ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) গুলিতে নিহত ছয় বাংলাদেশির লাশ ফেরত পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছেন তাদের আত্মীয়স্বজন। প্রিয়জনকে নিজের হাতে সমাহিত করতে চান নিহতের বাবা-মা ও সন্তানরা, চান কবরে শায়িত করার আগে প্রিয়জনের মুখ দেখতে। কিন্তু মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও লাশ মিলছে না।
এর আগে সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ আনা সম্ভব হয়েছে। সম্প্রতি এর ভিন্নতা দেখা যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন পর্যবেক্ষকরা।
প্রসঙ্গত, সীমান্তবর্তী লালমনিরহাট জেলায় এ পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে নিহত ৬ বাংলাদেশির লাশ ভারতের হিমঘরে পড়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন পাটগ্রাম, দুইজন কালীগঞ্জ ও একজন আদিতমারী সীমান্তে নিহত হয়েছেন।
পরিবারের সদস্যরা প্রতিদিনই সীমান্তবর্তী বিজিবি ক্যাম্পের পাশে ঘোরাফেরা করছেন লাশের খবরের সন্ধানে। স্বজনরা লাশ ফেরত চেয়ে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এখনও দেখা যায়নি আশার আলো।
রিফাত হোসেন: পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও গুলিতে নিহত রিফাত হোসেনের (৩২) লাশ এখনও ফেরত পায়নি তার পরিবার। গত ২৯ জুন পাটগ্রাম উপজেলার জগতবেড় ইউনিয়নের পূর্ব জগতবেড় সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন রিফাত হোসেন। এর পর থেকেই রিফাতের বাবা ইসমাইল হোসেন লাশ ফেরত চেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ বিজিবি কর্মকর্তাদের কাছে ঘুরছেন। একপর্যায়ে স্থানীয় পাটগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সহায়তা চেয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছেন।
ইসমাইল হোসেন বলেন, ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে গুলিবিদ্ধ নিহত ব্যক্তিই আমার ছেলে। কিন্তু এখনও ছেলের লাশ ফেরত পাইনি। কোথায় গেলে পাব, তার কূলকিনারাও করতে পারছি না।
সুবল চন্দ্র: গত ১৪ জুলাই আদিতমারীর লোহাকুচি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন সুবল চন্দ্র বর্মণ ওরফে সাদ্দাম (৩২)। তিনি আদিতমারী উপজেলার ভেলাবড়ি ইউনিয়নের ফলিমারী গ্রামের পেলকো বর্মণের ছেলে। বাবা পেলকো বর্মণ জানান, সাদ্দামের পাঁচ বছরের শিশুকন্যা তার বাবাকে খুঁজছে। প্রতিদিনই কান্নাকাটি করছে। কিন্তু লাশ ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না।
সাগর ও ইউনুস: গত ২৯ আগস্ট পাটগ্রামের বুড়িমারী বান্ধেরমাথা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন বুড়িমারী ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের বুলবুল হোসেনের ছেলে ইউনুছ আলী (২৭) ও নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ধনবর রায়ের ছেলে সাগর চন্দ্র (৩২)। কিন্তু তাদের লাশ হস্তান্তর করা হয়নি।
নিহত ইউনুস আলীর মা রাবেয়া বেগম বলেন, ‘বাহে, হামার ওই পচা ছাওয়ার (ছেলে) লাশ ফেরত চায়। এক নজর দেখি, নাতিপুতিক নিয়ে সবাই মিলে ওকে দাফন করমো। কবরে মাটি দিব। মা হিসেবে এটাই হামার শান্তি। সবাইগুলা মিলি হামার ছাওয়ার লাশটা আনি দেও।’
ইদ্রিস ও ভাসানী: সর্বশেষ গত ১২ নভেম্বর কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের বলায়ের হাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন ইদ্রিস আলী (৫৫) ও আসাদুজ্জামান ভাসানী (৫০)। নিহত ইদ্রিস আলী উপজেলার গোড়ল ইউনিয়নের মালগাড়া গোড়ল গ্রামের মোসলেম উদ্দিনের ছেলে ও আসাদুজ্জামান ভাসানী ওই গ্রামের মৃত আলতাফ হোসেনের ছেলে। ঘটনার ১১ দিনের মাথায়ও তাদের লাশ ফেরতের বিষয়ে কোনো আশার কথা শোনেননি পরিবারের লোকজন।
ভাইয়ের লাশ ফেরত চেয়ে একরামুল জানান, দেশের মাটিতে ভাইয়ের লাশ সমাহিত করতে চান তারা। একরামুল বলেন, কী অন্যায় করেছিল তারা যে পাখির মতো গুলি করে মারতে হবে তাদের?
‘বিজিবিকে ভূমিকা রাখতে হবে’: নিহতদের স্বজনরা জানান, লাশ ফেরত পাওয়ার বিষয়ে বিজিবিকে ভূমিকা রাখতে হবে। স্থানীয় সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে, নিহত সবাই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তায় গরু আনতে ভারতে প্রবেশ করেন। পরে ফেরার পথে বিএসএফের গুলিতে মারা পড়েন তারা। পরে তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ভারতীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে বিএসএফ।
এসব ব্যাপারে লালমনিরহাট-১৫ বিজিবি ও রংপুর-৬১ বিজিবির কাছে তথ্য জানতে ফোন ও এসএমএস দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউপি চেয়ারম্যান আবু নেওয়াজ নিশাত বলেন, নিহতদের পরিবারসহ আমরা সবাই এসব লাশ ফেরত চাই। দেশের মাটিতে তাদের কবর দেবে পরিবার।
কালীগঞ্জ উপজেলার গোড়ল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল ইসলাম জানান, তাদের লাশ এখনও ফেরত পায়নি পরিবার। এর বাইরে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি।
বিএনপির মানববন্ধন: সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর নিহতদের লাশ ফেরতের দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি করেছে লালমনিরহাট জেলা বিএনপি। সীমান্তে হত্যা ও লাশ ফেরতের দাবি করে মানববন্ধনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন মাহমুদ টুকু বলেন, দুর্বল পররাষ্ট্র নীতির কারণে সীমান্তে একের পর এক এমন হত্যাকাণ্ড ঘটছে। সরকার লাশ ফেরত আনতে পারছে না।