেইনারের স্বীকৃতি দিলেন। মোস্তাক বাবুল ভাই উনার শ্যালিকা শাহনাজ আপার জন্য আমার কাছে ভোট চাইলেন এবং শাহনাজ আপা জিতলে ফাইভ স্টার হোটেলে খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমি বললাম, আরে ভাই আপনার শ্যালিকা হইলো নৌকা মার্কা। আপনার কি আর ভোট চাওয়া লাগে! কেউ ভোট দিক আর না দিক, আপনার শ্যালিকা পাশ করবেন ঠিকই। আমন্ত্রিত অতিথিদের কয়েকজন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কখন শুরু হবে হামিদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন। হামিদ ভাই এমাদ ভাইকে অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দ্রুত শুরু করার তাগিদ দিলেন।
মাগরিবের পর আমন্ত্রিত অতিথিদের পদচারণায় মুখরিত মিলনায়তনের সুধীমণ্ডলীকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে উর্মি আপা অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু করলেন। উর্মি আপাকে স্টেইজে দেখে হঠাৎ একজন বাসন ভাইয়ের কথা তুলে বললেন যে, উর্মি আপা যে অনুষ্ঠানে থাকেন সেই অনুষ্ঠানে বাসন ভাই থাকেন না। আবার বাসন ভাই যে অনুষ্ঠানে থাকেন উর্মি আপা সেই অনুষ্ঠানে থাকেন না। আমি শুধু শোনে গেলাম। সত্যি বললেন, নাকি আমার সাথে মজা করলেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। মঞ্চে উর্মি আপা কথা বলছেন, আজকের এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সবাই অপেক্ষা করছেন খুব প্রিয় একজন শিল্পীর জন্য। ফাহমিদ নবী, নামটিই যথেষ্ট, ভালোলাগার, ভালোবাসার একজন শিল্পী, বাংলা আধুনিক গানকে একটা বহুমাত্রিকতা দিয়েছেন এই শিল্পী। ধন্যবাদ জানাচ্ছি এমাদ ভাই, জুবায়ের ভাইসহ পুরো এক্সিকিউটিভ কমিটিকে, আমাদেরকে ফাহমিদা নবীর গান শোনার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এই কথা বলে তিনি প্রথমে সদ্য বিদায়ী এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বারদের মঞ্চে ডেকে নিলেন। তারপর হাইকমিশনার মুনা তাসনিম ও বৃটিশ বাংলাদেশি এমপি আপসানা বেগমকে ডেকে মঞ্চে নিলেন। এরপর ফাহমিদা নবীকে মঞ্চে ডেকে নিয়ে তাঁর নেতৃত্বে মিলনায়তনে উপস্থিত সবাই সমবেত কন্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাইলেন। ক্লাবের নিজস্ব দুই শিল্পী আকবর হোসেন ভাই ও ফারুক ভাইকে ফাহমিদা নবীর সাথে জোরে জোরে কন্ঠ মেলাতে শোনা গেলো। খালিদ ভাইকে ঘুরে ঘুরে সবার ছবি তুলতে দেখা গেলো। জাতীয় সঙ্গীত শেষে উর্মি আপা কবিতা আবৃত্তি করলেন, হিলিয়াম গ্যাস ভরা রঙিন বেলুন…। এরপর ফাহমিদা নবী পরপর দু‘টা দেশের গান ‘ও আমার দেশের মাটি’ এবং ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য’ গাইলেন। গানের বিরতিতে ক্লাবের পক্ষ থেকে লাইফ মেম্বার, কর্পোরেট মেম্বার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মাননা দেওয়া হলো। জুবায়ের ভাইয়ের উপস্থাপনায় এই পর্বে বক্তব্য রাখলেন মাননীয় হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম। তিনি তাঁর বক্তব্যের শুরুতে বললেন, ‘আই উড ফার্স্ট লাইক টু কনগ্রাচুলেট লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাব’। তারপর বললেন, ‘আমি একটু ইংলিশে বলছি, কিছু মনে করবেন না। কিছু ইয়াং জেনারেশন এখানে আছেন। আমি জানি বাংলা অনেকে বুঝেনা, সিলেটি বুঝে। সো আই উইল স্পিক ইন ইংলিশ।’ এরপর বরাবর উনি যা বলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই করেছেন, সেই করেছেন, সাংবাদিক ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা দিয়েছেন ইত্যাদি বলে বক্তব্য শেষ করলেন। উনার বক্তব্য শেষে দর্শক সারিতে বসা হোসেন ভাই ফিক করে হেসে দিলেন। সিলেটি ভাষা বাংলা ভাষার অন্তর্গত একটি আঞ্চলিক ভাষা হওয়া সত্বেও তিনি বাংলা এবং সিলেটিকে আলাদা করলেন, কেউ খেয়ালই করলেন না! মঞ্চে জুবায়ের ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি আপনার সাইজ ডাবল করেছেন?’ জুবায়ের ভাইয়ের প্রশ্নে অনেকেই মজা পেলেন, হাসাহাসি করলেন। তিনি কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেন। পরে অবশ্য জুবায়ের ভাই সামলে নিলেন। হাইকমিশনার তাঁর বক্তব্যে সম্প্রতি হাইকমিশনের পার্শ্ববর্তী ভবনের একটি ফ্লাট কিনে কার্যালয়ের পরিসর বাড়ানোর কথা বলেছেন। জুবায়ের ভাই ওই ভবনের কথাই জিজ্ঞাসা করেছেন। যাই হোক, এই পর্বে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাটাগরিতে ক্লাব সদস্য মোজাম্মেল হক কামাল ভাই, মুসা হাসান ভাই ও সুজা মাহমুদ ভাই এবং মুক্তিযুদ্ধে মাঠ পর্যায়ে দাতাসংস্থা অক্সফামের কর্মী হয়ে কাজ করার জন্য ক্লাব সদস্য উদয় শংকর দা, কর্পোরেট সদস্য হিসেবে ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সভাপতি মুহিব ভাই ও করোনাকালে কমিউনিটিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ক্লাব সদস্য ডা: জাকী রেজওয়ানা আপা ও মাহী মাসুম ভাই বিশেষ সন্মাননা পেলেন। সন্মাননা বিরতির পর আবার শুরু হলো গান। ফাহমিদা নবীর হাত ধরে যাত্রা করা ‘ক্লোজআপ ওয়ান তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ- ২০১২’ এর তারকা নতুন প্রজন্মের শিল্পী রানা খান গাইলেন ‘যেখানে সীমান্ত তোমার‘ ও ‘দিন যায় কথা থাকে‘ এই দুটো গান। রানা খানের গান শেষ হলে আবার শুরু হলো সন্মাননা পর্ব। এই পর্বে বক্তব্য রাখলেন বৃটিশ বাংলাদেশি কনিষ্ঠ এমপি আপসানা বেগম। মঞ্চে ক্লাবের লাইফ মেম্বারদের সন্মাননা দেওয়ার পাশাপাশি আপসানা বেগম এমপিকেও সন্মাননা দেওয়া হলো। আপসানা বেগমের হাতে সন্মাননা স্মারক তুলে দিলেন ক্লাবের সদ্য বিদায়ী সভাপতি এমাদ ভাই। সন্মাননা পর্ব শেষে ফাহমিদা নবী মঞ্চে এসে তাঁর কিন্নর কন্ঠে প্রথমে গাইলেন ‘আকাশ খুলে বসে আছি তাও কেন দেখছ না।’ কবি সৈয়দ রুম্মান ভাই মঞ্চের সামনে গিয়ে ফাহমিদা নবীর নাচ গানের ভিডিও করছেন। মঞ্চের পাশের টেবিলে বসা আরেক কবি বলছেন, ‘জীবনের কোন নির্বাচনে তিনি হারেন নাই। কারণ তিনি যোগ্য প্রার্থী।’ আচ্ছা, ভোট দিয়ে কি মানুষের যোগ্যতা অযোগ্যতা বিচার হয়? বাংলা ভাষার সবচাইতে অসাম্প্রদায়িক, সবচাইতে বড় মানবতাবাদী, সর্বাধিক জনসম্পৃক্ত, সবচাইতে গণমুখী চিন্তার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ভোটে দাঁড়িয়ে জামানত হারিয়েছিলেন। কাজেই বাঙালির ভোটের রাজনীতি নিয়ে যারা আস্ফালন করে, তাদের লজ্জা পাওয়া উচিত। যাই হোক, ‘আকাশ খুলে বসে আছি তাও কেন দেখছ না’ এই গানের পর ফাহমিদা নবী একে একে গাইলেন- তুমি যে আমার কবিতা, তুমি কখন এসে দাঁড়িয়ে আছো আমার অজান্তে, লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প। এরপর আবার শুরু হলো সন্মাননা পর্ব। এই পর্ব শেষে মঞ্চে এসে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গান পরিবেশন করলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ডা: অরুপ রতন চৌধুরী। ডিনারের সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। ভোটদান প্রক্রিয়াও প্রায় শেষের পথে। সবার অসম্ভব ক্ষুধা লেগেছে। বেলাল ভাই বললেন, ‘খান ভাই, পেটর মাঝে যে বুক করের’। অর্থাৎ পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। ফারহান ভাই জুবায়ের ভাইকে ডিনার পরিবেশন করার অনুরোধ করলেন। জুবায়ের ভাই ফারহান মাসুদ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ফারহান ভাই আপনি এখানে কী জন্য এসেছেন?’ জবাবে ফারহান মাসুদ ভাই বললেন, ‘খাবারের জন্য এসেছি।‘ সবাই হাসলেন। জুবায়ের ভাই বললেন, ‘একটু পরে ডিনার পরিবেশন করা হবে’। এরপর জুবায়ের ভাই কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে মঞ্চে এসে সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখার অনুরোধ করলে নেতৃবৃন্দ মঞ্চে এসে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিলেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষে ফাহমিদা নবী মঞ্চে এসে মাসুম ভাইয়ের লেখা ‘ছুঁই না ছুঁই, পড়ে থাকা জুঁই’ গানের কয়েক কলি গাইলেন, এরপর গাইলেন ‘আমায় ডেকোনা, ফেরানো যাবেনা, ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরে না।’ সাংস্কৃতিক আয়োজন শেষ হতে হতে ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় রাত দশটা। এ সময় ডিনার পরিবেশন করা হলো। দর্শক শ্রোতারা খাচ্ছেন আর গান শোনছেন। গানের ফাঁকে ফাহমিদা নবী জুবায়ের ভাইয়ের সাথে মজা করছেন। জুবায়ের ভাইকে মঞ্চে ডেকে বলছেন যে, জুবায়ের ভাইয়ের কথায় তিনি একদিনে পাসপোর্ট করেছেন। এরপর জুবায়ের ভাইয়ের উপস্থাপনার প্রশংসা করে হঠাৎ তাঁর সাথে গাইতে অনুরোধ করলেন। জুবায়ের ভাই লজ্জায় মুখ ঢাকলেন। সব শেষে ফাহমিদা নবী ‘ধন ধান্যে পুস্পে ভরা’ গান গেয়ে একরাশ মুগ্ধতা ছড়িয়ে তাঁর পরিবেশনা শেষ করলেন। শেষ গানে ফাহমিদা আপাকে সঙ্গ দিলেন জুবায়ের ভাই, সাত্তার ভাই, মিছবাহ ভাই, রহমত আলী ভাই, তাইসির ভাই, এমাদ ভাই ও মৃধা ভাই। আমাদের টেবিলে খাবার দেওয়ার সাথে সাথেই দেখি সব শেষ। সবাই খুব ক্ষুধার্ত। নীচ তলায় যখন রাতের খাবার পরিবেশিত হচ্ছিল উপরের তলায় তখন ভোট গ্রহণ শেষে, ভোট গণনা চলছে। জয় পরাজয়ের কথা ভেবে প্রার্থীদের সবার চোঁখে মুখে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই আছেন খুব টেনশনে। প্রার্থীরা একবার উপরে উঠছেন আবার নিচে নামছেন। কেউ কেউ ঘামছেন। যে কোনো ফলাফল ঘোষণায় এক ধরনের টেনশন কাজ কাজ করে। এই টেনশনের একটা পজেটিভ দিক, এসময় যা সামনে থাকে তা খেয়ে টেনশনকাল কাটানো যায়। কিন্তু টেবিলে পর্যাপ্ত খাবার নেই। যারা খাবার পেয়েছেন তারা খাবারের মান ও পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আমাদের টেবিলের সবাই এখনো খাবার পাননি। প্রথমবার যা দিয়ে গেছে, দ্বিতীয়বার আর কেউ আসেনি। মাসুদুজ্জামান মাসুদ ভাই ও জুবায়ের আহমেদ ভাই উপর থেকে নেমে অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি পদে দুই প্রার্থীর ভোট সমান হওয়ার খবর জানিয়ে গেলেন। এই সমস্যার সমাধানের চিন্তা করে হক ভাই টেনশন করছিলেন। আমি বললাম, ব্যাপার না। কোন টেনশন নিয়েন না। দুই প্রার্থীর ভোট যদি সমান হয় তাহলে সাঈম ভাইকে এলবিপিসি উত্তর ও ইব্রাহিম খলিল ভাইকে এলবিপিসি দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করে তাদের বসিয়ে দেওয়া যাবে। হক ভাই হাসলেন। একটু পর বাবুল ভাই খবর নিয়ে এলেন যে, ইব্রাহিম খলিল ভাই এক ভোটে এগিয়ে আছেন। তার কিছুক্ষণ পর শাহিন ভাই খবর নিয়ে এলেন যে, ভোট পুনর্গণনায় সাঈম ভাই এক ভোটে এগিয়ে আছেন। এক ছোটভাই বলল, ভাই, ইব্রাহিম খলিল ভাইয়ের সাথে ছবি ছিলো, সেটা নিয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু সাঈম চৌধুরী ভাইয়ের সাথে তো ছবি নাই। কী করবো? আমি বললাম, ওইটার মধ্যেই সাঈম ভাইয়ের মাথা কেটে ফটোশপ করে দাও। কেউ ধরতে পারবেনা। সারওয়ার হোসেন ভাইকে দেখলাম হাসিমুখে উপর থেকে নিচে নামছেন। সারওয়ার ভাইকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, তিনি পাসের আগাম খবর পেয়েছেন। সারওয়ার ভাইকে আগাম অভিনন্দন জানিয়ে বললাম, এবার আমাদের টেবিলে খাবার দিতে বলেন, এই টেবিলের সবাই খাবার পায়নি। সারওয়ার ভাই টেবিলে খাবারের ব্যবস্থা করলেন। সামনের দিকের টেবিলগুলোতে বসা শাকিল ভাই, হাফিজ ভাই, মিলন ভাই ও সাইফ ভাইদের খাওয়া শেষ হতে দেখে মাহবুব খানশূর ভাই বললেন, আগামীতে সামনের দিকে বসতে হবে। সামনের দিকের টেবিলে ওয়েটারদের নজর যতটা বেশি থাকে, পেছনের দিকের টেবিলে ততটা থাকেনা। খাবার দাবারের ব্যাপারে আমি সব সময়ই মাহবুব খানশূর ভাইয়ের পরামর্শ মেনে চলি। আমি বললাম, তথাস্তু। মাহফুজ ভাইও মাহবুব খানশূর ভাইয়ের প্রস্তাব সমর্থন করলেন। আমার ডান দিকের ও বাম দিকের সবাই প্রায় খাওয়া শেষ করেছেন। এই সময় হঠাৎ মিট বিরিয়ানিতে মিটের একটা ছোট্র টুকরো দেখে আমার কেমন যেনো সন্দেহ হলো। ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম আমি যা সন্দেহ করেছিলাম, ঠিক তাই। ভাবলাম এখন যদি সবাইকে বলি তাহলে যারা মিট বিরিয়ানি খেয়েছেন তাদের অনেকেই বমি করবেন। আর যারা এখনও খাচ্ছেন, তারা ওয়াক থু বলে উঠে যাবেন। একটা অন্যরকম সিন ক্রিয়েট হবে। নির্বাচনের এই সুন্দর পরিবেশটা মুহুর্তেই নষ্ট হয়ে যাবে। আমি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আস্তে করে ইদুরের লেজটা বের করে ফেলে দিলাম। এরপর খাওয়া শেষ করে উঠে গেলাম। খাবার পরিবেশন শেষ হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বজলুর রশীদ এমবিই’র নেতৃত্বে অপর দুই নির্বাচন কমিশনার আজিজ চৌধুরী ও আনোয়ার বাবুল মিয়া মঞ্চে এলেন। অবশেষে এলো সেই কাঙ্খিত মুহূর্ত। পিনপতন নিস্তব্ধতায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মিলনায়তনে উপস্থিত সকলের সামনে দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষণা করলেন। সভাপতি পদে ১৮২ ভোট পেয়ে এমাদ ভাই পুন:নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আব্দুস সাত্তার ভাই পেয়েছেন ১২৮ ভোট। সাধারণ সম্পাদক পদে ১৭৬ ভোট পেয়ে প্রথমবারের মত নির্বাচিত হয়েছেন তাইসির ভাই। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মোসলেহ উদ্দিন ভাই পেয়েছেন ১৩১ ভোট। কোষাধ্যক্ষ পদে ১৭৮ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন সালেহ আহমদ ভাই। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আব্দুল কাদির চৌধুরী মুরাদ ভাই পেয়েছেন ১২০ ভোট। জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি পদে তারেক ভাই পেয়েছেন ১৯৮ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী মোজাম্মেল হোসেন কামাল ভাই পেয়েছেন ১০৮ ভোট। সহ সভাপতি পদে রহমত আলী ভাই পেয়েছেন ১৭১ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আনিসুর রহমান আনিস ভাই পেয়েছেন ১২৮ ভোট। সহ-সাধারণ সম্পাদক পদে সাঈম ভাই পেয়েছেন ১৫৫ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ইব্রাহিম খলিল ভাই পেয়েছেন ১৫৪ ভোট। সহকারী কোষাধ্যক্ষ পদে আব্দুল কাইয়ুম ভাই পেয়েছেন ১২৫ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী আমিমুল আহসান তানিম ভাই ও মরিয়ম পলি আপা পেয়েছেন যথাক্রমে ৯৬ ভোট ও ৮৫ ভোট। সাংগঠনিক ও প্রশিক্ষণ সম্পাদক পদে ইমরান আহমেদ ভাই পেয়েছেন ১৬১ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী রুপি আমিন আপা পেয়েছেন ১৪৪ ভোট। গণমাধ্যম ও তথ্য-প্রযুক্তি সম্পাদক পদে আব্দুল হান্নান ভাই পেয়েছেন ১৫৭ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই পেয়েছেন ১৪৯ ভোট। ইভেন্ট এন্ড ফ্যাসিলিটিজ সম্পাদক পদে রেজাউল করিম মৃধা ভাই পেয়েছেন ১৭৪ ভোট। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জুয়েল শেখর দা পেয়েছেন ১৩১ ভোট। এছাড়া নির্বাহী সদস্য পদে আহাদ চৌধুরী বাবু ভাই পেয়েছেন ২১৬ ভোট, নাজমুল হোসেন ভাই পেয়েছেন ১৭৩ ভোট, আনোয়ার শাহজাহান ভাই পেয়েছেন ১৫৪ ভোট, সারওয়ার হোসেন ভাই পেয়েছেন ১৪৮ ভোট, শাহনাজ আপা পেয়েছেন ১৪৭ ভোট, আজিজুল হক কায়েস ভাই পেয়েছেন ১৩২ ভোট, শহীদুর রহমান সোহেল ভাই পেয়েছেন ১৩১ ভোট, জি আর সোহেল ভাই পেয়েছেন ৯৮ ভোট, শেবুল চৌধুরী ভাই পেয়েছেন ৮৯ ভোট, হারুন অর রশীদ ভাই পেয়েছেন ৭৮ ভোট, কলন্দর তালুকদার ভাই পেয়েছেন ৫২ ভোট ও রুমান বখত ভাই পেয়েছেন ২৭ ভোট। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার পর দেখলাম সবচেয়ে কম ভোট পেয়েও স্বতন্ত্র প্রার্থী রুমান বখত ভাই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ‘আমাকে সব ভিআইপি ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। নাহাস ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, উদয় দা আমাকে ভোট দিয়েছেন, মোয়াজ্জেম ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, নবাব ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, বেলাল ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, লিটন ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, নোমান ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, বুলবুল ভাই আমাকে ভোট দিয়েছেন, আপনিও আমাকে ভোট দিয়েছেন।