রেলওয়েতে করোনায় সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে বেশুমার চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির ফাইল গায়েব। রিপোর্টের সারসংক্ষেপ আছে। কিন্তু যেসব তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রিপোর্ট তৈরি হয়েছে সেই ১৬৭৭ পৃষ্ঠার নথি কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে তদন্তে অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তাকে গোপনে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই ফাইল গায়েব এবং অভিযুক্তদের অব্যাহতি দেওয়াকে কেন্দ্র করে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে বিভাগে তোলপাড় চলছে। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি গঠন করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন খোদ রেলপথমন্ত্রী এবং রেলপথ সচিব।
সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত রিপোর্টের ১৬৭৭ পৃষ্ঠার নথি, ২১ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত ফাইল, তাদের এনআইডি ও পাসপোর্টের সত্যায়িত ছায়ালিপি চেয়েছে। কমিশন এই ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে জানিয়েছে। ফাইল গায়েবের বিষয়েও আলাদা মামলা হতে পারেও বলে দুদক জানিয়েছে।
পুরো বিষয়টিকে দুর্নীতির সহায়ক বলে দেখছে টিআইবি। তাদের মতে তদন্ত কমিটির সুপারিশ উপেক্ষা করে গোপনে ২১ কর্তকর্তাকে দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বদলি করে দেওয়া হয়েছে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ককে। এসব দুর্নীতির অংশ।
মঙ্গলবার বিকালে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘আমি কোনো অনিয়ম সহ্য করি না। করোনা সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রিপোর্টও পেয়েছি। মন্ত্রণালয় অভিযুক্তদের ‘সতর্ক’ করে অব্যাহত দিয়েছে। এখন এসবের নথিপত্র গায়েব হতে পারে না। এটা কিছুতেই মেনে নেব না। আমি বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছি। সংযুক্তি কিংবা নথি গায়েব হলে সংশ্লিষ্ট কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
এ বিষয়ে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা মঙ্গলবার দুপুরে বলেন, ‘তদন্ত রিপোর্ট-সংযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গায়েব কিংবা হারিয়ে যাবার কথা নয়। আমরা বিষয়টা দেখছি। প্রয়োজনে পুনরায় সংশ্লিষ্টদের ডেকে এসব সংগ্রহ করা হবে। আর যদি সত্যি সত্যিই গায়েব হয়ে থাকে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘দুদক যে অবস্থান নিয়েছে তার জন্য আমরা সাধুবাদ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা চাই, দুদকের এ অবস্থান যেন অনড় থাকে। যারা দুর্নীতি করেছে, তদন্তে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, তাদের যেন ছাড় দেওয়া না হয়। কমিটির তদন্তে অভিযুক্তদের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে এসেছে । ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত না করে তাদের সহায়তা করা হয়েছে। সহায়তাকারীদেরও জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। যেহেতু কমিটির সুপারিশ আছে সে ক্ষেত্রে দুদকের তদন্ত করতে সুবিধা হবে। দুদক নিশ্চয় ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করবে। শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে রেলে দুর্নীতি কমবে না।
গত বছর করোনা সুরক্ষাসামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির জন্য পূর্বাঞ্চল রেলের ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে রেলওয়ের তদন্ত কমিটি। তদন্তে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) মো. মঞ্জুর-উল-আলম চৌধুরী, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে মহাব্যবস্থাপক সরদার সাহাদাত আলী, রেলওয়ে পাহাড়তলী সিসিএস রুহুল কাদের আজাদ, অতিরিক্ত সিসিএস মো. আনোয়ারুল ইসলাম, মো. মনিরুজ্জামান, সাহেব উদ্দিন, মজিবুল হক, খায়রুল করিম, মো. এমদাদুর রহমান, মো. জাহিদ হাসান, মো. মারুফ, ফারজানা উম্মে খানম, গৌতম কুমার কুন্ড, সুকেন্দ্রনাথ হালদার, মহিউদ্দিন আহমেদ, কাজী নাজিম উদ্দিন, ফাতেমা আক্তার, মো. রাহিদ হোসেন ও ফরিদ আহমেদকে অভিযুক্ত করা হয়।
এসব কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকার সুরক্ষাসামগ্রী কেনার সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দিয়ে পণ্যগুলো কিনেছেন বলে তদন্ত রিপোর্টে উঠে আসে। ক্রয় প্রক্রিয়ায় অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে গত বছরের ২৫ আগস্ট রেলওয়ের যুগ্ম সচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কমিটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে ৪ অক্টোবর, পরে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। সর্বশেষ গত বছরের ৫ নভেম্বর রেলপথ সচিব মো. সেলিম রেজার কাছে কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়।
এদিকে চলতি বছরের মার্চ ও এপ্রিল মাসে অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে অব্যাহত দেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে মন্ত্রণালয় ও রেলপথ বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, তদন্তে দোষী প্রমাণিত ২১ কর্মকর্তা সমন্বয়ে রেলে একটি ‘চক্র’ গড়ে উঠেছে। চক্রটি শক্তিশালী হওয়ায় বিভিন্ন কৌশলে পার পেয়ে যায়। অপরদিকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক রেলওয়ের যুগ্মসচিব ফয়জুর রহমান ফারুকীকে রিপোর্ট জমা দেওয়ার কয়েক মাস পর রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বদলি করে দেওয়া হয়।
মঙ্গলবার ফারুকী জানান, তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন তিনি। দীর্ঘ তিন মাস তদন্ত শেষে গত বছরের ৫ নভেম্বর রিপোর্ট জমা দেন। ২৬ পাতার রিপোর্ট এবং ১৬৭৭ পৃষ্ঠা সংযুক্ত তথ্য-উপাত্তসহ ফাইলটি তৎকালীন উপ-সচিব আব্দুর রহিমের কাছে জমা হয়। উপ-সচিব আব্দুর রহিম মঙ্গলবার জানান, তিনি ৫ নভেম্বর তদন্ত রিপোর্টসহ ১৬৭৭ পৃষ্ঠা সংযুক্ত ফাইলটি রেলপথ সচিবের কাছে হস্তান্তর করেন। তিনি আরও জানান, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে রেলপথ মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়েছেন।
তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করা এবং অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তার তথ্য এখনও পায়নি দুদক। তদন্ত রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট ১৬৭৭ পৃষ্ঠার নথিও পৌঁছায়নি সংস্থাটিতে। চলতি মাসের ১৬ তারিখ ১৭৫৮৫ নং স্মারকে এসব তথ্য-উপাত্ত এবং ১৬৭৭ পৃষ্ঠার সংযুক্তি চেয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি দেয় দুদক। এর পরিপ্রেক্ষিতে রেলপথ মন্ত্রণালয় ২৪ আগস্ট সংশ্লিষ্ট নথি এবং ২১ কর্মকর্তার তথ্য-উপাত্ত চেয়ে রেলওয়ে মহাপরিচালক বরাবর চিঠি দেয়। দুই কার্যদিবসের মধ্যে তথ্যগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো তথ্য তারা পাঠায়নি।
মঙ্গলবার রেলওয়ে মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, আমরা দুদক থেকে ১৬ আগস্ট চিঠি পেয়েছি। তবে এখনো উত্তর দিতে পারিনি। তদন্ত রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট সংযুক্তি নথি পাওয়া যাচ্ছে না আমি দেখছি, নিশ্চয় পাব। আর যদি না পাওয়া যায়, তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা তো করতেই হবে।
এ বিষয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. ভুবন চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘সংযুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। না পাওয়া গেলে যাদের কাছে থাকার কথা তারা রক্ষা পাবে না। তদন্ত রিপোর্টটি আমরা দুদকে জমা দিয়েছি, দুদক যা যা চাচ্ছে আমরা তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
এ বিষয়ে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশিদ চৌধুরী বলেন, করোনাকালে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে সুরক্ষা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়ে আমরা বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ দেখেছি। রেলপথ মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তদন্তে অভিযুক্ত ২১ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগসহ যথাযথ শাস্তির সুপারিশও করা হয়েছে। ২১ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের ব্যক্তিগত নথি-জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টের ফটোকপিসহ তদন্ত রিপোর্টের সংযুক্তি চেয়ে চিঠি দিয়েছি। চিঠির উত্তরসহ এসব তথ্য-উপাত্ত এখনো (মঙ্গলবার) পর্যন্ত পাইনি। যদি সংযুক্তি গায়েব হয় তাহলে সেটি আরও ভয়াবহ দুর্নীতি। আমরা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে দ্রুতই মামলা করব।