বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: দেশে সংসদীয় আসন সংখ্যা ৩০০। তবে সংরক্ষিত আসনের ৫০ জনসহ সদস্য সংখ্যা ৩৫০। এই সাড়ে ৩শ’ আসনের জাতীয় সংসদে বর্তমানে এমপি’র সংখ্যা ৬৪৮ জন। একাদশ জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যারা জয়ী হয়েছেন তারা শপথ নিয়েছেন। একাদশ জাতীয় সংসদের এমপিগণও স্বপদে বহাল রয়েছেন। একটি আসনের বিপরীতে ২ জন এমপি থাকা নিয়ে বিতর্ক চলছে গত ১০ জানয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে জয়ী এমপিদের এই শপথ গ্রহণের পর থেকে। বলা হচ্ছে, নবনির্বাচিত এমপিদের শপথ গ্রহণে সংবিধানের বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করা হয়নি। সংবিধানের নিয়ম অনুযাযী সংসদে একটি আসনের বিপরীতে একাধিক এমপি থাকতে পারেন না। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি’র ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এটি একটি চরম সাংবিধানিক লঙ্ঘনের ঘটনা। সংবিধান অনুসারে এটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। যদিও প্রশ্নটি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পরপরই উঠেছে-বিষয়টি এমন নয়। এবার বিষয়টি ‘সরকারবিরোধী’দের মুখ থেকে নি:সৃত হয়েছে-এই যা।
বিতর্কের শুরু করেন সরকারের জোটসঙ্গীরাই। কিন্তু এবার প্রশ্নটি যেহেতু সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে তোলা হয়েছে তাই এটিকে ‘রাজনৈতিক বিতর্ক’ বলে চট করেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছিলেন, তারা (সরকারবিরোধী) সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা করে রাজনৈতিক ধ্রুমজাল সৃষ্টি করতে চাইছে।
সরকার এবং সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে চলমান এ বিতর্ক হয়তো অন্যান্য বিতর্কের মতোই হয়তো ‘রাজনৈতিক ইস্যু’ হিসেবে ৩০ জানুয়ারির পর হারিয়ে যাবে। কিন্তু বিদ্যমান ব্যবস্থায় এ বিতর্ক উঠবে প্রতিটি সাধারণ নির্বাচনের আগে। এমনকি সংবিধানিক এই প্রশ্ন আরো ঘণিভূত হবে। চিরবিতর্কের বিষয়বস্তু হিসেবে তারার মতো জ্বলজ্বল করবে সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ সংশোধন হওয়ার আগ পর্যন্ত।
এ প্রশ্ন এবং বিতর্ক যে দেখা দেবে সেটির ইঙ্গিত মিলেছিলো সংবিধান থেকে তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়ার পরপর। বর্তমানে সরকারের ১৪দলীয় জোটের দীর্ঘ সঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন প্রশ্নটি প্রথম উত্থাপন করেন। তিনি দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত হয়ে এখনও জোটবদ্ধ রয়েছেন। ১২ বছরেও সাংবিধানিক যে বিতর্কের অবসান হয়নি-সংবিধান সংশোধন না হওয়ার আগ পর্যন্ত বিতর্কটি ক্রম:ধুমায়িত হবে-এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে থাকলে ভবিষ্যতে প্রতিবারই এ প্রশ্ন উঠবে। যা হয়তো সাংবিধানিক এ বিতর্ককে চিরায়ত রূপ দেবে।
এ বাস্তবতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত দিলেন। বলেছেন, এখন দেশে ৬৪৮ জন সংসদ সদস্য (এমপি) রয়েছেন-মর্মে যে আলোচনা চলছে, নীতি-নির্ধারকরা চাইলে সংবিধানের সেই বিষয়ে স্পষ্টীকরণের উদ্যোগ নেয়া হবে। দ্বাদশ সংসদ অধিবেশন শুরুর পূর্ব মুহূর্তে আইনমন্ত্রীর এই ইঙ্গিত বিশ্লেষক মহলে স্বস্তি আনবে।
গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হয় বাংলাদেশে নিযুক্ত সউদী আরবের রাষ্ট্রদূত ইসা বিন ইউসুফ আল-দুহাইলানের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকের পর তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। সাংবাদিকরা জানতে চান, বলা হচ্ছে সংসদে এখন ৬৪৮ এমপি। এটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। মন্ত্রীরা যখন শপথ নেন তখন আগের মন্ত্রিসভা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এমপিগণ শপথ নিলেও আগের সংসদ বাতিল হয় না। সেক্ষেত্রে আইনের অস্পষ্টতা আছে কি না ? থাকলে সেটি স্পষ্ট করার উদ্যোগ নেয়া হবে কি না। জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানে এখন যা আছে, সেভাবেই দেশ চলছে এবং এটা আজকে সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়নি। এটা চতুর্দশ সংশোধনীতে সংযোজন করা হয়েছিলো। এখন যে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করা হচ্ছে, এটির বোধ হয় খুব একটা গুরুত্ব নেই। ‘আইনমন্ত্রী হিসেবে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন নে করেন কি না’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, নীতি-নির্ধারকরা যদি মনে করেন স্পষ্টীকরণের প্রয়োজন আছে, তাহলে দেখা যাবে। স্বস্তির জায়গটা হলো আইনমন্ত্রীর শেষোক্ত কথাটি।
নতুন এমপিদের শপথ গ্রহণের পরপরই জাতীয় সংসদে আসন সংখ্যার দ্বিগুণ (৬৪৮) এমপি বিদ্যমান থাকার কথাটি ওঠে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিদের শপথ নিয়ে সংবিধানে যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেটি সম্পূর্ণরূপে অনুসরণ করা হয়নি। তিনি বলেন, সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, মেয়াদ পূর্তির পর নতুন নির্বাচিতরা কার্যভার গ্রহণ করবেন। এখানে শপথ নিয়ে তো নির্বাচিতরা বসে থাকবেন না। কার্যভার গ্রহণ মানে শপথ নিবে। একাদশ সংসদের মেয়াদ পূর্তি হবে ২৯ জানুয়ারি। অতএব এখানে দু’টি সংসদের এমপিগণ বিদ্যমান আছেন।
