বিএনপির নেতা ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের রমনা শাহবাগ এলাকার তৎকালীন কমিশনার চৌধুরী আলম গুমের এক যুগ পূর্ণ হলো। ২০১০ সালের ২৫শে জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর ইন্দিরা রোডে নিজ বাসার সামনে থেকে আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তুলে নিয়ে যায় এই বিএনপি নেতাকে। চৌধুরী আলমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় নিজেদের “প্রশাসনের লোক” বলে পরিচয় দেয়। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে আজ অবধি খোঁজ মেলেনি বিএনপির এই নেতার।
চৌধুরী আলমকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তার গাড়িচালক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বারা বাইরে থেকে আসছিলেন। ইন্দিরা রোডের বিল্ডিংয়ের গ্যারেজে ঢোকার আগে তাদের গাড়ীকে আরেকটা গাড়ী গতিরোধ করে। গাড়ি থামলে সাদা পোশাকের ৭/৮জন মানুষ চৌধুরী আলমের গাড়িকে ঘিরে দাড়ায়। এসময় তারা নিজেদের প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে তাঁকে নামিয়ে তাদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের জানুয়ারীতে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার দেড় বছর পর ২০১০ সালের ২৫ জুন প্রথম হরতাল ডাকে বিএনপি। হরতালকে ঘিরে রাজধানীর শাহবাগ থানায় আগের দিনই বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। ওইদিন সকাল থেকেই রাজধানীতে শুরু হয় ধরপাকড়।
অবিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ৫৬ নং ওয়ার্ডে (বর্তমান ২০ নং ওয়ার্ড) একটানা ২৩ বছর কমিশনার ছিলেন চৌধুরী আলম। দলীয় সভা-সমাবেশ কিংবা যেকোনো আন্দোলন কর্মসূচি সফলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতেন তিনি। সে কারণেই হয়তো চৌধুরী আলমকে প্রথম টার্গেট করা হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিকভাবে শক্ত অবস্থান তৈরির কারণে তাকে গুম করা হয়েছে।
ওয়ান-ইলেভেনের পর চৌধুরী আলমের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দায়ের হয়। ওই সময় গ্রেপ্তার হয়ে টানা ২৭ মাস কারাভোগ করেন তিনি। কারাগার থেকে যখন বের হন তখন তার বয়স ছিল ৬৭। এরপর বেশিদিন পরিবারের সান্নিধ্যে কাটাতে পারেননি। শিকার হন গুমের।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুমের শিকার ব্যক্তিদের একটি তালিকা ২০২১ সালের আগস্টে প্রকাশ করেছিল আমেরিকা ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইট ওয়াচ। এই সংগঠনটি বাংলাদেশের ৮৬টি গুমের তথ্য তুলে ধরেছিল তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে।
২০২১ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিস-অ্যাপিয়ারেন্স ‘গুম’ হওয়া ৩৪ জনের অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। ৩৪ জনের তালিকার বেশির ভাগ ব্যক্তিকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা বা কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল চিঠিতে।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, গত ১৫ বছরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেওয়ার পর ৬১৪ জন নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। জীবিত ও মৃত অবস্থায় ওই ব্যক্তিদের বেশির ভাগের খোঁজ মিললেও অন্তত ২০০ জন এখনো নিখোঁজ। এর মধ্যে ৮০ জনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুম থেকে সবার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সনদ গৃহীত হয়। এর মাধ্যমে গুমের হাত থেকে সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারটি আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় আসে এবং কাউকে গুম করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি পায়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের রোম আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে গুম করা একটি মানবাধিকার বিরোধী অপরাধ। স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো সমাজের মধ্যে ত্রাস ছড়িয়ে দিতে এই ভয়াবহ অপরাধটি করে থাকে। বাংলাদেশেও গুমের ঘটনাগুলোর সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনরত বিএনপিসহ বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী ও সমর্থকবৃন্দ। এছাড়াও গুমের শিকার হয়েছেন ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ। কিন্তু, ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা এই সরকার জোরপূর্বক গুম করাকে বরাবরই অস্বীকার করছে।
এমনকি, জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের বিষয়ে কাজ করা সংস্থা ডব্লিউজিইআইডি-এর ১২৬তম অধিবেশনের আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, জাতিসংঘ যেসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের তালিকা দিয়েছে তাদের বেশিরভাগই আসলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটিতে বাংলাদেশ সরকার প্রথমবারের মতো একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু, ২০১৮ সালের ৩০-৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত একই কমিটি কর্তৃক বাংলাদেশের প্রতিবেদন পর্যালোচনার সময়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা এই গুমের ঘটনাগুলি অস্বীকার করে। ওই কমিটির সমাপ্তি পর্যবেক্ষণে সাদা পোশাকে গ্রেফতার এবং গুম করা বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করতে সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
এখন গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারগুলি তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তারা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্র দ্বারা বিভিন্ন হুমকি এবং হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন। অনেক মামলায় গুমের শিকার ব্যক্তিদের দীর্ঘদিন ধরে আটকে রেখে পরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হচ্ছে বা চোখ বেঁধে কোনো নির্জন জায়গায় ফেলে আসা হচ্ছে।