।। হাসনাত আরিয়ান খান ।।
পবিত্র রমজান মাসে প্রতিদিন প্রায় দুই তিনটা করে ইফতারের দাওয়াত থাকে। সব দাওয়াতে আমি এটেন্ড করতে পারিনা। আবার এমন কিছু কিছু দাওয়াত থাকে যে, হাজার অসুবিধা সত্বেও না করতে পারিনা। তেমনি বিলেতের অন্যতম প্রাচীন ও জনপ্রিয় পত্রিকা সাপ্তাহিক সুরমা’র বার্তা সম্পাদক প্রিয়জন কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই যখন পত্রিকা অফিসে ইফতারের দাওয়াত দিলেন, সেই দাওয়াতকে আবার সুরমা’র সম্পাদক শ্রদ্ধেয় শামসুল আলম লিটন ভাই যখন অফিশিয়াল দাওয়াতে রুপ দিলেন, তখন আর না করতে পারলাম না। সাপ্তাহিক সুরমা আমার প্রিয় খবরের কাগজগুলোর মধ্যে অন্যতম। সুরমা’র সাথে জড়িত সকলকে আমি খুবই শ্রদ্ধার চোখে দেখি। ওনাদের সকলের প্রতি ভেতর থেকে একটা টান অনুভব করি। দীর্ঘদিন বিলেতে আছি বলে ওনাদের প্রায় প্রত্যেককে আমি কম বেশি চিনি ও জানি। প্রত্যেকেই দারুণ মেধাবী ও সৎ মানুষ। নির্মোহ, দায়িত্বশীল ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের মানুষ। প্রায় দুই যুগ বিলেতে থাকাকালে এমন কোন সপ্তাহ বাদ যায়নি যে সুরমা পড়িনি। কারণ এই কাগজের সাথে আমি আমার নিজের মিল খুজে পাই। আমি আমার সাংবাদিকতা জীবনে যেমন সব সময় তর্ক করেছি, প্রশ্ন করেছি, কোন অন্যায় দেখলে চিৎকার করেছি, ক্ষমতাবানের মুখের ওপর কথা বলেছি, ভয়-ভীতি-প্রলোভনের ঊর্ধ্বে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি, সব সময় বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করেছি; সাপ্তাহিক সুরমাও এখানে ঠিক তাই করছে। একজন সৎ সাংবাদিক হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা যেমন ছিল শুধু দেশের কাছে, জনসাধারণের কাছে, সত্যের কাছে। সুরমা’র দায়বদ্ধতাও তেমন শুধু দেশের কাছে, জনসাধারণের কাছে, সত্যের কাছে।বাংলাদেশের বর্তমান সংবাদ মাধ্যম নিয়ে বাজারে একটা কৌতুক চালু আছে। ‘নাতি তার দাদাকে প্রশ্ন করছে- দাদা, মোরগ ডাকে কেনো? দাদা বলছেন, কেউ মিথ্যা বললে মোরগ ডাকে। এবার নাতি প্রশ্ন করছে, ভোর রাতে দেশের সব মোরগ ডাকে কেনো? দাদা বলছেন, ভোর রাতে পত্রিকা ছাপার কাজ শেষ হয় তো তাই!’ এই হলো বাংলাদেশের বর্তমান সংবাদ মাধ্যমের অবস্থা। ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ এর ভয়ে সাংবাদিকরা সত্য প্রকাশে ভয় পাচ্ছেন। কেউ কেউ ‘সেলফ সেন্সরশীপ’ আরোপ করে চলছেন। বিটিভির মতো এক তরফা উন্নয়নের গল্প শুনতে শুনতে মানুষ এখন পত্রিকা পড়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার বলেছেন, ‘দ্যা নেচার অব বেড নিউজ ইনফেক্ট দ্যা টেলার’। অনৈতিক খবর বা ইয়েলো জার্নালিজম সংবাদপত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সুনাম ও সুখ্যাতি নষ্ট করে; জাতির সর্বনাশ করে। আর দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা পত্রিকার সুনাম বৃদ্ধি করে, দেশের উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, সত্য-সুন্দর এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে অপরিসীম ভুমিকা রাখে। আর তার জন্যই সাংবাদিকতাকে থাকতে হয় স্বাধীন। সাপ্তাহিক সুরমা স্বাধীন। বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে বিলেতের কিছু কাগজের চরিত্র বদলালেও, সাপ্তাহিক সুরমার চরিত্র সব সময় একই আছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা করেছে, স্বাধীন সাংবাদিকতা করছে। একারণেই শত প্রতিকূলতা সত্বেও কাগজটি আজও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।
নির্দিষ্ট দিনে সুরমা অফিসে হাজির হলাম। কলিং বেলে চাপ দিতেই সুরমা সম্পাদক লিটন ভাই দরজা খুলে দিলেন এবং আমাকে সাপ্তাহিক সুরমা’য় ওয়েলকাম করলেন। লিটন ভাইয়ের কাছের মানুষেরা জানেন, উনি আসলে সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রেস সেক্রেটারি এইসব পরিচয়ের বাইরে একজন অতিথিপরায়ন, আমুদে, সরল, স্বপ্নবাজ ও অত্যন্ত প্রগতিশীল একজন মানুষ। অতিথি এসে পড়ায় লিটন ভাই অফিসের কাজ বন্ধ করে দিলেন। সুরমা অফিসে এই আমার প্রথম আসা হলেও দীর্ঘ প্রায় দুই যুগ বিলেতে থাকায় ও সুরমা’র একনিষ্ঠ পাঠক হওয়ায় বুঝে গেছি, কবি ও কলামিস্ট ফরীদ আহমদ রেজা ভাই ও ময়েজ ভাইয়েরা কীভাবে লিখেন। লিটন ভাই কোন স্টাইলের লেখা পছন্দ করেন বা নিজে লিখেন। কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই কোন শব্দগুলোকে আদরণীয় করে নেন, জানা ছিল সেসব। আমার আগমনের খবর শুনে সুরমার প্রধান সম্পাদক দ্যা গ্রেট ফরীদ আহমেদ রেজা ভাই প্রিয় ফল ডালিমের সাথে বক্স এ আরও কী কী যেনো নিয়ে অফিসে আসলেন। আমাকে দেখেই বললেন, ও আপনিই ‘খান’! আপনার লেখা পড়ে আমি আরও ভেবেছিলাম আপনি আমার বয়সী কেউ হবেন, আমার মত সত্তর-উর্ধো কেউ হবেন। কিন্তু আপনার বয়স তো অনেক কম! লিটন ভাইকে বললেন, এই রত্নকে কোথায় পেলেন! এরপর আমাকে ওনার পাশে বসিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। চশমার কাচের ওপাশে সন্দিগ্ধ দৃষ্টি, ওনার তো আগ্রহের শেষ নেই -শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, কত কী! ফরীদ রেজা ভাইয়ের এই নিরলস ও অন্তহীন দেশপ্রেমের কথা আমরা সবাই জানি। অসম্ভব গুণী একজন মানুষ, সাংবাদিকতার শিক্ষক। বললেন, ‘আমার সকল লেখাই তিনি পড়েন। আমার নিউজ পোর্টালের খোজও তিনি রাখেন’। তিনি লিটন ভাইয়ের কাছে আমার লেখার অনেক অনেক প্রশংসা করলেন। লিটন ভাই নিজেও সেই প্রশংসায় যোগ দিলেন। দু‘জনে মিলে প্রশংসূচক আরও কী কী যেনো বললেন। শোনে আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললাম। কবি ও কলামিস্ট ময়েজ ভাই বাসা থেকে অনেক খাবার নিয়ে এসে আমার নিচু মাথাটা উচু করে ধরে বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। মাল্টি ট্যালেন্টেড ময়েজ ভাই যেমন বড় মাপের মানুষ, তেমনি তার কাজের ব্যাপ্তিও অনেক বড়। ময়েজ ভাই এতদিন আমাকে মাস্ক পড়া অবস্থায় দেখছেন। এই প্রথম আমাকে মাস্ক ছাড়া দেখলেন বলে তিনি নিজেই জানালেন। তারপর পাশে বসিয়ে আমার শিক্ষাগুরু উন্নত রুচী ও রসবোধসম্পন্ন প্রজ্ঞাদীপ্ত অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে তিনি একবার কিভাবে জব্দ করেছিলেন, সেই গল্প করলেন। কথার মানুষ, কথার জাদুকর