ড. শাহদীন মালিক আরো বলেছেন, সংবিধানের ১২৩-এর (খ) অনুচ্ছেদে বলা আছে, পাঁচ বছরের আগে সংসদ ভেঙে দিলে ভেঙে দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। আর সংসদ ভেঙে না দিলে, সংসদ যদি পূর্ণ মেয়াদ হয়, তাহলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। তারপর স্পষ্ট করে বলা আছে, তবে শর্ত থাকে যে, নতুন সংসদের সংসদ-সদস্যরা বর্তমান সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর কার্যভার গ্রহণ করবেন। আমি মনে করি, এখানে সংবিধানের যে বাধ্যবাধকতা আছে, তা সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করা হয়নি।
তার এ বক্তব্যের সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ২০১২ সালের ২৫ জুন ১৪দলীয় নেতা (তৎকালিন মহাজোট) ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি সাধারণ নির্বাচনের আগে জাতীয় সংসদের বিলুপ্তি দাবি করেন। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন, জাতীয় সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন করা হলে জটিলতা সৃষ্টি হবে। তার যুক্তি ছিলো, সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার পর নির্বাচন হতে পারে অথবা বর্তমান বিধান অনুযায়ী ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের ৩ মাসের মধ্যেও হতে পারে। পরে একইবছর ২৯ জুন সংবাদ সম্মেলন করে রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, সংবিধান ধর্ম গ্রন্থ নয় যে পরিবর্তন করা যাবে না। সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে। প্রয়োজনে আবার হবে। সংবিধানের পঞ্চমদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়ার পর সংবিধানের বর্তমান ধারা অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে। এ সময় বিদ্যমান এমপিদের ক্ষমতাও বিদ্যমান থাকবে যেটা নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, অতীতেও সংবিধান সংশোধন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। ৭২ এর সংবিধানে এটা করা উচিৎ হয়নি। ৯১ এর আগে কোনো সংসদই ৫ বছর মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। তাই সমস্যাও ধরা পড়েনি। এছাড়া ৯১ এর পরও এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি। তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ৭২ এর সংবিধান অনুযায়ী ৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগের তিন মাসের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়টি আসেনি। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ বহাল রেখে নয়, সংসদ বিলুপ্ত করেই নির্বাচন হয়। এ উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। বর্তমান বাস্তবতায় হয় নির্বাচনের আগে সংসদ বিলুপ্ত করতে হবে, না হয় সংসদের মেয়াদ ৫ বছর পূর্ণ করে নির্বাচন দিতে হবে। সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে এটা করতে হবে।
উল্লেখ করা যেতে পারে, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত ‘সংবিধান সংশোধন বিশেষ কমিটি’র সদস্যও ছিলেন রাশেদ খান মেনন।
এক যুগ আগে ওঠা প্রশ্নটিই এবার তুলেছে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিসহ অন্য দলগুলো। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট রূহুল কবির রিজভি বলেছেন, এ মুহূর্তে একাদশ সংসদের ৩৪৯ জন আর দ্বাদশ সংসদের ২৯৯ জনসহ মোট ৬৪৮ জন শপথবদ্ধ এমপি রয়েছেন। এখন প্রেসিডেন্ট সংসদ অধিবেশন ডাকলে দুই সংসদের এমপিগণই তাতে যোগ দিতে পারেন। অথচ এটি সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। তিনি ২৯ জানুয়ারি একাদশ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া অবধি এই অরাজকতা থাকবে। এটি একটি চরম সাংবিধানিক লঙ্ঘন। সংবিধান অনুসারে এটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। বিএনপি’র এই বক্তব্যে-সঙ্কটের শেষ না শুরু- সেই প্রশ্নই তুলেছেন বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, আইনমন্ত্রী হয়তো সরকারের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারকদের নির্দেশনা অনুসারে বিষয়টি স্পষ্ট করলেন। এতেই বিতর্কের চির অবসান নাও ঘটতে পারে। কারণ বর্তমান সংসদের দ্বিগুণ এমপি পদ নিয়ে প্রশ্ন তোলার প্রেক্ষাপট তামাদি হয়ে যাবে না।
প্রসঙ্গত: গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এতে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, তৃণমূল বিএনপিসহ ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। ২৯৯টি আসনের বেসরকারি ফলাফলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ২২৩টি, জাতীয় পার্টি ১১টি ও ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পায়। এরপর গত ১০ জানুয়ারি নবনির্বাচিত এমপিগণ শপথ নেন। পরদিন ১১ জানুয়ারি বঙ্গভবনে শপথ নেন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা।