উজ্জল হুসাইন: দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধাদের ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজি ১৬ ডিসেম্বর,১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে(বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ৯১,৬৩৪ জন সৈন্য সহ আনুষ্ঠানিক ভাবে আত্মসমর্পন করে। ঢাকা সহ সারা দেশের মানুষ যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লাস করছে, ৮নং সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ মঞ্জুর তখন খুলনার শিরোমণিতে সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ করে যাচ্ছেন বিজয়ের শেষ পেরেকটি ঠুকার জন্য! যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। বিমান আক্রমণের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহ যশোর ছিল একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ। অপর দিকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সাথে যোগাযোগে যশোরের গুরুত্বের কারণে বাংলাদেশ-ভারত সম্মিলিত বাহিনীর জন্য যশোরকে শত্রুমুক্ত করা জরুরী হয়ে পড়ে। সম্মিলিত বাহিনী ৫ ডিসেম্বর যশোর আক্রমণ করলে প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। টানা দুইদিন তুমুল যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর মাঝরাতে হঠাত করেই পাকিস্তানীদের পক্ষ থেকে গুলি বিনিময় বন্ধ হয়ে যায় এবং ভোর রাতে অপ্রত্যাশিত ভাবে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করা শুরু করে! ৫৭ ব্রিগেড অগ্রসর হয় মাগুরার দিকে এবং ১০৭ ব্রিগেড এগিয়ে যায় খুলনার দিকে। যার নেতৃত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার মালিক হায়াত খান।
১০ ডিসেম্বর খুলনার প্রবেশমুখ ফুলতলায় পৌছায় হায়াত খান। সেখানে ১০৭ ব্রিগেডের সাথে যোগ দেয় ৬ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, আংশিক ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, ১৫ এফ এফ আর, ২২ এফ এফ আর, ৫৫ ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, ৭ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, ১০ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়ান, কয়েকশত রাজাকার, আল-বদর, আল শামস। সব মিলিয়ে তাদের সৈন্য সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ফুলতলাতে সামরিক অবস্থান নিয়ে ফুলতলা থেকে কিছুটা দূরে শিরোমণিকে একটি শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করে তারা। সৈনিকদের পাশাপশি অস্ত্রের মুখে স্থানীয় বাঙালীদেরকেও কাজে লাগায় হায়াত খান। স্থানীয় এক কেবল ফ্যাক্টরিতে অস্থায়ী সদর দফতর স্থাপন করা হয়। আশপাশের পাকা ভবনগুলোকে ব্যারাকে রূপান্তর করা হয় সেখানকার বসতিদের জোরপূর্বক বের করে দিয়ে। আটরা গিলাতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুরুল হুদা যিনি ছিলেন স্থানীয় শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তার বাড়িতে বসানো হয় যোগাযোগ দফতর, যেখানে শক্তিশালী ওয়্যারলেস সহ টেলিফোন বসানো হয়। একটি অস্থায়ী হাসপাতালও বসানো হয়। প্রায় ১৫-২০ গজ পরপর বাঙ্কার খনন করা হয়,চারপাশে প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্র সহ ৩২টি ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। খুলনা শিল্প এলাকার ইস্টার্ন জুট মিল, আফিল জুট মিল, আলীম জুট মিল সহ প্রায় ৪ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে রাস্তার উপরে ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুতে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বূহ্য তৈরি করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সব মিলিয়ে হায়াত খানের বাহিনী শিরোমণিকে ছোট কিন্তু শক্তিশালী একটি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত করে। মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর নেতৃত্বে ভারতীয় বাহিনী খুলনার দিকে অগ্রসর হতে গিয়ে ফুলতলায় প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ফুলতলার অবস্থান দুর্বল না করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা ছিল না তাই দলবীর সিং জোড়ালো আক্রমণ শুরু করে এর সাথে যোগ দেয় ভারতীয় বিমান বাহিনী। এইখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীও দক্ষ রণকৌশলতার সাথে ভারতীয় বাহিনীকে মোকাবেলা করে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী বাহিনী শিরোমণির দিকে সরে আসে। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় রাজপুত ডিভিশনের এক বিশাল বহর নিয়ে ফুলতলায় আসেন মেজর মঞ্জুর সাথে গাইড হিসেবে আসেন মুক্তিযোদ্ধা আলকাস, কুদ্দুস, রেজোয়ান ও গণি। ফুলতলার চৌদ্দ মাইল এলাকায় অবস্থানরত ভারতীয় বাহিনীর সাথে মিলিত হন মেজর মঞ্জুর।
এবার চূড়ান্ত আক্রমণের পালা। এই উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর একটি অংশ ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাংক নিয়ে ভৈরব নদী পার হয়ে অপর পারে অবস্থান নেয় যাতে পাকিস্তানী সৈনিকরা নদী পেরিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল সহ বিভিন্ন এলাকা থেকে এসে জড়ো হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা ব্যারাকপুর, লাকোহাটি, সিদ্ধিরপাশা, ধূলগ্রামে অবস্থান নেয় একই উদ্দেশ্যে – শত্রুদের পালাতে দেয়া যাবে না। খুলনা-দৌলতপুরের পশ্চিমের এলাকাগুলোতেও প্রচুর সৈন্য জড়ো করে মুক্তিবাহিনী। মেজর গণি ও মেজর মহেন্দ্র সিং এর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর বিশাল একটা দল শিরোমণিতে ঢুকে পড়ে, তাদের ধারণা ছিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দৌলতপুর-শিরোমণি থেকে সরে খুলনা শহরের দিকে চলে গেছে। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। যার মাশুল দিতে হয় প্রায় ৩’শতাধিক ভারতীয় সৈনিকের প্রাণের বিনিময়ে। তারা শিরোমণিতে ঢোকা মাত্র পাকিস্তানী ট্যাংকগুলো গোলাবর্ষণ শুরু করে দেয়। এ অবস্থায় তাদের কিছুই করার ছিল না। একই দিনে ইস্টার্ণ জুট মিল এলাকায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে হাতাহাতি ও বেয়নেট যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারতীয় সৈন্যরা, শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানী সৈন্যরা পরাজিত হয়ে বন্দী হয় । ভারতীয় বিমানবাহিনী আক্রমণ শুরু করলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ৪টি ট্যাংক বিধ্বস্ত হয়। প্রচুর গোলাবারুদ সহ পাকিস্তানী একটি ট্রাক শিরোমণি রেলস্টেশনের পাশে বিমান হামলায় বিধ্বস্ত হয়। হানাদার বাহিনীর অস্থায়ী যোগাযোগ দফতর চেয়ারম্যান নুরুল হুদার বাড়িও বিমান হামলায় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভারতীয় বিমান হামলার বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। ১৪ ডিসেম্বর সারাদিনও প্রচণ্ড যুদ্ধ চলে। যেহেতু বাইরে থেকে কোন ধরণের গোলাবারুদ ও রসদের যোগান পাকিস্তানীরা পাচ্ছিলো না তাই টানা যুদ্ধে এক সময় গোলাবারুদে টান পরে পাকিদের। ডিফেন্স লাইন ভেঙ্গে পড়তে শুরু করে। সব দিক থেকে কোণঠাসা পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাধ্য হয় যুদ্ধবিরতিতে যেতে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় লে. জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পন করলে সবাই আশা করছিল হায়াত খান আর যুদ্ধ চালাবে না। কিন্তু সব আশাকে ভুল প্রমাণ করে রাত ৯টায় আবার অস্ত্রের গর্জনে কেঁপে উঠে শিরোমণি রণক্ষেত্র। হঠাত করেই তীব্র আক্রমণ চালায় হায়াত খানের বাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীও পাল্টা জবাব দিতে শুরু করে। দুই পক্ষই সমানে গোলাবর্ষণ করছে, দুই পক্ষেরই হতাহতের সংখ্যা প্রচুর। রাত ৩টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আরো জোড়ালো আক্রমণ করলে হঠাত করেই একসাথে বেশ কয়েকজন আঘাতের শিকার হন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১ জন