‘ কে কাকে ভোট দিয়েছেন আমি জানিনা। তবে রুমান ভাইয়ের হাসি খুশি চেহারা দেখে খুবই ভালো লেগেছে। অ্যাসিস্টেন্ট ট্রেজারার প্রার্থী আবদুল কাইয়ুম ভাইয়ের পাশ করার খবর শোনেই পলি আপা ও তানিম ভাই সটকে পড়েছেন। যারা কাইয়ুম ভাইয়ের সেই বিখ্যাত সেলিব্রেশন দেখার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তারা খুব হতাশ হলেন। সাঈম ভাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ধন্যবাদ খান ভাই। আপনার জন্যই আমি পাস করলাম।’ হঠাৎ কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাইকে দেখলাম সর্বপ্রথম ছুটে গিয়ে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আব্দুল হান্নান ভাইকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন। অভিনন্দন জানালেন! এই দৃশ্য দেখে সবাই কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাইয়ের প্রশংসা করলেন। এক বাক্যে সবাই বললেন, ‘কাইয়ুম ভাই ও হান্নান ভাই দু’জনেই খুব ভালো মানুষ, সাংগঠনিক মানুষ। এই দুইজন যদি দুই পদে নির্বাচন করতেন, তাহলে দু’জনেই বিপুল ভোটে পাস করতেন। এই দুইজনই কমিটিতে থাকলে নির্বাহী কমিটি আরও বেশি শক্তিশালী হতো।‘ ততক্ষণে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। অভিনন্দনের পালা ও শুভেচ্ছা বক্তব্য শেষে বিজয়ী প্রার্থীরা মঞ্চে গ্রুপ ছবি তুলছেন। আমি বাইরে বেরিয়ে এসে দেখি একজন প্রার্থী অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। আমাকে দেখে চোঁখ মুছে বললেন, ‘জীবনের প্রথম নির্বাচনেই পরাজিত হলাম।‘ আমি তাকে বললাম, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন থেকে দেখলাম, যে জায়েদ খানের ছবি পোস্টারে থাকলে সিনেমা ফ্লপ। সে জায়েদ খানের ছবি ইউটিউবের থাম্বনেইলে থাকলে কন্টেন্ট হিট। প্রতিটি মানুষ কোথাও না কোথাও বিজয়ী হয়। তাছাড়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তাঁর ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ তে বলেছেন, ‘A man can be destroyed but not defeated.’ তিনি বললেন, আপনার ভাবীও খুব কষ্ট পেয়েছে। আমাকে আর এক মুহুর্ত এখানে না থেকে বাসায় চলে যেতে বলেছে। আমি বললাম, লেনার্ড কোয়েনের গানে আছে, যুদ্ধে প্রায় সব কিছু শেষ। মৃত্যু পথযাত্রী এক ক্যাপ্টেনকে তাঁর সৈনিক জিজ্ঞেস করছে – I’m leaving, Captain, and I’ve got to go/There’s blood upon your hand/But tell me, Captain, if you know/Of a decent place to stand. উত্তরে কোয়েনের ক্যাপ্টেন বলছেন- There is no decent place to stand/In a massacre/But if a woman take your hand/Then go and stand with her. নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে অন্যদের পাস করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি উনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যাবো, ঠিক সেই সময় কোথা থেকে যেনো হোসেন ভাই সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘খান ভাই আমি আপনারে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি। এটা কী করে সম্ভব! আমি যে তিনজন প্রার্থীর নাম লিখে রেখেছিলাম, সেই তিনজনকেই পাশ করতে দেখে আমি খুবই অবাক হয়েছি, বিস্মিত হয়েছি! আপনার সম্পর্কে যা শুনেছি, এগুলো তাহলে মিথ না সত্যি।’ আমি আবারও একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে ‘ইম্প্রেশন ইভেন্ট ভেন্যু’ থেকে মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গেলাম।