- হাসিনাকে নিয়ে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা।
- চিকেন নেক নিয়ে সেনাপ্রধানের উদ্বেগ প্রকাশ।
- ইন্ডিয়াকে টেক্কা দিতে চীন এর মারাত্মক চাল।
লন্ডন, ২১ ফেব্রুয়ারি- প্রায় ১০ বছর ধরে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজিওনাল কো-অপারেশন তথা সার্ক স্তব্ধ হয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার প্রত্যেকে জানেন যে সার্কের পথে কোন দেশ এবং কোন দেশের কাজকর্ম অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৬ সালে উরি হামলার পর থেকে আর সার্কের স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক হয়নি। ওই হামলার পরে ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। তারইমধ্যে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক চালিয়েছিল ইন্ডিয়া। ফলে সার্কের সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
গত সপ্তাহে মাসকটে সার্ককে পুনরুজ্জীবনের দাবি তুলেছে বাংলাদেশ। সেখানে ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন প্রসঙ্গটি উত্থাপন করলেও তা নিয়ে তখন প্রকাশ্যে কোনও কথাই বলেননি ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এমনকি সামাজিক মাধ্যমেও জয়শঙ্কর বিষয়টি উল্লেখ করেননি। ইন্ডিয়ার ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেলেনি। বরং ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিমসটেক নিয়ে কথা বলেছেন। তবে শুক্রবার মুখ খুলেছে ইন্ডিয়া। বাংলাদেশকে বার্তা দিয়ে ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রকের পক্ষ থেকে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) পুনরুজ্জীবন প্রশ্নে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে ইন্ডিয়া।
শুক্রবার নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘মাসকটে ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা সার্ক পুনরুজ্জীবনের প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। সন্ত্রাসবাদের স্বাভাবিকীকরণ করাটা বাংলাদেশের উচিত নয়।’ সন্ত্রাসবাদের সাথে সার্ককে গুলিয়ে ফেলেছে ইন্ডিয়া। অর্থাৎ, ‘সার্ক’ এর পুনরুজ্জীবন চায় না ইন্ডিয়া।
হাসিনাকে নিয়ে ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ দশা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পলাতক খুনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য প্রয়োজনীয় সব নথি ইন্ডিয়াকে পাঠিয়েছে এবং প্রয়োজনে একটি অনুস্মারক পাঠানোর জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম। তাকে উদ্ধৃত করে বিষয়টি জানিয়েছে ওয়াশিংটনভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ডিপ্লোম্যাট। সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে হাসিনার প্রত্যার্পণের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া ও এর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে সংবাদ মাধ্যমটি। সেখানে বলা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশ ইন্ডিয়াকে একটি নোট ভার্বালের (কূটনৈতিক নোট) মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এই অনুরোধ জানালেও এখন পর্যন্ত ইন্ডিয়া কোনো উত্তর দেয়নি। নয়াদিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে এখনো সংযত অবস্থান বজায় রেখেছে এবং বারবার অনুসন্ধান করা হলেও তারা প্রাথমিক স্বীকৃতির বাইরে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত এবং ২০১৬ সালে সংশোধিত বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া প্রত্যর্পণ চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চাওয়ার আইনি অধিকার রাখে। তবে এই চুক্তি কার্যকর করা শুধুমাত্র আইনি প্রক্রিয়ায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি এক জটিল ভূ-রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইন্ডিয়া যদি এই প্রত্যর্পণ অনুরোধ মেনে নেয়, তবে এটি একাধিক ধাপের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হবে, যেখানে ২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তির বিধান এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতির বাস্তবতা উভয়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে শেখ হাসিনার মতো একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যর্পণ সহজ কোনো বিষয় নয়। এটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত রাজনৈতিক ও সংবেদনশীল ইস্যু হয়ে উঠবে। এছাড়া, শেখ হাসিনার পক্ষ থেকেও নতুন কৌশল নেওয়া হতে পারে। তিনি ইন্ডিয়ার কাছ থেকে আশ্রয় চাওয়ার আবেদন করতে পারেন, যা প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তুলবে।
এদিকে, বাংলাদেশ সরকার প্রত্যর্পণের জন্য চাপ দিতে থাকলেও, ইন্ডিয়া সরকার এখন পর্যন্ত কোনো স্পষ্ট অবস্থান নেয়নি। ইন্ডিয়া যদি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়, তবে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি বড় কূটনৈতিক বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। আবার, প্রত্যর্পণের অনুরোধ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করাও নয়াদিল্লির জন্য সহজ সিদ্ধান্ত হবে না। তাই হাসিনাকে নিয়ে মোদি সরকার এখন বেকায়দায় রয়েছে। অনেকটা শ্যাম রাখি না কুল রাখি দশায়। তাই, এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া কৌশলগতভাবে নীরবতা বজায় রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আপাতত, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
চিকেন নেক নিয়ে সেনাপ্রধানের উদ্বেগ প্রকাশ
ইন্ডিয়ার সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে দেশটির দক্ষিণ এশিয়ায় সীমান্ত নিয়ে চরম অস্থিরতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ইন্ডিয়ার সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদীর তৎপরতা এবং বার্তার মাধ্যমে দেশটির সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে চীন ও পাকিস্তানের পর এবার বাংলাদেশ নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশে পাকিস্তানের উপস্থিতির দাবি করে সেনাপ্রধান উপেন্দ্র দ্বিবেদী প্রচ্ছন্নভাবে হুমকি দিয়েছেন, যা সীমান্ত নিয়ে ইন্ডিয়ার উদ্বেগকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে লাদাখ-কাশ্মীরের পর বাংলাদেশ সীমান্তের চিকেন নেক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইন্ডিয়া।
ইন্ডিয়ার সেনাপ্রধানের এই বক্তব্যের পর, বাংলাদেশের নাম না বললেও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রতি বার্তা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “প্রতিবেশী দেশ ব্যবহার করে ইন্ডিয়া বিরোধী পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা যেন বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।”
এর আগে, ইন্ডিয়ার গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছিল যে, পাকিস্তান সেনা ও গোয়েন্দা দল বাংলাদেশ সফর করেছে এবং সেভেন সিস্টারসের কাছে তাদের উপস্থিতি দেখা গেছে। ইন্ডিয়ার সেনাপ্রধানের এসব মন্তব্য, সীমান্ত নিরাপত্তা ও পাকিস্তান-চীন নিয়ে উদ্বেগের মধ্য দিয়ে দেশটির পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে।
ইন্ডিয়াকে টেক্কা দিতে চীন এর মারাত্মক চাল
বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনে অদ্ভুত শীতলতা। চীনা দূতাবাসে সাংবাদিকদের ভিড়। আলো ঝলমলে কনফারেন্স হলে ঢুকলেন রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। চোখে আত্মবিশ্বাস৷ টেবিলে রাখা নথি সরিয়ে বললেন, বাংলাদেশের জন্য চীনের দরজা। উন্মুক্ত আমরা সরাসরি অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিচ্ছি।
অর্থাৎ, বাংলাদেশে প্রতিযোগিতা করে অস্ত্র বিক্রি করতে চায় চীন। কারণ বাংলাদেশের জাতীয় অবস্থার সঙ্গে চীনের অস্ত্র উপযুক্ত। ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে তিস্তা প্রকল্পে সহায়তা দিতে প্রস্তুত চীন। এ ব্যাপারে চীনের প্রস্তাবের ব্যাপারে বাংলাদেশের সাড়া পাওয়ার অপেক্ষায় আছে তার দেশ। চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের পাঠ্যবই ও ওয়েবসাইটে আঞ্চলিক মানচিত্রে চীনের অবস্থান দেখানো নিয়েও আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশ মানচিত্র পরিবর্তন করবে।
খুনি ফ্যাসিবাদী পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাওয়ার পর ইন্ডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্ক ক্রমাগত সংকটের সম্মুখীন। সীমান্ত সংঘাত, কূটনীতিক দূরত্ব এবং বাণিজ্য সম্পর্কের টানাপোড়েন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকরা নতুন কৌশলগত অংশীদার করছেন এবং চীন দ্রুত সেই শূন্যস্থান পূরণের উদ্যোগ নিয়েছে। রাষ্ট্রদূত ইয়াও এর বক্তব্য স্পষ্ট, চীনের অস্ত্র উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন সাশ্রয়ী ও বৈশ্বিক মানসম্পন্ন। আমরা বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি কেবল অস্ত্র সরবরাহ নয়, বরং বৃহত্তর ভূ কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য ভারসাম্যের অভাব এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। এই প্রেক্ষাপটে চীনের অস্ত্র বিক্রির ঘোষণা একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ। এটি কেবল প্রতিরক্ষা সহযোগিতার প্রসার নয়, বরং বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোই চীনের দীর্ঘ মেয়াদি অবস্থান সুসংহত করার কৌশল। ইন্ডিয়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতের প্রধান অংশীদার ছিল। কিন্তু চীনের এই পদক্ষেপ দিল্লিতে তার নীতি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে।