১৯৭১ সালে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী তাদের এ দেশীয় দোসরদের সঙ্গে নিয়ে ডিসেম্বরের শুরুতেই বাংলার বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নীলনকশা করে। ১০ ডিসেম্বর থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চিকিৎসক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মীদের। কিন্তু ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত্রির পর থেকেই সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে বুদ্ধিজীবীই কাজ করেছেন ও দাঁড়াতে চেয়েছেন, তাদেরই হত্যা করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকে আছেন, যাদের সন্তানরা এতই ছোট ছিলেন যে যথাযথ প্রক্রিয়া অবলম্বন করে শহীদ তালিকায় স্বজনের নাম পর্যন্ত ওঠাতে পারেননি। শহীদ বুদ্ধিজীবী বললে প্রথম সারির যাদের নাম উঠে আসে, তাদের বাইরে দীর্ঘ তালিকায় যারা আছেন, তাদের সন্তানেরা ৪৯ বছর ধরে লড়াই করছেন কঠিন স্মৃতির বিরুদ্ধে। কারোর বাবাকে চোখের সামনে ধরে নিয়ে গেছে, কেউবা মায়ের মুখে গল্প শুনে বাবাকে চিনেছেন। কারোর হয়তো জন্মই হয়নি তখন, মায়ের পেটে অপেক্ষা করছিলেন ধরিত্রীতে আসার।
শাহরীন রহমান লুবনা। ১৯৭১ সালে তার যখন ৫ বছর বয়স, বাবা লে. কর্নেল এ এফ জিয়াউর রহমান এএমসি-কে পাকিস্তানি আর্মি তুলে নিয়ে যায়। সেদিন বাবার প্রিয় সব রান্না করেছিলেন মা। বাবা খেয়ে যেতে পারেননি। যাওয়ার আগ মুহূর্তে মাকে বলে গিয়েছিলেন, আল্লাহর কাছে রেখে যাচ্ছি তোমাদের। যদি ফিরি দেখা হবে। লুবনার বাবা আর ফেরেননি। স্মৃতি হাতড়ে, সদ্যমৃত মায়ের কাছ থেকে গল্প শুনে, বাবার কাছের মানুষদের লেখালেখি দেখে যেটুকু জানেন লুবনা—সেটি বলতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠেন ক্ষণে ক্ষণে। তিনি বলেন, ‘‘সে সময় আমরা ঢাকা সেনানিবাসে। এখন সেনাপ্রধানের বাসা যেখানে, তার উল্টো দিকে আমরা থাকতাম। এরপর আব্বাকে সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সুপারিনটেনডেন্ট করা হলো। ১৯৭০ সালে আমরা সেখানে গেলাম। আমি পাঁচ বছরের। আমার ভাই এক বছরের। ২৬ মার্চ কেউ একজন খবর দিলো আব্বা হাউস এরেস্টেড। মার কাছে শুনেছি, যুদ্ধের আগে থেকেই এমন কেউ নেই যিনি বাবার কাছে চিকিৎসা চেয়ে পাননি। সে সময় অনেক শিক্ষার্থী তাকে ভারত যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি প্রতিবারই বলেছেন, ‘আমি চুরি করিনি, কোনও অন্যায় করিনি, পালাবো কেন?’ আমরা ওই কিছু দিন, এর-ওর বাসায় আশ্রয় নিয়ে ট্রেঞ্জের মধ্যে লুকিয়ে থাকতাম। সপ্তাহখানেক একটি হিন্দু পরিবার আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। যেদিনের ঘটনা সেদিন আমরা বাসার নিচে ছোটরা খেলেছিলাম। এক তরুণ পাকিস্তানি এসে আব্বার নাম জিজ্ঞেস করাতে কেউ একজন বলে দিয়েছিল। সে বাসায় ঢুকে বাবাকে নিয়ে চলে যায়। ঘড়িটা পরে (অনেক কালেকশন ছিল), চশমা, আংটি, লাইটার নিয়ে যখন বেরিয়ে যাচ্ছেন, মা বলেন, ‘চলে যাচ্ছো?’ আব্বা জবাব দেন, ‘আল্লাহর হাতে রেখে গেলাম।’ তিন-চারদিন পরে একদল এসে আংটি, ঘড়ি, চশমা ফেরত দিয়ে বললো, ‘উনাকে পাকিস্তানে নেওয়া হবে।’ আর কোনোদিন বাবাকে আমরা পাইনি। অনেক খোঁজ করা হয়েছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি। পরে লোকমুখে শুনেছি, তাকে প্লেনে উঠায়ে আবার নামিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এবং সেদিনই মেরে ফেলা হয়েছে। এয়ারপোর্টের কাছে ওখানে কোনও একটা গণকবর আছে, যেখানে আব্বা থেকে থাকতে পারেন।’’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে লুবনা আরও বলেন, ‘শহীদ হিসেবে বাবাকে আমরা কোথাও স্থান করে দিতে পারিনি।’
নটকিশোর আদিত্য। মুক্তিযুদ্ধকালে বয়স ছিল ৬/৭ মাস। নটকিশোরের বাবা ‘সৎসঙ্গ সংবাদ’ নামে একটি পত্রিকার সহ-সম্পাদক ছিলেন। সাংস্কৃতিক- সামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। নিজে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানুষকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। তার ধর্ম ছিল উপকার করা আর লেখা।
টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে পাকুচিয়ায় সে সময় তার বাবা মানুষজনকে সহযোগিতা করতে শুরু করেন। নটকিশোর লোকমুখে শুনেছেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ৪ এপ্রিল তাদের বাসায় আক্রমণ করে। কোনোভাবে সেদিন তার বাবা প্যারী মোহন আদিত্য বেঁচে যান। ২১ মে বাবাকে আবারও ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। ধরে নেওয়ার সময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে রাজাকার, আলবদররা ছিল। ৪/৫ দিন ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। কিন্তু আবারও তিনি কৌশল অবলম্বন করে পালাতে সক্ষম হন। তিনবারের চেষ্টার পরে আগস্টের ৮ তারিখ তাকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বেয়নেট চার্জ করা হয়। ১৯৭২ সালে আমি আমার মাকেও হারাই। ফলে চাচা-চাচির কাছে বড় হয়েছি। পরিবারের সবাইকে হারিয়ে অন্যের কাছে বড় হওয়া কষ্টের। কিন্তু বেঁচে আছি। নটকিশোর প্রজন্ম ৭১-এর সাথে আছেন ১৯৯২ সাল থেকে, সর্বশেষ কমিটিতেও রয়েছেন। কিন্তু হারানো বাবাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে পারেননি। কারণ, এতিম নটকিশোরের কাছে সে সময় কোনও প্রমাণ সংরক্ষণের সুযোগ ছিল না। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন সময় যখন দেখি অমুক্তিযোদ্ধারা তালিকায় ঠাঁই করে নিচ্ছে, তখন কষ্ট হয়। আজ পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী তালিকা হলো না কেন, সে নিয়েও আছে মনোকষ্ট।’
লে. কর্নেল আবদুল কাদেরের বড় সন্তান রুবিনা কাদের। মুক্তিযুদ্ধকালে বয়স ছিল ১১ বছর, ছোট ভাই নাদিম কাদেরের বয়স তখন ৯ বছর, আর সবচেয়ে ছোটটা তখন মায়ের পেটে। ধরে নিয়ে যাওয়ার দিনের ঘটনা বলতে গিয়ে তিনি কখনও চুপ করে থাকেন, কখনও কাঁদেন। রুবিনা বলেন, ‘‘বাবা ১৯৭০ সালের নভেম্বরে ডেপুটেশনে চট্টগ্রাম ওয়েল অ্যান্ড গ্যাসে ইস্ট পাকিস্তান ব্রাঞ্চের হেড হয়ে আসেন। ১৯৭১ সালের শুরু থেকেই অসহযোগ শুরু হলো। বাবা ম্যাপওয়ালা ফ্ল্যাগ ওড়াতেন বাসায়। উনি স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন বাংলাদেশের। চট্টগ্রামে থাকাকালীন আমাদের বাসায় মিটিং হতো একটার পরে একটা। আম্মা তখন অন্তঃসত্ত্বা। আব্বা ২৫ মার্চের পরেই বাসা ছেড়ে সম্মুখ সমরে অংশ নিতে গিয়েও ফিরে আসেন। ফিরে আসার কারণ জিজ্ঞেস করলে মাকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে এ অবস্থায় রেখে গেলে ওরা তোমার ওপর অত্যাচার করবে।’ রুবিনা বলেন চলেন, ‘সে সময় সারাক্ষণ ঘরের ভেতর থাকতাম, রাতে লাইট অফ থাকতো। একদিন বাবা তার জন্য বরাদ্দ অস্ত্রও একজনকে দিয়ে দিলেন। ১৭ এপ্রিল তখন সকাল ৭টার মতো। বাসায় পাকিস্তানি আর্মি এসে প্রথম যে কথাটি বলেছিল, ‘গাদ্দার কাহা হেই’। হয়তো এখানে মিটিং হয় তারা সেই খবর পেয়েছিল। একপর্যায়ে তাদের সাথে নিয়ে চলে যায়। আমাদের সবার কান্নাকাটি দেখে বলেছিল, বিকালে পৌঁছে দেবে। সেই বিকাল আর এলো না। ঘণ্টাখানেক পরে ওই গ্রুপ আবার এলো। আমাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে সারি করে দাঁড় করিয়ে পিঠে স্টেনগান ঠেকালো। হয়তো বেঁচে থাকবো বলেই, সে সময় পেছন থেকে একজন এসে বললো, অন্তঃসত্ত্বাকে মারলে দোজখে যেতে হবে। তারা পিছু হটে চলে যায়। কিন্তু বাবা আর আসেনি।’’