বিতর্ক যেন থামছেই না। যারাই ক্ষমতায় থাকে তারাই তাদের গদি ঠিক রাখতে ইচ্ছামতো আইন করে। ইচ্ছামতো আইন করা ঠিক না। তা নাগরিকের জন্য মঙ্গলজনক নয়। সেই আইন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি করে। কোনো আইন করার আগে আইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন, প্র্যাকটিশিয়ান আইনজীবী, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের পরামর্শ নিতে হয়। তারা যে পরামর্শ দেন সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে খসড়া আইনে সন্নিবেশিত করতে হয়। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে যে আইনের খসড়া করা হয়েছে, এটি করার আগে তারা গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে বসেননি।
এমন মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্ট আইনজীবী, সাংবাদিক সংগঠন ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম মনে করেন, কোনো আইনের নাম পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রায়োগিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন হয় না। নাম পরিবর্তন হয়তো সমালোচনার জায়গা থেকে করা হয়েছে। কারণ আইনটির বিরুদ্ধে অনেক বেশি কথা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারের মতে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চরিত্র নিবর্তনমূলক। ওই নিবর্তনমূলক বৈশিষ্ট্য রেখেই সরকার নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার আন্তরিকভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিষয়বস্তু সংশোধন করতে চায় কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
সুপ্রিম কোর্ট সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, প্রস্তাবিত খসড়া আইনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে পড়ে কিছুটা সংশোধন করে তড়িঘড়ি করা হয়েছে। আইনের সংজ্ঞা আগের মতোই বহাল রাখা এবং বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন না আসায় অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সাজা কমানোর কিংবা বাড়ানো কিংবা সাজার মাত্রা পরিবর্তনের ঘটনায় নাগরিকদের অধিকার বা সুরক্ষা হবে না।
যেসব পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তা নাগরিকদের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষায় খুব একটা কাজে আসবে না। প্রস্তাবিত আইনে গুণগত বা উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন নেই। তিনি বলেন, এই আইনটারই দরকার নেই। আমাদের দেশে আগে কেউ কোনো বেফাঁস কথা বললে পেনাল কোড অনুযায়ী বিচার করা হতো। সো এই আইনেরই কোনো প্রয়োজন নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট মূলত মিডিয়াকে রোধ করার জন্য। দেশের গুটিকয়েক মিডিয়া যখন নাগরিকের অধিকার নিয়ে কথা বলছেন, ভোটাধিকার নিশ্চিতে ভূমিকা রাখছেন, তখন সরকার সেই মিডিয়াদের রুখতে এসব আইন করছেন।
সাংবাদিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশ (বিএফইউজে) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নাম পরিবর্তন করে সাইবার নিরাপত্তা আইন করার সিদ্ধান্তকে ‘ভাঁওতাবাজি ও আইওয়াশ’- বলে মন্তব্য করেছে। সাংবাদিকদের এই সংগঠন মনে করে, নতুন আইনের মাধ্যমে সরকার দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠন ও আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে ধোঁকা দেয়ার অপচেষ্টা করছে। নতুন আইনেও ভীতির পরিবেশ অপরিবর্তিত থাকবে এবং নতুন আইনও স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথে অন্তরায় হবে।
সংগঠনের সভাপতি এম. আবদুল্লাহ বলেন, প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনের খসড়ায় যেসব বিধান রেখেছে, তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, বিশিষ্টজনসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ও মতামত ছাড়াই নতুন আইনে মন্ত্রিসভার অনুমোদন সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ বহন করে না।
নতুন আইনে বিভিন্ন ধারায় যে বিধানগুলো সন্নিবেশ করা হচ্ছে, তাতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতোই স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর নিপীড়নের খড়গ ঝুলবে বলে মনে করি। তিনি বলেন, মানহানির জন্য কারাদণ্ডের পরিবর্তে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান অনেকটা ‘যাহা লাউ, তাহাই কদু’র মতো। এত মোটা অঙ্কের জরিমানার ঝুঁকি নিয়ে কেউই স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ ও সাহসী সাংবাদিকতা করতে পারবে না। আবার জরিমানা অনাদায়ে জেলের বিধানও রাখা হয়েছে। নতুন আইনে জামিন অযোগ্য কয়েকটি ধারা জামিনযোগ্য করা হয়েছে, তা ইতিবাচক হলেও দেশের বিচারব্যবস্থার বর্তমান বাস্তবতায় জামিন পাওয়া না-পাওয়া ‘ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছাধীন’ বলে মনে করি।
বিএফইউজে’র মহাসচিব দীপ আজাদ বলেন, আপাতদৃষ্টিতে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও ধন্যবাদ জানাই আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম খসড়াটি অনুমোদন দেয়ার আগে যেন আমাদের সংঙ্গে বসেন। কিন্তু তারা এই আইনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন সাংবাদিক। আর তারা সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গেই বসেননি। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিতর্কিত ৪৩ ধারা বাতিল করার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু সেই ধারাটি হুবুহু নতুন আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেখানে সাংবাদিকদের ৮ম ওয়েজবোর্ডই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না, সেখানে জরিমানার বিধান কয়েকগুণ বাড়ানো হয়েছে। খসড়ায় আমাদের প্রত্যাশিত দাবির প্রতিফলন ঘটেনি। আমরা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খসড়ার উপরে মতামত দেবো।
নতুন সাইবার আইনের খসড়ায় যা আছে-
নতুন আইনের খসড়ায় মোট ধারা ৬০টি। আর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রয়েছে ৬২টি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করলে সাজা বেশি রাখার বিধান ছিল। অপরদিকে প্রস্তাবিত আইনে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রথমবারের জন্য যে সাজা, বারবার করলেও একই সাজা হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধরনের অপরাধকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা প্রায় হুবহু প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করেছিল সংবাদপত্রের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদ।
এখন প্রস্তাবিত আইনে এক্ষেত্রে ৭টি ধারায় সাজা ও জামিনের বিষয়ে সংশোধন আনা হয়েছে। কিন্তু অপরাধের সংজ্ঞা স্পষ্ট করা হয়নি, আগের মতোই রয়ে গেছে। আর দু’টি ধারায় কোনো পরিবর্তনই আনা হয়নি। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দু’টি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিল। প্রস্তাবিত আইনে এই দু’টি ধারা বাতিল না করে সাজা ও জামিনের ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে সংস্থাটি যে আটটি ধারা (৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) সংশোধনের কথা বলেছিল, তার ছয়টিতে পরিবর্তন (মূলত সাজা এবং জামিনের ক্ষেত্রে) করা হয়েছে।
বহুল আলোচিত ২৯ নম্বর ধারাসহ দু’টি ধারায় শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ডের বিধান বাতিল করে জরিমানার পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে থাকা ২১ নম্বর ধারায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করে প্রস্তাবিত সাইবার নিরাপত্তা আইনে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ২১ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালায় বা তাতে মদত দেয় তাহলে সেটি অপরাধ বলে গণ্য হতো এবং এর জন্য ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান ছিল। এই একই অপরাধ কেউ দ্বিতীয়বার করলে তার সাজা দ্বিগুণ করার বিধান ছিল। আর বার বার একই অপরাধের ক্ষেত্রে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৩ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এ ধারাটিতে প্রস্তাবিত আইনে পরিবর্তন এনে সাজার মেয়াদ সাত বছর করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলেও সাজা দ্বিগুণ হবে না।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯, ৩০ ধারাগুলো বাতিলের বিষয়ে সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলের দাবি শুরু থেকেই। এ ধারাগুলো প্রস্তাবিত আইনে বহাল রেখে জামিনযোগ্য করা হয়েছে। ডিএসএ’র ২৮ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করা বা উসকানি দেয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করে, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে তা অপরাধ হবে।
এ অপরাধের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কারাদণ্ড, বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। একই অপরাধ বার বার করলে সাজা ও জরিমানার মেয়াদ দ্বিগুণ হওয়ার বিধান ছিল। ডিএসএ’র ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার করেন, তাহলে তিনি তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। এ ছাড়া একই অপরাধ বার বার করলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল। প্রস্তাবিত আইনে এ ধারায় পরিবর্তন এনে কারাদণ্ডের যে সাজা ছিল সেটিকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। এখানে শাস্তি হবে শুধু জরিমানা। আর জরিমানা অনাদায়ে তিন মাসের কারাদণ্ড হতে পারে।
ডিএসএ’র ৩৩ ধারা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে হ্যাকিং সম্পর্কিত অপরাধ নামে নতুন ধারা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এ অপরাধের শাস্তি অনধিক ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা ১ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। হ্যাকিং হচ্ছে কম্পিউটারের তথ্যভাণ্ডারের কোনো তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তন বা তার মূল্য বা উপযোগিতা কমানো বা অন্য কোনোভাবে ক্ষতিসাধন বা নিজ মালিকানা বা দখলবিহীন কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশের মাধ্যমে তার ক্ষতিসাধন। ডিএসএ’র ৩৩ ধারায় বলা হয়েছিল, যদি কোনো ব্যক্তি কম্পিউটার বা ডিজিটাল সিস্টেমে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা কোনো আর্থিক বা বাণিজ্যিক সংস্থার কোনো তথ্য-উপাত্তের কোনো ধরনের সংযোজন বা বিয়োজন, স্থানান্তর বা স্থানান্তরের উদ্দেশ্যে সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন, তাহলে তা অপরাধ বলে ধরা হবে।