অফিসার সহ ৭ জন নিহত ও প্রায় ৩০ জন আহত হন। মুক্তিবাহিনীর ক্ষতি আরো বেশি – নিহত ৩১ জন, আহত প্রায় চারগুন। এই অবস্থায় এয়ার কভারেজের জন্য ম্যাসেজ পাঠালে মিত্রবাহিনী থেকে জানানো হয় বিমান প্রস্তুত হয়ে আছে দমদম এয়ারপোর্টে। দূরত্ব হিসাব করে বোঝা গেল এয়ার সাপোর্ট আসতে অনেক দেরী। প্রচণ্ড বিপর্যয়ের এই মুহুর্তে মেজর মঞ্জুর দাবী করেন সম্মিলিত বাহিনীর দায়িত্ব তার হাতে ছেড়ে দেয়া হোক। যুদ্ধের স্ট্রাটেজি অনুযায়ী শত্রুবাহিনীর উপর হামলা করার আগে নিজেদের কমপক্ষে ৩ গুন শক্তি নিশ্চিত করতে হবে যা সম্মিলিত বাহিনীর ছিল না তাই স্ট্রাটেজি পরিবর্তন করতে হবে। ভারতীয় কমান্ডার ইতিস্তত করতে থাকলে মেজর মঞ্জুর তার কোমরের বেল্ট খুলে টেবিলে রাখেন যার অর্থ জয়ী না হয়ে আর ফিরবেন না তিনি। অবশেষে দলবীর সিং সম্মিলিত বাহিনীর দায়িত্ব মেজর মঞ্জুরের হাতে তুলে দেন (কথিত আছে দলবীর সিং নিজ সেনাবাহিনীর নিরাপত্তার জন্য যুদ্ধের নেতৃত্ব মেজর মঞ্জুরের হাতে ছেড়ে দিয়ে নিরাপদ দূরত্ব অবস্থান নেন।)। যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে যাওয়ার আগে, নিশ্চিত মৃত্যু ধারণা করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক বাক্যের একটি শেষ বিদায়ী চিঠি এক সৈনিকের কাছে রেখে আসেন মেজর মঞ্জুর। এরপর শুরু হয় চূড়ান্ত যুদ্ধ। পরিকল্পনা অনুযায়ী মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলোর ২টিকে সংকেত অনুযায়ী শিরোমণি-খুলনার প্রধান সড়কে ও ৬টিকে ডান দিকের নিচু বেত গাছের সারির পাশ দিয়ে পাক ডিফেন্সের পিছনে দ্রুত গতিতে পৌছে যাবার জন্য প্রস্তুত করেন,প্রচুর হতাহতের সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি ট্যাংকের পিছনে থাকেন ১২ জন করে সুইসাইড কমান্ডো। এর মাঝে ২জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, আহত হন আরো ১জন। ভারতীয় সেনাবাহিনীরও একজন আহত হন। ভোরের আলো ফোটার একটু আগে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অবস্থানে আঘাত হানলেন মেজর মঞ্জুর। ২৫টির বেশী ট্যাংক, ১৫০ এর উপরে কামান, কয়েকশত মর্টার নিয়ে সবার আগে এসএলআর হাতে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নিশ্চিত মৃত্যু মাথায় নিয়ে শত্রুব্যূহে ঢুকে গেলেন মেজর মঞ্জুর। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২টি টি-১৬০ ট্যাংক শিরোমণি-খুলনা প্রধান সড়ক দিয়ে আর ৫টি টি-১৬০ ট্যাংক ডান দিক থেকে এগিয়ে গেল দ্রুত গতিতে। দুপক্ষ থেকেই শুরু হল কামান ও ট্যাংকের অবিরাম গোলাবর্ষণ যার চিহ্ন ছড়িয়ে পড়লো প্রায় ৩ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে। আশেপাশের ঘরবাড়ি, গাছপালা গুড়িয়ে যাচ্ছে, প্রবল গোলাবর্ষণের আলোর ঝলকানিতে আকাশ হয়ে উঠছে ফর্সা। এর মাঝেই লড়ে চলেছে মঞ্জুর বাহিনী। যুদ্ধ চলছে ট্যাংকের সাথে ট্যাংকের, পাশাপাশি কোথাও কোথাও চলছে গোলাগুলি, হাতাহাতি। মেজর মঞ্জুর এসএলআর নিয়ে গুলি করতে করতে চলন্ত একটি ট্যাংকরে মাঝে ঢুকে গানারকে হত্যা করে সেটার দখল নিয়েছিলেন। ভোর ৬টার একটু আগে ভারতীয় বিমানবাহিনী হামলা শুরু করলে বিগ্রেডিয়ার মালিক হায়াত খানের শেষ প্রতিরোধও ধ্বংস হয়ে যায়। ১৫৭টি মৃত্দেহ,প্রচুর আহত সৈনিক পিছনে রেখে প্রায় ৫শতাধিক সৈন্যসহ হায়াত খান মেজর মঞ্জুরের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শিরোমণিতে সংঘটিত হওয়া এই যুদ্ধ “শিরোমণি ট্যাংক যুদ্ধ/ট্যাংক ব্যাটল অফ শিরোমণি” (কিছু কিছু ক্ষেত্রে “শিরোমণি সম্মুখ সমর”) নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত। “শিরোমণি ট্যাংক যুদ্ধ” বিশ্বের সেরা কিছু ট্যাংক যুদ্ধের মধ্যে অন্যতম এবং একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের শেষ যুদ্ধক্ষেত্র । বিশ্বের অনেক সমর বিশারদ এই যুদ্ধকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম ভয়াবহ যুদ্ধ “এল আলামিন” এর সাথে তুলনা করেছেন। এ যুদ্ধের কৌশল জার্মান,ভারত,পোল্যান্ড সহ বিশ্বের ৩৫টি দেশের সামরিক কলেজে পড়ানো হয়।