বাংলাদেশ ডেস্ক: আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ৪২ ধরনের নিরাপত্তা ছক চূড়ান্ত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এসব পদক্ষেপ নেওয়া হবে তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে। দীর্ঘদিন নির্বাচন সম্পর্কে জনসাধারণের নেতিবাচক মনোভাব থাকায় তাদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ইসি এসব পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
তফসিল ঘোষণার তিন মাস আগে তৈরি এই পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সফলভাবে ভালো একটি নির্বাচন সম্পন্ন করা। নির্বাচন কমিশন প্রত্যাশা করে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, দপ্তর-অধিদপ্তর ও সংস্থা কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। নির্বাচন পরিচালনা-২ অধিশাখার তৈরি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত সভার কার্যপত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে নির্বাচনি এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার নিমিত্তে কমিশন এই প্রস্তুতিমূলক প্রস্তাবনা তৈরি করেছে।
তফসিল ঘোষণার আগে ও পরে বাস্তবায়নের জন্য ইসির তৈরি করা প্রস্তাবনায় রয়েছে- অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার রোধ ও নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ গ্রহণ, মনোনয়নপত্র দাখিল থেকে প্রতীক বরাদ্দ পর্যন্ত কার্যক্রম সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পাদন, সারা দেশ থেকে পোস্টার, ব্যানার, গেট, তোরণ ইত্যাদি প্রচারসামগ্রী অপসারণ, বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে করণীয় নির্ধারণ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
ভোটের এলাকায় অবৈধ প্রভাব বিস্তারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনায় আরো রয়েছেÑ নির্বাচনি দ্রব্যাদি পরিবহন, সংরক্ষণ ও বিতরণে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ; রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়, সহকারী রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়, অঞ্চল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নির্বাচন অফিসের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, রিটার্নিং অফিসার ও সহকারী রিটার্নিং অফিসারের বাসস্থান এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তাসহ বাসস্থানের নিরাপত্তা জোরদারকরণ, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট ও ইলেক্টোরাল ইনকোয়ারি কমিটির দায়িত্ব পালনকালে টিমের সঙ্গে পুলিশ ফোর্স মোতায়েন নিশ্চিতকরণ, নির্বাচন-পূর্ব শান্তিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টিতে করণীয় নির্ধারণ; নির্বাচনি আইন, বিধিবিধান প্রতিপালন নিশ্চিতকরণে করণীয় নির্ধারণ এবং নির্বাচনি আইনের কতিপয় বিধান সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনের পরিবেশ সুগম করা।
নির্বাচন এলে সংঘর্ষ লেগেই থাকে প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। এতে সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নির্বাচনপূর্ব, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখাবিষয়ক পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রস্তাবনায়। এ ছাড়া প্রস্তাবনায় আরো রয়েছে- নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েনের পরিকল্পনা প্রণয়ন, ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মতামত/পরামর্শের আলোকে শান্তি-শৃঙ্খলাবিষয়ক কার্যক্রম গ্রহণ; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন ও সুসংহতকরণ, নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের সহযোগিতা; সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মূল্যায়ন, পর্যালোচনা; ভোটকেন্দ্রের স্থাপনা মেরামত ও ভৌত অবকাঠামো সংস্কার, ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত ও নির্বাচনি দায়িত্ব পালন, পার্বত্য এলাকায় নির্বাচনি দ্রব্যাদি পরিবহন এবং ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ভোটকেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য হেলিকপ্টার সহায়তা প্রদান এবং নির্বাচনি প্রচার, জনসচেতনতা, উদ্বুদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রচারমাধ্যম কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইসির প্রস্তাবনায় রয়েছে- পর্যবেক্ষক নিয়োগে সহায়তা প্রদান, পোস্টাল ব্যালটে ভোটপ্রদানের বিষয়ে সহযোগিতা, ঋণখেলাপি-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, সংকলন ও প্রদানবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত, নির্বাচন উপলক্ষে ব্যয় নির্বাহের জন্য বাজেট বরাদ্দ ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রম, জনবল, যানবাহন এবং লজিস্টিক সাপোর্ট; নির্বাচনে শান্তিশৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণে স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ, নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালনের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ; বার্ষিক ও পাবলিক পরীক্ষার সময়সূচি পর্যালোচনা, দৈনন্দিন আবহাওয়ার পূর্বাভাস-সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা এবং ভোটগ্রহণ ও নির্বাচনি বিভিন্ন কার্যক্রম উপলক্ষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।
নির্বাচনের সময় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মেডিকেল টিম গঠন ও প্রাসঙ্গিক কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ ছাড়া প্রস্তাবনায় আরো রয়েছে- অগ্নিকাণ্ড ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স কর্তৃক তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ, নির্বাচনি এলাকায় বিদ্যমান নির্বাচনি প্রচারসামগ্রী অপসারণ, নির্বাচনকালীন যানবাহন ও নৌযান চলাচলের নিষেধাজ্ঞা, প্রবাসী ভোটারদের ভোটদান প্রক্রিয়া এবং নির্বাচনকালীন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ভুল ও অপতথ্যের প্রচার প্রতিরোধ।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার রোধ ও নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে প্রস্তাবনায় বলা হয়, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনি এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীদের দমন এবং অনুরূপ কার্যক্রম জোরদার করার জন্য যৌথ অভিযানের অথবা অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন হবে। এ লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো যেতে পারে।
প্রচারসামগ্রী অপসারণ বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়, বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে সারা দেশের সব স্থাপনা/বাড়ি থেকে নিজ দায়িত্বে ও নিজ খরচে প্রচারসামগ্রী অপসারণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে উক্তরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ও মাঠ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট শাখাকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানানো যেতে পারে।
বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্বাচনকে প্রভাবমুক্ত রাখার জন্য বৈধ অস্ত্র প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের লক্ষ্যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যতীত বৈধ লাইসেন্সধারী অস্ত্র মালিকদের বিশেষ করে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের অস্ত্রসহ চলাচলে বাধা-নিষেধ প্রয়োগ, ক্ষেত্রবিশেষে সীমিত সময়ের জন্য অস্ত্র থানায় জমা দেওয়ার বিষয়ে আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রয়োজন। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকে যাতে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সধারীরা অস্ত্রসহ চলাচল না করেন, সেজন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবেন। এ বিষয়ে নির্বাচনের পূর্বেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা নির্দেশনা প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে স্থানীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্বাচনকালীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি রক্ষা ও সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও নিরীহদের নিরাপত্তা এবং তাদের ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পূর্বশর্ত। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। এ লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।
নির্বাচনপূর্ব ও নির্বাচন-পরবর্তীতে বহিরাগত প্রভাবশালী এবং অবৈধ প্রভাব বিস্তারকারীদের দমনের লক্ষ্যে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে উল্লেখ করা হয় প্রস্তাবনায়। এ লক্ষ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে নির্বাচনের ২৪ ঘণ্টা আগে বহিরাগতদের বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা যেতে পারে।
নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টিকরণ প্রসঙ্গে প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এ লক্ষ্যে নির্বাচনপূর্ণ অনিয়ম রোধ তথা নির্বাচনি আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিতকরণ এবং নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ অবস্থান সুসংহতকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। এ লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো যেতে পারে।
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা ও নির্বাচনি এলাকায় শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন-সংক্রান্ত বিষয়ে প্রস্তাবনায় বলা হয়, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটগ্রহণের পর পর্যন্ত নির্বাচনি এলাকায় প্রচলিত আইন, নির্বাচনি বিধিবিধান ও পদ্ধতিগতভাবে স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশ বাহিনী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যথাসময়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রস্তাবনা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কিছু কৌশল বাস্তবায়ন করবে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নিয়ে বাস্তবায়ন করবে।
এ প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। সব ধরনের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে শুধু নির্বাচন কমিশনই নয়, এর দায় নির্বাচনি কর্মকর্তাদেরও বহন করতে হবে। জীবন ঝুঁকির মুখে পড়লেও নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম বা ফাঁকিবাজি বরদাশত করা হবে না।