শিরোনাম
বৃহঃ. ডিসে ৪, ২০২৫

লিবিয়ার কারাগারে ২৫ হাজার বাংলাদেশির আহাজারি

কমিউনিটি নিউজ ডেস্ক: স্বপ্নের দেশ ইউরোপে অবৈধভাবে পাড়ি দিতে গিয়ে লিবিয়ার বিভিন্ন করাগারে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে প্রায় ২৫ হাজার বাংলাদেশি। প্রতারণার শিকার এসব বাংলাদেশি যুবকের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ মানবপাচারকী দেশি-বিদেশি চক্র। চাহিদানুযায়ী টাকা না দিলে গোপন বন্দি আস্তানায় অমানুষিক নির্যাতন নেমে আসে এসব যুবকদের ওপর। লিবিয়ার মাসরাতা শহর থেকে গতকাল রোববার বাংলাদেশি প্রবাসী মনসুর আহমেদ ইনকিলাবকে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী ব্যবসায় মনসুর আহমেদ বলেন, দালাল চক্র ইউরোপের ইতালিতে নৌকা যোগে প্রবেশ করানোর মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশি যুবকদের কাছ থেকে ১০ থেকে ১৩ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব মানবপাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে অনেকেই ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। প্রাণ হারানো যুবকদের পরিবারে নেমে আসছে অশান্তির কালো ছায়া।

প্রতারণার শিকার এসব যুবকরা চড়া সুদে ঋন এবং ভিটেমাটি বিক্রি করে দালালদের মাধ্যমে ইউরোপে প্রবেশের আশায় লিবিয়ার বিভিন্ন কারাগারে মাসের পর মাস মানবেতর জীবন যাপন করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ত্রিপলীস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা আইওএম এসব যুবকদের দেশে ফিরিয়ে আনতে নিরলসভাবে কাজ করছে। গত বছরের শেষের দিকে লেবাননে ইসরাইলী বর্বরোচিত হামলার দরুণ সরকার আইওএম এর সহযোগিতায় লেবানন থেকে স্বেচ্ছায় দেশে ফিরেছে ১২শ’ বাংলাদেশি নারী-পুরুষ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল গতকাল ইনকিলাবকে জানান, দালালদের খপ্পরে পড়ে বিপুল সংখ্যাক বাংলাদেশি যুবক ইউরোপে যাওয়ার মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে লিবিয়ার বিভিন্ন কারাগার ও ডিটেনশন ক্যাম্পে আটকা রয়েছে। লেবাননে ইসরাইলী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে লিবিয়ায় বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় দেশটির কারাগারে আটকা পড়া যুবকদের দেশে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম স্থগিত ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লিবিয়ার কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার চাপ রয়েছে। শিগগিরই আইওএম এর আর্থিক সহযোগিতায় লিবিয়া থেকে প্রতারণার শিকার বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম শুরু করা হবে বলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক মোস্তফা জামিল উল্লেখ করেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয় বিষয়ক সংস্থা (ইইউএএ) জানিয়েছে, সংঘাত, সংঘর্ষ, জলবায়ু বিপর্যয়, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা,ক্ষুধা আর দারিদ্র্যের কারণে উন্নত জীবনের আশায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ অনিয়মিত অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন। গ্রীষ্মকালে এই সুযোগটি লুফে নেয় মানবপাচারে সংশ্লিষ্টরা। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ইউরোপ পৌঁছে দেয়ার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমুদ্র অনুপযোগী নৌকায় তাদের তুলে দেয়। কিন্তু ভূমধ্যসাগরের বেশিরভাগ সময় দুর্দশার মুখে পড়ে অভিবাসীবাহী নৌকাগুলো। অসংখ্য মানুষকে সমুদ্রে ডুবে মারা যান অথবা নিখোঁজ হন।

একাধিক সূত্র মতে, স্বপ্নের দেশ ইউরোপে যেতেই হবে। যত টাকা যত ঝুঁকি সবই মাথা পেতে নিচ্ছেন ইউরোপ গমনেচ্ছুরা। গ্রাম্য দালাল চক্রের হাত বদল হয়ে আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারীদের খপ্পরে পড়তেও দ্বিধা বোধ করছে না যুবক শ্রেণির মানুষ। মানবপাচারকারীদের গোপন আস্তানায় মাসের পর মাস নির্যাতনের শিকার হলেও দালাল চক্রের মাধ্যমে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগার দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা থেমে নেই। ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবিতে অনেকেই অকালে প্রাণ হারাচ্ছে। ভূমধ্যসাগরে থামছে না মৃত্যুর মিছিল। তার পরেও উন্নত জীবনের সন্ধ্যানে ১০ লাখ টাকা থেকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে দালালদের মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে বিভিন্ন রুট দিয়ে লিবিয়ায় গিয়ে আটকা পড়ছে হাজার হাজার বাংলাদেশি যুবক। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে যাত্রা করা অভিবাসীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন শিশু। যারা এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ২০২৪ সালে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে অন্তত দুই হাজার ২০০ অভিবাসন প্রত্যাশীর মৃত্যু হয়েছে। এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানিয়েছেন জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের ইউরোপ ও মধ্য-এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক রেজিনা ডি ডোমিনিসিস।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ২০২৪ সালে শুধুমাত্র মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুটে প্রাণ হারিয়েছেন বা নিখোঁজ রয়েছেন প্রায় এক হাজার ৭০০ অভিবাসী। আর পুরো ভূমধ্যসাগরজুড়ে এই সংখ্যা দুই হাজার ২শ ছাড়িয়েছে। যার মধ্যে কয়েকশ শিশু রয়েছে। এছাড়া এ বছর শুরুতে ২০ জন অভিবাসী নিয়ে একটি নৌকা উপকূলে নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। লিবিয়া উপকূল থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে নৌকাটি ডুবে যায়। ইউনিসেফের ইউরোপ ও মধ্য-এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক রেজিনা ডি ডোমিনিসিস বলেন, এই সংখ্যার মধ্যে ভুক্তভোগী শত শত শিশু রয়েছে। ভূমধ্যসাগর হয়ে যাত্রা করা অভিবাসীদের মধ্যে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন শিশু। যারা এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার সংঘাত ও দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুটটিকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রুট হিসাবে বিবেচনা করা হয়। লিবিয়া ও তিউনিশিয়া উপকূল থেকে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করা অভিবাসীদের জন্য ইতালি অন্যতম প্রধান অবতরণ পয়েন্ট।

জাতিসংঘের অভিবাসন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা (আইওএম) বলেছে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ২৫ হাজার ৫০০ অভিবাসী মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেন্দ্রীয় ভূমধ্যসাগরীয় রুটটি বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক অভিবাসন পথ হিসেবে উঠে এসেছে। ২০২৪ সনের প্রথম তিন মাসে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যারা মারা গেছে তাদের ১২% বাংলাদেশি বলে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) মহাপরিচালক অ্যামি পোপ। বিগত ৭ মে ঢাকার বনানীর একটি হোটেলে আইওএম-এর ওয়ার্ল্ড মাইগ্রেশন প্রতিবেদন ২০২৪ উন্মোচনকালে পোপ এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেন। তিনি জানান, এই বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যারা মারা গেছে তাদের ১২% বাংলাদেশের নাগরিক। তবে, তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক হিসাব দিতে পারেননি। ওই বছর ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার উপকূলে নৌকাডুবির ঘটনায় নিহত আট বাংলাদেশির পরিবার তাদের প্রিয়জনের লাশ পেয়েছে। জুওয়ারাহ উপকূল থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথে ৫২ জন যাত্রী ও একজন নাবিক নিয়ে নৌকাটি ১৪ ফেব্রুয়ারি ডুবে যায়। জীবিতদের মধ্যে ২৭ জন বাংলাদেশি নাগরিক, অন্যরা পাকিস্তান (৮), সিরিয়া (৫) এবং মিশর (৪) নাগরিক। এতে নয়জনের মৃত্যু হয়। যার মধ্যে আটজন বাংলাদেশি ও একজন পাকিস্তানি বলে চিহ্নিত হয়েছে।