সায়ীদ স্যারকে কথায় জব্দ করা ময়েজ ভাইয়ের মত একজন বাউলের পক্ষেই কেবল সম্ভব। এজন্যই বোধহয় ময়েজ ভাইকে স্যার অনেক পছন্দ করেন এবং ‘আমার প্রিয় বাউল’ বলে সম্ভোধন করেন। যাই হোক, একটু পর প্রিয় বড় ভাই মতিউর রহমান চৌধুরী প্রবেশ করলেন। ফরীদ রেজা ভাই মতি ভাইকেও আমার সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কী কী যেনো বললেন। সবশেষে বললেন, এই রত্নকে আগলে রাখতে হবে। মতি ভাই মাথা নেড়ে সায় দিলেন। ফরীদ রেজা ভাই বট বৃক্ষের মত আশেপাশের মানুষকে আগলে রাখেন। বিশেষ করে তিনি যাদের লেখা পছন্দ করেন তাদেরকে নিজে আগলে রাখেন এবং অন্যদেরকে আগলে রাখতে বলেন। কিছু কিছু মানুষের বিরাট শক্তি থাকে অন্যকে কাছে টানার। তাঁদের ব্যক্তিত্বের অনুপম সৌন্দর্য, চরিত্রের মাধুর্য, প্রজ্ঞার পরিধি ও নিখাদ আন্তরিকতা কাছের মানুষদেরকে পুন:পুন ভালবাসায় সিক্ত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে। ফরীদ রেজা ভাই তেমনি একজন মানুষ। সাপ্তাহিক সুরমা’র প্রধান সম্পাদক কবি ও কলামিস্ট ফরীদ রেজা ভাই বিলেতে আমাদের চার খলিফা/ চার বট বৃক্ষের বড় এক বৃক্ষ হয়ে আমাদেরকে, কমিউনিটির মানুষদেরকে ছায়া দিচ্ছেন। ফরীদ রেজা ভাইদের পরবর্তী প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে লিটন ভাই ও ময়েজ ভাইয়েরা ইতিমধ্যে আমাদের বট বৃক্ষ হয়ে উঠেছেন। জানি ওনাদের এতটা প্রশংসা বা ভালোবাসা পাবার যোগ্য আমি না। আমি খুবই ক্ষুদ্র একজন মানুষ, খুবই নগণ্য একজন মানুষ। তারপরও এমন বড় মাপের মানুষদের মুখে এমন প্রশংসা শুনে গর্বে বুকটা ফুলে উঠলো। রজনীকান্ত সেনের ওই গানটার কথা মনে পড়লো— ‘আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু কম করে মোরে দাওনি; যা দিয়েছো, তারে অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাওনি’।
একটু পর সুরমার প্রাক্তন সম্পাদক ও টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের বর্তমান মেয়র জন বিগস এর পলিটিক্যাল এডভাইজার সৈয়দ মনসুর উদ্দিন ভাই এলেন। মনসুর ভাই সুরমা অফিসে প্রবেশ করেই বললেন, গ্রুপে আপনার একটা লেখা পড়ে আমি নিজে নিজেই অনেকক্ষণ হেসেছি। তারপর প্রথম আলো’র তবারককে ফরোয়ার্ড করে বলেছি, ‘এই লোকের উইট মারাত্বক’। এরপর আমাকে অবাক করে দিয়ে তীব্র রসবোধসম্পন্ন মনসুর ভাই প্রতি রবিবারে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আমাকে একটা রিভিউ দিতে অনুরোধ করলেন। আমি বললাম, এতে আপনার সমস্যা হতে পারে। একাধিকবার একা একাই হাসার মত কাণ্ড ঘটতে দেখলে আপনার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে ভাবী সন্দেহ করতে পারেন। মনসুর ভাই শুনতে পেলেন কিনা বুঝা গেলোনা। এদিকে আমাকে দেখে সদা হাস্যোজ্জল, বিনয়ী ও পরোপকারী সুরমা’র বার্তা সম্পাদক কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই নান্না বিরিয়ানীর সাথে খোদ নান্না ভাইকেই উঠিয়ে আনলেন। কবি কাইয়ুম আব্দুল্লাহ ভাই ও সুরমা’র সাবেক সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাসন ভাই আমার কোন লেখা চোখে পড়লেই সাথে সাথে আমাকে ফোনে করে জানান দেন। এর মাঝে লেখক ও গবেষক ফারুক আহমেদ সুরমা অফিসে এলেন। ফারুক ভাইকে আমার নাম বলতেই তিনি চিনলেন অথবা ভদ্রতাবশত চেনার ভান করলেন। সরলা পল্লীবালা কিশোরীদের মত পুরোটা সময় তিনি নিজেকে গুটিয়ে রাখলেন। জড়োসড়ো হয়ে বসে শুধু অন্যদের কথা শুনলেন। একটু পর সুরমা‘র ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট আখলাক ভাই এলেন। একেতো ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট, তার ওপর আবার দেশে বিচারক ছিলেন। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো গুরু গম্ভীর মানুষ হবেন। কিন্তু না, তিনি এসেই আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে রাজনীতির মধ্যে পলিটিক্স ঢুকালেন। ‘চ্যানেল এস’ এর জুবায়ের ভাই থাকলে বলতেন, ‘খুন করলে একটা কথা ছিলো কিন্তু আপনি মার্ডার করিলাইছেন’! সানরাইজ টুডে’র সম্পাদক এনাম চৌধুরী ভাই খেজুর হাতে সুরমা অফিসে সঙ্গ দিতে এলেন। সুরমা’র স্পেশাল কন্ট্রিবিউটর ডরিনা ভাবী অফিসে প্রবেশ করে আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বোধহয় কিছুটা ধাক্কা খেলেন, ‘এই লোকটাই কি অমন মজা করে লেখেন’! চুপচাপ বসে খেয়াল করলাম, লিটন ভাইয়ের ভক্ত ছোট্র পরী ঐশী সবাইকে খুব ভালোভাবে অবজার্ভ করছেন। সোমা দি যিনি সন্মানী ছাড়া কথা বলেন না, শুধু টিভি চ্যানেলেই কথা বলেন তিনিও হাত নেড়ে নেড়ে সবার সাথে কথা বলছেন। সুরমা‘র সাহিত্য সম্পাদক সৈয়দ রুম্মান ভাই কাপড়ের মোজার ওপর মাসেহ করলে ওজু হবে কিনা, ফরীদ রেজা ভাইকে জিজ্ঞাসা করছেন। খেলা নিয়ে যিনি ভাবেন, খেলাকে যিনি ধ্যানজ্ঞান মনে করেন, সুরমা‘র সেই স্পোর্টস রিপোর্টার শরিফ ভাই এগিয়ে এসে আমার নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, তিনি আমার লেখার সাথে আগে থেকেই পরিচিত ছিলেন। কিন্তু আজই আমাকে প্রথম দেখলেন। শরিফ ভাইয়ের সাথে আমার আগে কথা না হলেও আমি তাকে চিনতাম। এই প্রথম কথা হলো। তিনি আমার লেখার অনেক প্রশংসা করলেন। আমি পেশাদার কোন লেখক না, আমি বিখ্যাত কোন লেখক না। মনের আনন্দে মাঝে মাঝে এটা সেটা লিখি। আমার সেই অখাদ্য লেখা যে ফরীদ রেজা ভাই, লিটন ভাই, ময়েজ ভাই, মনসূর ভাই, কাইয়ুম ভাই, ডরিনা ভাবী ও শরিফ ভাইয়ের মত বড় মাপের মানুষেরা, ওনাদের মত বিদগ্ধ পাঠক ও লেখকেরা পড়েন, আমি জানতাম না। জীবনে এই প্রথম নিজের লেখালেখি নিয়ে আমি গর্ববোধ করলাম এবং এই বড় মাপের মানুষদের হৃদয়ের উষ্ণতা ও সান্নিধ্য পাওয়ার লোভে যতদিন বেচে থাকি লেখালেখি চালিয়ে যাবো, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম। ফ্ল্যাশ ব্যাকে একটু পেছনে ফিরে গেলাম। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও আমি তো আসলে লেখকই হতে চেয়েছি। লেখক হওয়ার আগে ভালো পাঠক হওয়ার জন্য আমি পাঠ্য বইয়ের বাইরেও প্রচুর বই পড়েছি। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে একটা দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের পাঠ চক্রে ভর্তি হয়েছি। স্যারকে আমার শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি, স্যারের স্নেহধন্য হয়েছি, স্যারের মত পরশ পাথরের সংস্পর্শে এসেছি- সবই লেখক হওয়ার জন্যই। ইতিমধ্যে ইফতারের সময় হয়ে এলো। লিটন ভাই ফরীদ রেজা ভাইকে দোয়া করতে অনুরোধ করলেন। ফরীদ রেজা ভাই প্রথাগত দোয়া না করে ছোট্র একটা বয়ান দিলেন। বললেন, ‘রোজা আমরা সবাই রাখি। কিন্তু রোজা রেখে মানুষ হতে পারলাম কিনা বা কতটুকু মানুষ হলাম এটাই হচ্ছে প্রধান ব্যাপার’। খুবই সুন্দর কথা। রোজার লক্ষ্য ও রোজার মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে এর চেয়ে সুন্দর কথা আর হয় না। ইফতারের আগের সময় যেহেতু দোয়া কবুলের সময়, বয়ান শেষে তিনি মনে মনে সবাইকে যার যা চাওয়া আল্লাহর কাছে চাইতে বললেন। আমার খু্বই ভালো লাগলো।
ইফতার শেষে পুতিন ভক্ত কলামিস্ট ইমরান চৌধুরী সুরমা অফিসে আসলেন। বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে চমৎকার কথা বলে তিনি পুতিন ও রাশিয়ায় জয় নিশ্চিত করে তারপর বাংলা পোস্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে সবাইকে সেধে সেধে নিজের ভিজিটিং কার্ড দিলেন। একসময় বলা হতো, বাংলাদেশে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি। এখন সম্ভবত ‘কবি’র বদলে অনায়াসে সেখানে ‘কলামিস্ট’ বসিয়ে দেওয়া যায়। খুবই স্বাভাবিক যে, সংখ্যা যতই বাড়ুক, নাম দেখলেই ‘লেখাটা পড়তেই হবে’ এমন ইচ্ছা জাগানো কলাম লেখক খুব বেশি নেই এখন। থাকার কথাও না, সব সময়ই হাতে গোণা দুয়েকজনই এমন থাকেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার এই শ্রেণিতে পড়েন। মানুষটার লেখা-কথা আর কাজে কোনো বৈপরীত্য নেই। শফিক রেহমান ও আবদুল গাফফার চৌধুরীর রাজনৈতিক আদর্শের সাথে অনেকে একমত না হতে পারেন। কিন্তু তাদের লেখা পড়তে শুরু করলে পাঠক তা শেষ করতে বাধ্য হবেন। যতটা না রাজনীতি বুঝতে, তার চেয়ে বেশি তাদের স্বাদু গদ্যের টানে। পড়তে শুরু করলে যা শেষ পর্যন্ত পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। ইফতারের পর আড্ডা ভালোই জমছিলো। সুরমা অফিস থেকে বের হতে মন না চাইলেও তারাবি নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত উঠতে হলো। আসার আগে ময়েজ ভাই প্রতি শুক্রবারের আড্ডায় যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। লিটন ভাই সুরমা‘র জন্য লেখা চাইলেন। সবকিছু মিলিয়ে একটি অনন্য সাধারণ সন্ধ্যা কাটলো সুরমা অফিসে। এ অনুভূতি প্রকাশ করার ভাষা নেই। এ যেন আরেক পরিবার। এরকম আনন্দমুখর সময় উপহার দেয়ার জন্য ফরীদ রেজা ভাই, লিটন ভাই, ময়েজ ভাই, কাইয়ুম ভাই, মতি ভাই, আখলাক ভাই, ডরিনা ভাবী, সোমা দি, ছোট্র পরী ঐশী, ফারুক ভাই, নান্না ভাই, শরিফ ভাই, রুম্মান ভাই ও এনাম ভাইকে অন্তরের অন্তস্থল থেকে ধন্যবাদ। দোয়া করি, সুরমা পরিবারের এই সম্প্রীতির বন্ধন অটুট থাকুক, সুদৃঢ় হোক! যাঁরা এতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকের মধ্যেও কাগজটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন, আল্লাহপাক তাদের সবাইকে সুস্থ ও সুন্দর রাখুক।
লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন, ইউকে।