- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত
বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: সীমান্তের কাটাতারে ফেলানীর গুলিবিদ্ধ লাশ ঝুলে থাকার ছবি বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও সীমান্তে বিএসএফের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ-ভারতের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও তা কাজে আসছে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরাও।
ঢাকায় গত ৫-৯ মার্চ বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের সীমান্ত সম্মেলন শেষে বিএসএফয়ের ডিজি নিতিন আগারওয়াল বলেছিলেন, সীমান্তে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করা হয় না। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অথচ ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ ডিজি পর্যায়ের ৫৪তম সীমান্ত সম্মেলনের সাত দিনের মধ্যে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশী কিশোর সাদ্দাম হোসেন (১৫)কে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্তে এবার বিএসএফ গুলি করে হত্যা করেছে বাংলাদেশী যুবক হাসান মিয়া (২৬)কে।
সোমবার (২২ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার বায়েক ইউনিয়নের পুটিয়া সীমান্ত এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। নিহত হাসান মিয়া ওই এলাকার দারু মিয়ার ছেলে। নিহতের স্বজনরা জানান, সকালে হাসান বন্ধুদের নিয়ে পুটিয়া সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ঘুরতে যান। এ সময় তাদের দেখে বিএসএফ গুলি চালালে হাসান গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত হাসানের চাচাতো ভাই আরিফ জানান, হাসান বিভিন্ন সময় সীমান্তের ওই পার থেকে চিনি পরিবহনের শ্রমিকের কাজ করত। সোমবার সকালে সীমান্ত থেকে চিনি আনতে গেলে বিএসএফ গুলি চালায়।
এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে নিহতের স্বজনরা হাসপাতাল চত্বরে ভিড় করেন। এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের আহাজারিতে এক শোর্কাত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তারা সীমান্তে হত্যা বন্ধসহ হাসান হত্যাকাণ্ডের বিচার চান।
শোকে কাতর নিহত হাসান মিয়ার স্ত্রী মর্জিনা খাতুন বিলাপ করতে করতে বলেন,‘যে হাতে আমার স্বামীকে গুলি করেছে, সে হাত যেন পচে যায়’ : ‘আমার তিন মাসের শিশুকে এতিম করে আমার স্বামী মারা গেল। এখন আমরা কিভাবে বাঁচব। যে হাতে আমার স্বামীকে গুলি করেছে, সে হাত যেন পচে যায়। আল্লাহ্ যেন তাদের বিচার করে।’
নিহত হাসানের বাবা জারু মিয়া বলেন, আমার ছেলে সীমান্ত এলাকায় ঘুরতে গিয়েছিল। পরে খবর পাই বিএসএফ তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। কেন তারা আমার বুককে খালি করল। আর যেন কোনো মায়ের বুক খালি না হয় সরকারের কাছে দাবি জানাই।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ৬০ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জাবের বিন জব্বার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, বিএসএফের গুলিতে একটি ছেলে মারা গেছে। বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত পরে জানানো হবে। ময়নাতদন্তের জন্য জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হবে। বিষয়টি ভারতীয় বিএসএফকে অবহিত করে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হবে।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে কাজ করা মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ৯ বছরে সীমান্তে বিএসএফের হাতে ২৪৫ জন বাংলাদেশি হত্যার ঘটনা ঘটলেও একটি হত্যাকাণ্ডেরও বিচারকাজ সম্পন্ন হয়নি।
এই বিচারহীনতা আর সরকারের নতজানু নীতিই সীমান্ত হত্যাকে উস্কে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মানবাধিকারকর্মী ও পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, সীমান্তে নাগরিকদের মৃত্যুতে সরকারের পক্ষ থেকে যতটা জোরালো প্রতিবাদ জানানোর রেওয়াজ ছিল, এখন সেটা ততটা জোরালো নয়। হত্যাকাণ্ড বন্ধে বিজিবির পক্ষ থেকেও জোরালো কোনো উদ্যোগ বা মেসেজ দেয়া হয় না। এর আগে বিএসএফ’র গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বিজিবি সদস্য রইস উদ্দিন। দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সীমান্ত-হত্যা নির্যাতন ইস্যুটির সমাধান হচ্ছে না। তাই আমরা মনে করি, বিষয়টি জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক দরবারে আনতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এর সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশের যেসব নাগরিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হন, তাদের কেউ সশস্ত্র ছিল এমন আলামত দেখাতে পারবে না। প্রতিনিয়ত আমাদের সীমান্তে বিএসএফ যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে, পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে যুদ্ধাবস্থা থাকার পরও কিন্তু সেখানে এমন ঘটনা ঘটে না। কোনো মানুষকে হত্যা বা গুলি করে হত্যা চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সীমান্তে কোনো মানুষ মানুষকে এভাবে মারতে পারে না। প্রতিবারই আমরা আশার বাণি শুনি, পরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এই হত্যাকাণ্ড বন্ধে দুই দেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তৎপর হতে হবে। সীমান্তে হত্যা বন্ধে সংশ্লিষ্ট এই দপ্তরগুলোতে তৎপরতায় ঘাটতি রয়েছে। দুই দেশেই আইন আছে, তবুও সীমান্তে আইন লঙ্ঘন করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের আন্তর্জাতিক স্থল সীমান্ত রয়েছে, যা বিশ্বে পঞ্চম বৃহত্তম।