এদিকে,গতকাল রোববার বিদেশে যেতে ইচ্ছুক নাগরিকদের দালাল চক্রের খপ্পর থেকে বাঁচতে সতর্ক করেছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। প্রবাসী মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান-৩ শাখা থেকে এক সতর্কবার্তায় বিদেশগামী নাগরিকদের কয়েকটি বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। সতর্কবার্তায় বলা হয়, বিদেশ গমনেচ্ছু সংশ্লিষ্ট সকলের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, সম্প্রতি বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন ও মিথ্যা আশ্বাসের মাধ্যমে এক শ্রেণির প্রতারক, দালাল ও এজেন্সি বাংলাদেশি কর্মীদের নিয়ম বহির্ভূতভাবে ও অবৈধভাবে বিদেশ গমনে প্রলুব্ধ করছে। তারা মূলত বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের মোটা অংকের বেতন ও কাজের লোভ দেখিয়ে টুরিস্ট বা ভিজিট ভিসার মাধ্যমে লিবিয়া, রাশিয়া, লেবানন ও মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে প্রেরণ করছে। এতে আরও বলা হয়, টুরিস্ট বা ভিজিট ভিসায় কাজের আইনি সুযোগ না থাকায় এভাবে বিদেশ গমন করে কর্মীগণ শারীরিক, আর্থিক ও মানসিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেক ক্ষেত্রে প্রাণহানিসহ জেল-জরিমানার শিকার হচ্ছেন। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিদেশ গমনের পূর্বে নিন্মবর্ণিত বিষয়গুলো প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে।

বিদেমে কর্মসংস্থান (ওয়ার্ক পারমিট) ভিসায় বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশ গমন না করা, দালালের প্রলোভনে টুরিস্ট বা ডিজিট ভিসায় কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন না করা, বিদেশ গমনের পূর্বে নিয়োগকর্তার নাম, ঠিকানা, চাকরির বিস্তারিত বিবরণ যেমন- বেতন-ভাতা, কর্মের মেয়াদ, থাকা, খাওয়া, আকামা বা ওয়ার্ক পারমিটসহ অন্যান্য সুবিধাদি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া, বহির্গমন ছাড়পত্র ও গন্তব্য দেশের টিকিট ব্যতীত কর্মসংস্থান ভিসায় বিদেশ গমন না করা, জলপথ, স্থলপথ বা পায়ে হেঁটে গমন করে কর্মের জন্য দালালের মিথ্যা প্রলোভনে আশ্বস্ত না হওয়া, ভিসা প্রদানকারী দেশের দূতাবাস বা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ভিসার সঠিকতা নিশ্চিত হয়ে গমন করা, বিদেশ গমনের পূর্বে নিয়োগকারীর সঙ্গে কর্মচুক্তি স্বাক্ষর নিশ্চিত করে বিদেশ গমন করা, ভিসা, কর্ম চুক্তিপত্র, নিয়োগকারী ও রিক্রুটিং এজেন্সির ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য সংরক্ষণ করা, বিদেশ গমনের পূর্বে গমনকারী দেশে অবস্থিত বা নিকটবর্তী বাংলাদেশ দূতাবাসের ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর সংরক্ষণ করা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় (ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি) প্রচারিত ভুয়া চাকরির বিজ্ঞপ্তি দ্বারা প্রতারণার হাত থেকে রক্ষার জন্য রিক্রুটিং এজেন্সি বা নিয়োগকর্তার তথ্য প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বা বিএমইটি’র ওয়েবসাইটে অথবা প্রবাসবন্ধু কল সেন্টার নম্বর ১৬১৩৫ থেকে যাচাই করা।

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *