।। পিনাকী ভট্টাচার্য।।
১২ মার্চ ১৯৭২ ঢাকা স্টেডিয়ামে ভারতীয় বাহিনীর বিদায়ী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৫ মার্চের মধ্যে তাদের প্রত্যাগমন সম্পন্ন হয়। বিদায়ী শুভেচ্ছাবাণীতে শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশে বলেন: আমাদের মহাসংকটের সময়ে আপনাদের প্রসারিত সাহায্যকে আমরা সর্বদা গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবো। …ইচ্ছা থাকলেও বাংলাদেশের জনগণ তাদের আতিথেয়তার হস্ত আপনাদের দিকে প্রসারিত করতে পারেনি। কারণ, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের কারণে তাদের (বাঙালিদের) আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিন্তু আপনাদের প্রতি তাদের রয়েছে অকৃত্রিম ভালোবাসা। আমার অনুরোধ, আপনারা বাংলাদেশের জনগণের ভালোবাসা সঙ্গে করে নিয়ে যান।
কিন্তু দুঃখজনক যে, ভারতীয় বাহিনী ফিরে যাওয়ার সময় শেখ মুজিবের ‘ভালোবাসার’ সঙ্গে লুটপাটকরা বিপুল সম্পদও সাথে করে নিয়ে যায়। কিছু ভারতীয় অফিসার ও তাদের অধীনস্ত সেনারা যশোর, কুমিল্লা, ঢাকা ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে এবং খুলনার শিল্পাঞ্চলে লুটপাট শুরু করে। সেই সময় ভারতীয় বাহিনী সদ্যস্বাধীন দেশে যে সর্বব্যাপী এবং নজিরবিহীন লুটপাট চালায় তা বিদেশিদেরকেও হতবাক করেছিল। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’-এর রিপোর্টে বলা হয়: মিল-ফ্যাক্টরির মেশিনারি ও যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুটপাট করে ভারতীয় সেনারা। পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াও খাদ্যশস্য এবং পাট, সুতা, যানবাহন; এমনকি সমুদ্রগামী জাহাজ, কারখানার মেশিনপত্র ও যন্ত্রাংশ পর্যন্ত লুট করে। এই লুণ্ঠিত সম্পদের আর্থিক মূল্যের পরিমাণ ছিল সব মিলিয়ে সেই সময়ের হিসাবে ২.২ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানের অন্তত চারটি ডিভিশনের অস্ত্রশস্ত্র, ভারী কামান, গোলাবারুদ, যানবাহন ও অন্যান্য সরঞ্জাম ভারতে নিয়ে যায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রতিবাদ করলে টোকেন হিসেবে অল্প কিছু পুরনো অস্ত্র ফেরত দেয়া হয়।
এই ভারতীয় বাহিনী এতই নির্লজ্জ ছিল যে, এত কিছু নিয়ে যাবার পরেও ব্রিগেডিয়ার র্যাঙ্কের অফিসার ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফ্রিজ, আসবাবপত্র, ক্রোকারিজ ট্রাকে ভর্তি করে ভারতে পাচার করেন। ব্রিগেডিয়ার মিশ্র নামে একজন ভারতীয় অফিসারের এই লুটের অপরাধে কোর্ট মার্শালও হয়। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘পূর্ব-পশ্চিম’ উপন্যাসে এই লুটপাট নিয়ে লিখলেন-
‘ঢাকায় এতসব বিদেশি জিনিস পাওয়া যায়! এসব তো আগে দেখেনি ভারতীয়রা। রেফ্রিজারেটর, টিভি, টু-ইন-ওয়ান, কার্পেট, টিনের খাবার- এসব ভর্তি হতে লাগলো ভারতীয় সৈন্যদের ট্রাকে।’
পাকিস্তানি বাহিনীর কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক যান, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ অনেক মূল্যবান জিনিস এমনকি প্রাইভেট কার পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই লুণ্ঠন এমন বেপরোয়া আর নির্লজ্জ ছিল যে বাথরুমের আয়না এবং ফিটিংস্ও সেই লুণ্ঠন থেকে রেহাই পায়নি। নবম সেক্টরের অধিনায়ক মেজর জলিল তখন খুলনায়, তিনি যতগুলো প্রাইভেট কার পেলেন তা রিক্যুইজিশন করে সার্কিট হাউসে মুক্তিযোদ্ধাদের তত্ত্বাবধানে রেখে কিছু সম্পদ রক্ষার চেষ্টা করেন।
ভারতীয় বাহিনীর লুটপাটের বিরুদ্ধে এই বীর সেক্টর কমান্ডার জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। ফলও পেলেন দ্রুত। ২৮ ডিসেম্বর তিনি যশোর থেকে অন্তর্হিত হন। মেজর জলিল পরে জানান, ৩১ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর হাতে তিনি গুম হন। যশোর সেনানিবাসের অফিসার্স কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়িতে তাকে আটক রাখা হয়। বাড়িটি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি নির্যাতন সেল। বাড়িটি অন্ধকার, রুমে মানুষের রক্তের দাগ ও এলোমেলো ছেঁড়া চুল, কিছু নরকঙ্কাল, সঙ্গে শকুন আর শেয়ালের উপস্থিতির মধ্যে একটা খাটে ডিসেম্বরের শীতের রাতে আধা ছেঁড়া কম্বল গায়ে দিয়ে দেশের প্রথম রাজবন্দি এক বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল শুনতে পেলেন পাশেই ভারতীয় সেনাদের বর্ষবরণের উল্লাস, নর্তকীর ঘুঙুরের শব্দ আর সেইসঙ্গে নারী-পুরুষের হল্লা। মেজর জলিলের এই গুম হবার সংবাদ আড়াই মাস পরে সরকার স্বীকার করে। এটাই ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম মিডিয়া সেন্সরশিপ। মেজর জলিলকে যেভাবে ইন্ডিয়ান আর্মি গুম করে সেটাই পরবর্তীতে রক্ষী বাহিনী অনুসরণ করে। এবং বর্তমানে হাসিনা প্রশাসন একই প্রক্রিয়া রপ্ত করে অসংখ্য বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করে চলেছে। ১৯৭২ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লি সফরকালে বাংলাদেশি প্রতিরক্ষা প্রতিনিধিদল অস্ত্র ফেরতদানের প্রশ্নটি উত্থাপন করে প্রত্যুত্তরে এক নির্লিপ্ত সাড়া পান। পরবর্তীকালে জাতীয় সংসদে একজন আওয়ামী লীগ সদস্যের প্রশ্নের জবাবে তৎকালীন তথ্য ও বেতার প্রতিমন্ত্রী বলেন যে, ‘ভারত ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে দখলিকৃত পাকিস্তানি অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের এক বিরাট অংশ ফেরত দিয়েছে এবং এই ফেরতদানের প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।’ অবশ্য মন্ত্রী ‘জাতির স্বার্থে’ ফেরত প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্রের সংখ্যা বা পরিমাণ উল্লেখ করতে অস্বীকৃতি জানান। সেই অস্ত্রের পরিমাণ জাতি কখনো জানতে পারেনি। এমনকি বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীও জানেনা সেই ফেরত দেয়া অস্ত্রের পরিমাণ কত ছিলো। কোন এক অজানা কারণে পরবর্তীতে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীও অস্ত্র ফেরত দেয়ার বিষয়ে রহস্যজনক নীরবতা পালন করে।