পূর্ব লণ্ডন, ২৮ সেপ্টেম্বর: যুক্তরাষ্ট্রের নিউইর্য়ক থেকে পরিচালিত বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার এবং স্বাধীন গণমাধ্যম বিষয়ে সোচ্চার সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে) পর এবার প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিকদের হয়রানি বন্ধের আহ্বান জানালো ফ্রান্সের প্যারিস থেকে পরিচালিত সাংবাদিকদের অধিকার বিষয়ক আরেক আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের-‘আরএসএফ’)।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) তাদের ওয়েবসাইটে ”বাংলাদেশ সরকার প্রবাসী সাংবাদিকদের স্বজনদের জিম্মি করে ব্যবহার করছে” শিরোনামে প্রকাশিত বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘সরকারের সমালোচনাকারী দুই বাংলাদেশি প্রবাসী সাংবাদিকের ভাইকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই গ্রেফতারগুলি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার গুরুতর লঙ্ঘন।’
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) -এর এশিয়া প্যাসিফিক ডেস্ক বলেছে, বিরোধী সাংবাদিকতাকে নীরব করার চেষ্টায়, বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষ এমন ব্যক্তিদের কারাগারে বন্দী করেছে যাদের একমাত্র অপরাধ একজন সমালোচনামূলক সাংবাদিকের সাথে সম্পর্কিত। “যে সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে, তাদের এই ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য। আমরা অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে অবিলম্বে বিদেশে অবস্থানরত সাংবাদিকদের এ ধরনের হয়রানি বন্ধ করার আহ্বান জানাই।”
আরএসএফ জানায়, ১৩ সেপ্টেম্বর প্রায় ১৫ জন সাদা পোশাকের পুলিশ সদস্য দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা নোয়াখালীতে নুর আলম চৌধুরীর বাড়িতে গিয়ে পরোয়ানা না দেখিয়ে বা কেন তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে তা ব্যাখ্যা না করে তাকে তুলে নিয়ে যায়। যখন তাকে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় কেবল তখনই তিনি জানতে পারেন যে লন্ডন ভিত্তিক বাংলা ও ইংরেজি ভাষার পত্রিকা সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের ভাই হওয়ায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নুর আলম চৌধুরীকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ (১) ধারার অধীনে আটক করা হয়েছে, যে ধারার অধীনে কোনও ব্যক্তিকে অপরাধের “যৌক্তিক সন্দেহে” ওয়ারেন্ট ছাড়াই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারে। পুলিশ ব্যাখ্যা করেছে যে, চৌধুরীকে তার ভাইয়ের সাথে “সম্ভাব্য” সংযোগের বিষয়ে সন্দেহ করা হচ্ছে।
বলপূর্বক গুমের নিন্দা করার জন্য হয়রানি করা হচ্ছে জানিয়ে আরএসএফ বিবৃতিতে আরও জানায়, গত তিন দশক ধরে সাংবাদিকতায় জড়িত শামসুল আলম লিটন ২০০৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদের ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি ছিলেন। পরে যুক্তরাজ্যে এসে তিনি সাপ্তাহিক সুরমাতে যোগ দেন। পত্রিকাটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত। শামসুল আলম লিটন গত ১৯ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিদেশে অর্থ-পাচার সম্পর্কিত একটি সম্পাদকীয় লেখেন এবং পরের সপ্তাহে তিনি জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম দিবসে বাংলাদেশে বলপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্য লন্ডনের হাউস অফ কমন্সের বাইরে একটি বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করেন। এর পরপরই সাপ্তাহিক সুরমার ওয়েবসাইটটি সাইবার-আক্রমণের শিকার হয়। রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্স তদন্তকারীদের একটি প্রতিবেদন দেখেছে যেখানে শামসুল আলম লিটনকে “একজন উস্কানিদাতা এবং একটি সরকার বিরোধী সংগঠনের নেতা” হিসাবে বর্ণনা করেছে এবং দাবি করেছে যে চৌধুরী একজন “সহযোগি” ছিলেন যিনি বাংলাদেশে “অনেক জায়গায় সরকার বিরোধী প্রচার ছড়াতে তার ভাইকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করছিলেন।”
কয়েকদিনের ব্যবধানে একই রকম ঘটনা উল্লেখ করে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানায়, সাপ্তাহিক সুরমার অপর সাংবাদিক আবদুর রব ভুট্টোর ভাই আব্দুল মুক্তাদির মনুকে নুর আলম চৌধুরীর গ্রেফতারের মাত্র চার দিন আগে ৯ সেপ্টেম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। নুর আলম চৌধুরীর মতো তাকেও সিভিল পোশাকধারীরা ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ (১) ধারায় গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের ১২ দিন পর তিনি মুক্তি পান। সাপ্তাহিক সুরমার বিশেষ সংবাদদাতা আবদুর রব ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং গোয়েন্দা সংস্থার সমালোচনামূলক প্রতিবেদনের জন্য অভিযুক্ত করা হচ্ছে। গত আগস্ট মাসে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট-কর্নেল হাসিনুর রহমানের সাথে একটি ফেসবুক লাইভ ভিডিওতে হাজির হন, যেখানে লেফটেন্যান্ট-কর্নেল হাসিনুর রহমান ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেট-জেনারেল দ্বারা পরিচালিত বলপূর্বক গুমের ঘটনা প্রকাশ করেন।
রিপোর্টার্স স্যান্স ফ্রন্টিয়ার্সের (আরএসএফ) বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করে, শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচকদের হয়রানি করার জন্য বাংলাদেশে জোরপূর্বক আটক ও গুমের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ঢাকা-ভিত্তিক ফটো-সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ২০২০ সালে গুমের শিকার হয়ে ৫৩ দিন নিখোঁজ ছিলেন। আরএসএফ এই ঘটনাকে মর্মান্তিক বলে তখন গভীর নিন্দা জানিয়েছিলো। ২০২১ সালে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ভীতি প্রদর্শনের বৃদ্ধির কথা জানিয়ে আরএসএফ উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলো। যা বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি সাংবাদিকদের চাপ দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত ২০ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার প্রবাসী সাংবাদিকদের পরিবারকে হয়রানী বন্ধের আহবান জানিয়ে সাংবাদিক শামসুল আলম লিটনের বড় ভাই নূর আলম চৌধুরী পারভেজ ও সাংবাদিক আব্দুর রব ভুট্টোর ভাই আব্দুল মক্তাদির মনুর মুক্তি দাবী করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ কামনা করে বিবৃতি দেয় সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। আমেরিকার নিউইর্য়ক থেকে পরিচালিত বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকদের অধিকার এবং স্বাধীন গণমাধ্যম বিষয়ে সোচ্চার সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক এই সংস্থা ” বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সাংবাদিকদের ভাইবোনদের গ্রেফতার করেছে” শিরোনামে তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রদত্ত বিবৃতিতে সাংবাদিকদের স্বজনদের মুক্তির দাবী জানায়। কথিত সরকার বিরোধী প্রচারণার অভিযোগে গ্রেফতারকৃতদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তি এবং একইসঙ্গে বিদেশে বসে সাংবাদিকতা করাদের পরিবারের সদস্যদের আটক, হেনস্থা কিংবা যে কোনো ধরণের প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকারও আহবান জানায়।
এতে বলা হয়, গত ১৩ সেপ্টেম্বর নোয়াখালী শহর থেকে বাংলাদেশ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা নুর আলমকে গ্রেপ্তার করে। তিনি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাপ্তাহিক সংবাদপত্র “সুরমা”র সম্পাদক শামসুল আলম লিটনের বড় ভাই। এছাড়া তিনি রাজনৈতিক ইস্যুভিত্তিক টক-শো “টেবিল টক উইথ হাসিনা আখতার” এবং ডিজিটাল নিউজ প্লাটফরম “সোজাকথা” এর সম্পাদক শাহ আলম ফারুকের ভাই। গত ১৪ আগস্ট শাসমুল আলম লিটন সাপ্তাহিক সুরমার সম্পাদকীয়তে মানি লণ্ডারিংয়ে অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহী করার জন্য বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আহবান জানিয়েছিলেন। আর এসব করণেই পুলিশের অভিযোগ যে, ব্রিটেনে বসে লিটন সোশ্যাল মিডিয়াতে সরকারের বিরুদ্ধে প্রোপ্যাগাণ্ডা ছড়াচ্ছেন এবং তাঁর সঙ্গে মিলে পারভেজও দেশের নাগরিকদের মধ্যে ‘বিভ্রান্তি ও উৎকণ্ঠা’ সৃষ্টি করছেন। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার শহর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আব্দুল মুক্তাদির মনুকে। তিনিও সুরমার বিশেষ প্রতিনিধি এবং লণ্ডন বাংলা চ্যানেলের প্রধান আব্দুর রব ভুট্টোর ভাই। সিপিজে’র এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর বেহ লিহ ই জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার যেভাবে সমালোচনাকারী সাংবাদিকদের পরিবারকে টার্গেট করছে তা প্রতিশোধ গ্রহণের একটি জঘন্য রূপ। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের কূটনৈতিক অংশীদার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবশ্যই এদিকে নজর দেয়া উচিত। সিপিজে’র এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে এবং শর্তহীনভাবে নুর আলম চৌধুরী পারভেজ এবং আব্দুল মুক্তাদির মনুকে ছেড়ে দিতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশে বসে সাংবাদিকতা করাদের পরিবারের সদস্যদের আটক, হেনস্থা কিংবা যে কোনো ধরণের প্রতিশোধ গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে।
কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট -এর বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেছেন তার কিছু দিন আগেই এই গ্রেপ্তারের ঘটনাগুলো ঘটেছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশ, আওয়ামী লীগ এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ই-মেইল পাঠিয়েছে সিপিজে। তবে এসব ই-মেইলের কোনো রিপ্লাই আসেনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা সংগঠনটি জানিয়েছে, এর আগেও বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রে থাকা সাংবাদিক কনক সরওয়ারের বোন নুসরাত শাহরিন রাকাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তিনি ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আটক ছিলেন।
এছাড়া সুইডেনভিত্তিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘নেত্র নিউজ’ এর প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিলের মাকে দেশে বারবার হয়রানির বিষয়টিও উল্লেখ করা হয় সিজেপি’র বিবৃতিতে।