পরিবেশ নিউজ ডেস্ক: নবজাতক শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ খাবার হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। কিন্তু তাও দূষণের শিকার। সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এতে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন।
ইতালির পলিটেকনিকা দেল মারচে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরিতে ৩৪ সদ্য প্রসূতি মায়ের বুকের দুধের নমুনা সংগ্রহ করে এই পরীক্ষা চালানো হয়। এতে ৭৫ শতাংশের মাঝেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায়।
এর আগে একই বিজ্ঞানী দল মায়ের গর্ভের ফুলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি শনাক্ত করে। তারও আগে ডাচ ন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমন সিসের এক গবেষণায় মানুষের রক্তেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি মিলেছে।
ওই গবেষণায় ২২ ব্যক্তির রক্তের নমুনা বিশ্লেষণ করে ১৭ জন বা ৮০ শতাংশের রক্তেই এ উপাদান শনাক্ত হয়। তিনটি গবেষণা প্রতিবেদনই গত বছরের মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।
এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টন এবং টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণায় ঢাকার বাতাসে বিষাক্ত এই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গবেষকরা ঢাকার ১৩টি এলাকা থেকে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে এই চিত্র পেয়েছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হলো এমন প্লাস্টিক যার দৈর্ঘ্য ৫ মিলিমিটারের কম।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্ষব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আতিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, মায়ের বুকের দুধে কিংবা মানুষের রক্তে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব দেহের কী ক্ষতি করে সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য প্রকাশ করেননি।
তবে এটা ঠিক যে, যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন প্লাস্টিক একটি অপচনশীল পদার্থ। রক্তে থাকলে তা হার্ট, কিডনি এবং কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। বাতাসে ভাসমান প্লাস্টিক ফুসফুসের ক্ষতি করে।
আর বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা প্লাস্টিক পরিপাকতন্ত্রের ক্ষতি করে। এগুলোর সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর দিক হচ্ছে মানুষের ক্যানসারের আশঙ্কা। আসলে সর্বগ্রাসী ভয়ংকর উপাদানে পরিণত হয়েছে প্লাস্টিক দূষণ।
মানুষ রক্ষা করতে হলে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করতেই হবে। আর এ লক্ষ্যে প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধই একমাত্র সমাধান। আর ইতালির পলিটেকনিকা দেল মারচে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ভ্যালেন্তিনা নোতার স্তেফানো ৭ অক্টোবর দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলেন, ‘বুকের দুধে প্লাস্টিক কণার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে নবজাতকদের জন্য আমাদের উদ্বেগ বেড়েছে। গর্ভাবস্থায় ও স্তন্যপানের সময়ে কীভাবে এগুলোর সংস্পর্শ কমানো যায়, তা বের করা জরুরি। তবে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতির চেয়ে শিশুর জন্য মায়ের দুধ অনেক বেশি উপকারী।
প্লাস্টিক দূষণের এমন পরিস্থিতিতে আজ বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালিত হচ্ছে। মানুষকে রক্ষার লক্ষ্যে এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘বিটপ্লাস্টিকপলুশন’ (প্লাস্টিক দূষণ ঠেকাও)। বাংলাদেশে এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে শামিল হই সকলে।’ আর স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ।’ দিবসটি উপলক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় অন্যান্য বছরের মতো এবারও পরিবেশ মেলা, জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা এবং পরিবেশ পদক বিতরণ করবে। আজ সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন করবেন। এছাড়া শেরেবাংলা নগরে পরিবেশ মেলা চলবে ১১ জুন পর্যন্ত এবং বৃক্ষমেলা চলবে ১২ জুলাই পর্যন্ত।
পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস তার বাণীতে প্লাস্টিক দূষণ রোধের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আমরা যে খাবার খাই, পানি পান করি এবং যে বায়ুতে শ্বাস নেই-প্লাস্টিকের কণাগুলো তাতে মিশে যায়। প্লাস্টিক তৈরি হয় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে। আমরা যত বেশি প্লাস্টিক উৎপাদন করি, তত বেশি জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়াই এবং জলবায়ু সংকটকে আরও মারাত্মক করে তুলি। তবে এর সমাধান আমাদের হাতে আছে।’
জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, প্লাস্টিক দূষণ একটি নীরব ঘাতক। প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার এক- তৃতীয়াংশ মাত্র একবার ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন আবর্জনাবাহী ২ হাজারের বেশি ট্রাকের সমপরিমাণ প্লাস্টিক আমাদের সমুদ্র, নদী ও হ্রদে ফেলা হয়। এর পরিণতি অত্যন্ত বিপর্যয়কর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের ব্যবহার অনেকটাই ডাল-ভাতের মতো হয়ে গেছে। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে এর ব্যবহার নেই। কিন্তু একটি পতিত প্লাস্টিক ৪০০ বছর লাগে পচে যেতে। প্লাস্টিক মাটিতে গেলে উর্বরতা নষ্ট করে।