বাংলাদেশে বহু মুসলিম পরিবারেই শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা শুরু হয় আরবি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে। এর উদ্দেশ্য, তারা যেন কোরআন পড়তে পারে।
এর পাশাপাশি মাদ্রাসার মতো ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও আরবি শেখার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়।
কিন্তু এতকিছুর পরও বাংলাদেশে আরবি ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর কারণ কী?
শোলাকিয়ার ইমাম ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এর জন্য দায়ী করছেন যেভাবে আরবি ভাষা শেখানো হচ্ছে তার দুর্বলতাকে।
তিনি বলেন, মূলত ইসলাম ধর্মীয় বিষয়ে পড়াশোনা করে এমন কিছু লোক ছাড়া আরবি ভাষা জানা লোকের সংখ্যা খুব কম এবং এর ফলে বিরাট সুযোগ নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশীদের জন্য।
“এটি যদি মুখস্থ না শিখিয়ে ভাষা হিসেবে শিশুকাল থেকেই শেখানো যেতো তাহলে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের সুযোগ যেমন বাড়ত তেমনি দেশও অর্থনৈতিকভাবে অনেক লাভবান হতো,”মিস্টার মাসউদ বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে।
তিনি বলেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের যে বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ করছেন তারা প্রত্যেকেই শিশুকালে কোরআন পড়েছেন বা তাদের শেখানো হয়েছে।
কিন্তু তারপরেও যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের আরবি ভাষা জ্ঞান নেই, এমনকি ন্যূনতম কথোপকথনও তারা পারেননা।
তিনি বলেন, “যদিও তাদের ভাষা হিসেবে শেখানো হতো তাহলে বাংলার পর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবেই তারা শিখতে পারতো। এতে করে এসব দেশগুলো থেকে এখন যা আয় হচ্ছে তার দ্বিগুণ অর্থ আসতো”। বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে জড়িতদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী একটা সময় শুধু সরকারি বা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আরবি বিভাগ আর কওমি মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিতে আরবি শেখার সুযোগ ছিলো।
এখন এর সুযোগ বেড়েছে আবার ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা আরবি শেখানোর কার্যক্রম চালাচ্ছে।
যদিও ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলছেন এখানে মাদ্রাসাগুলোতে আরবি শেখানোর মূল লক্ষ্যই থাকে বিশুদ্ধভাবে কোরআন পড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে, তাই ভাষা হিসেবে শেখার বিষয়টি খুব বেশি প্রচলিত হয়ে উঠেনি।
প্রসঙ্গত আরবি এখনকার বিশ্বের প্রায় বিশটিরও বেশি দেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলিত আছে এবং এর বাইরেও অনেকগুলো দেশে আরবি ভাষার প্রচলন আছে।
এক হিসেবে দেখা যায় এখন প্রায় ২৮ কোটি মানুষের মাতৃভাষা আরবি আর প্রায় ২৫ কোটি মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরবি ব্যবহার করে।
সবমিলিয়ে ১৮০ কোটি মুসলিমের ধর্মীয় ভাষা আরবি। বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষার মতো চতুর্থ কিংবা পঞ্চম।
এছাড়া জাতিসংঘ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আরব লীগের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবেও আরবি ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে থেকে যেসব দেশে বেশি শ্রমিক যায় যেমন সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ভাষা আরবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের আরবি ভাষা শিক্ষা সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ডঃ মোহাম্মদ ইউছুফ বলছেন ২০০৯ সালে সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আরবি ভাষা শেখানের কাজ শুরু করেছিলেন তিনি।
“এর লক্ষ্যই ছিলো সাধারণ মানুষ বিশেষ করে যারা কাজের সন্ধানে মধ্যপ্রাচ্যে যাবেন তারা। ভাষাটা যদি ন্যূনতম শিখতে পারে তাহলেই তাদের আয় বেড়ে যাবে এবং অসহায়ত্ব কমার সুযোগ তৈরি হতে পারে,” বলছিলেন তিনি।
তিনি বলেন আরবির দুটি দিক আছে- একটি ধর্মীয় এবং অপরটি বাণিজ্যিক, এমনটি ইউরোপের অনেক দেশেও আরবির ব্যাপক প্রচলন আছে।
“তাই ভাষা হিসেবে শিখতে পারলে এটি আমাদের জন্য দারুণ সম্ভাবনার দ্বারা উন্মোচন করতো”।
তিনি জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সেন্টার থেকে মূলত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে পড়ালেখা বা প্রশিক্ষণের প্রয়োজনে বা মধ্যপ্রাচ্যে যারা কাজের জন্য যেতে চায় তাদের আরবি ভাষা শিখতে সহায়তা করে থাকে।
“বাংলাদেশের মক্তব মাদ্রাসায় যেভাবে ব্যাকরণ নির্ভর আরবি শেখানো হয় তার উদ্দেশ্য থাকে কোরআন হাদিস নির্ভুল ভাবে পড়া। কিন্তু ভাষা হিসেবে শিখতে গেলে সেখানে ব্যাকরণ খুব একটা জরুরি বিষয় না,” বলছিলেন অধ্যাপক ইউছুফ।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে ফিরে আসা কিংবা যেতে ইচ্ছুক নারী শ্রমিকদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করা বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক এসোসিয়েশনর পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলছেন যারা ফিরে আসেন এমন অনেকেই বলেন ভাষা না জানা থাকায় তাদের অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে।
“এখন কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যাতে করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যাওয়ার আগে নারীরা চলার মতো আরবি ভাষাটা একটু শিখে যেতে পারেন যাতে টুকটাক কথা তারা অন্তত বলতে পারে। তবে ভাষা ল্যাব হওয়া দরকার। মধ্যপ্রাচ্যের একেক দেশে একেক ধরণের আরবি। ভাষা হিসেবে শিখতে পারলে উচ্চারণের ধরণ শেখাও সহজ হতে পারতো,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
ভাষা হিসেবে আরবি শেখানোর ক্ষেত্রে সংকট কোথায়?
বাংলাদেশে প্রায় পনের হাজার কওমি মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী আছে প্রায় পনের লাখ। আবার আলিয়া মাদ্রাসা আছে প্রায় দশ হাজার, যার শিক্ষার্থী আছে আরও প্রায় নয় লাখ।
যদিও বেসরকারি হিসেবে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেশি। ধারণা করা হয় যে সব ধরণের মাদ্রাসা মিলে দেশে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় এক কোটি।।
তবে মাদ্রাসায় পড়ুক আর স্কুলে পড়ুক বাংলাদেশে মুসলিম পরিবারে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা সাধারণত শুরু হয় আরবি শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে যার মূল উদ্দেশ্য থাকে কোরআন পড়তে পারা।
অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউছুফ বলছেন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের সবাইকে যদি আরবিকে ভাষা হিসেবে শেখানো যায় তাহলে তাদের কাছে বিশ্বের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে কারণ বৈশ্বিক ভাবে আরবি শক্তিশালী ভাষা।
তিনি বলেন এজন্য প্রথমত সরকারিভাবে ঠিক হওয়া দরকার যে বাংলার পর দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরবি ও ইংরেজি শিখবে।
আরবি যেহেতু ব্যক্তি উদ্যোগে সব মুসলিম পরিবার থেকেই শেখানো হয় তাই এটি সরকারের জন্য নতুন কোন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবেনা বলে মনে করেন তিনি।
তবে আরবিকে ভাষা হিসেবে শেখার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া দরকার বলে মনে করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউছুফ ও মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ।
এগুলো হলো:
১. সরকারী নীতি দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে আরবিকে গুরুত্ব দেয়া
২. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা
৩. দক্ষ ভাষা শিক্ষকের ব্যবস্থা করা
৪. ভাষা শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করা
এসব পদক্ষেপ নেয়া হলে শিশুরা সহজেই বাংলার সাথে আরবিকে ভাষা হিসেবে শেখা শুরু করতে পারবে বলে মনে করেন তারা। @ বিবিসি