- ১০০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ।
- মাথাপিছু গড় ঋণ ৫৯২ ডলার।
- গত ১৪ বছরেই বেড়েছে ৩২২ শতাংশ ঋণ।
- দলীয় লোকদের লুটপাটের সুযোগ করে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা।
লণ্ডন, ২৬ মার্চ: আজ থেকে ৫৩ বৎসর পূর্বে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ, গত ২৬শে মার্চ স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পর্দাপণ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রথমবারের মতো ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে।
গত ডিসেম্বরের শেষে সরকার ও বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণে স্থিতি ছিল ১০০ দশমিক ৬৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। যা দেশীয় মুদ্রায় ১১ ট্রিলিয়ন বা ১১ লাখ ৭ হাজার ৪০ কোটি টাকার সমান (প্রতি ডলার=১১০ টাকা ধরে)। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫২ কোটি ডলার। সেই হিসেবে এক বছরের ব্যবধানে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৪১২ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমনই তথ্যই উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৬৫৫ কোটি ডলার। তার মানে পরের তিন মাসে ৪ বিলিয়ন বা ৪০৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ বেড়েছে। এই সময়ে সরকার ৪৪২ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ নিয়েছে। তার বিপরীতে বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে ৬৪ কোটি ডলারের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৪ হাজার ১১৭ কোটি ডলার। আর গত ২০২২–২৩ অর্থবছর শেষে তা ৯ হাজার ৮১১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। অর্থাৎ গত আট বছরে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। গত ডিসেম্বর শেষে সেটি আরও বেড়েছে। জনশুমারি ও গৃহগণনা শুমারির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। সেই হিসাবে গত ডিসেম্বরের শেষে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৯২ ডলার (প্রায় ৬৫ হাজার টাকা)। যদিও গত জুনের হিসাবে মাথাপিছু বিদেশি ঋণ ছিল ৫৭৪ ডলার। আট বছর আগে এটা ছিল ২৫৭ ডলারের কিছু বেশি। মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে সরকারি খাতে ৭৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ২১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৯৬৯ কোটি ডলার। তার আগের তিন মাসে বিদেশি ঋণের স্থিতি ছিল ৭ হাজার ৫২৭ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত বছরের শেষ তিন মাসে সরকারি খাতে বিদেশি ঋণের স্থিতি বেড়েছে ৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ। অন্যদিকে গত ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতের ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২ হাজার ৯৫ কোটি ডলার। যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ২ হাজার ১২৮ কোটি ডলার।
সরকার বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) মতো সংস্থা এবং জাপান, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশি ঋণ নেয়। এই সব ঋণ নেওয়া হয় মূলত প্রকল্প বাস্তবায়ন ও বাজেট সহায়তা হিসেবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) গত ডিসেম্বরের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঋণদানে শীর্ষ দেশ ও সংস্থার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাংক, জাপান, এডিবি ও চীন। সাম্প্রতিককালে চীনা ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বিদেশি অর্থায়নে বেশ কিছু বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প, মেট্রোরেল (লাইন-৬), হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেলপথ ইত্যাদি।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ২০২৩ সালের জুনের শেষে ৯৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছিল, যা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শুরুতে ২০০৯ সালের জুন মাসে ছিল ২৩.৫ বিলিয়ন ডলার। গত ১৪ বছরে ৭৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩২২ শতাংশ বিদেশি ঋণ বাড়ার পেছনে উন্নয়নমূলক প্রকল্পের জন্য বিদেশী ঋণের উপর শেখ হাসিনা সরকারের ক্রমবর্ধমান নির্ভরতাকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন রাজস্ব আয়, রপ্তানি এবং রেমিট্যান্স না বাড়াতে পারলে এবং একই সাথে বিদেশি ঋণের প্রবাহ কমিয়ে না আনতে পারলে এ ঋণই বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে আগামী কয়েক বছরে। বিশেষ করে ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি এমনিতেই চাপের মধ্যে রয়েছে এবং এর মধ্যেই চলতি বছর থেকেই বড় বড় কিছু প্রকল্পের ঋণের কিস্তি শোধ করাও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি রপ্তানি ও রেমিট্যান্সও কাঙ্ক্ষিত আকারে বাড়ানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডলারের সরবরাহ না বাড়ানো গেলে বিদেশি ঋণকে ঘিরে সংকট জোরালো হওয়ার আশংকা তৈরি হতে পারে বলছেন বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে যখন মেগা প্রকল্পগুলোর মূল অর্থ পরিশোধ শুরু হবে তখন পরিস্থিতি কেমন হয় তা নিয়েই উদ্বিগ্ন অনেকে।
শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হয়েই দলীয় লোকদের নিয়োগ দিয়ে প্রশাসন সাজিয়েছেন। প্রশাসনের লোকজনই অবৈধ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে বারবার ক্ষমতায় বসিয়েছেন। এখন পর্যন্ত প্রশাসনের লোকজনই তাঁকে ক্ষমতায় রেখেছেন। শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তারা সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। আর বিনিময়ে শেখ হাসিনা প্রশাসন নামের আওয়ামী কর্মকর্তাদেরকে অনৈতিকভাবে অবাধ সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, আনসার,সচিবসহ প্রশাসনের সব স্তরের লোকজন যখন যা চাইছেন শেখ হাসিনা তাই দিচ্ছেন। গত ৭ জানুয়ারির প্রহসনের নির্বাচনে প্রশাসন তথা দলীয় কর্মীরা তাঁর কথামতো কাজ করায় শেখ হাসিনা তাদেরকে বড় ধরণের উপহার দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর সেটা হল প্রশাসনের লোকজনের আয় আর প্রদর্শন করতে হবে না। তাদের সম্পদের বিবরণী আর জমা দিতে হবে না। অবৈধভাবে তারা যে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন, সেটার আর জবাবদিহী করতে হবে না।
জানা গেছে, সরকারি কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার বিধান বাদ দিয়ে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সংশোধনী প্রস্তাব অনুযায়ী, ‘যদি প্রয়োজন হয়’, তাহলে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব সরাসরি তাঁর কাছ থেকে না নিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়া যাবে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের হিসাব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে দেওয়া বার্ষিক আয়কর রিটার্ন থেকে নেওয়ার যে যুক্তি, আয়কর আইন, ২০২৩ অনুযায়ী তা সম্ভব নয়। আইনের ৩০৯(২) ও ৩০৯(৩) ধারা অনুযায়ী, কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো সরকারি কর্মচারীকে এই আইনের অধীন কোনো ট্যাক্স রিটার্ন, অ্যাকাউন্ট বা নথি উপস্থাপন, সাক্ষ্য বা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপনের আদেশ দিতে পারে না। অর্থাৎ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) দুর্নীতি বা বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ আহরণের অভিযোগে কোনো ব্যক্তির আয়কর বিবরণী আদালতের নির্দেশ ছাড়া দেখতে পারবে না। এছাড়া, ২০০৩ সালে গৃহীত জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী সনদ (আনকাক) এ জনপ্রতিনিধিসহ সব সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব প্রতিবছর দাখিল ও তার বছরভিত্তিক পর্যালোচনার কথা বলা হয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল, ২০১২এর মাধ্যমে এ অঙ্গীকারের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিগত ১৬ বছরে প্রশাসনের যেসব কর্মকর্তারা অতিমাত্রায় লুটপাট করে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তারাই এই আইন সংশোধনে শেখ হাসিনা সরকারকে চাপ দিচ্ছেন। কারণ, তাদের সম্পদের বিবরণী জমা দিলে দুর্নীতি-লুটপাটের সব তথ্য প্রকাশ হয়ে পড়বে। এই কারণে এ আইনের সংশোধনী চান।
যাই হোক, বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বিদেশ থেকে জনগণের নামে ঋণ করে সেই ঋণের টাকা নিজেরা লুটপাট করে বিদেশে অর্থ পাচার করে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থা আরো শোচণীয়। বর্তমানে রাজধানী ঢাকা শহরের শতকরা ৬০% এর বেশি মানুষ তাদের সাধারণ ব্যয় মেটানোর ক্ষমতা রাখে না। একজন সাধারণ কর্মীর গড় মাসিক ইনকাম ১৮ থেকে ২৪ হাজার টাকা, যা এই শহরে তিনজন পরিবারের সদস্য হলে তাদের ব্যায় মেটানো সম্ভব না। মেগা প্রজেক্ট পদ্মা সেতু,পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র জনগণের টাকায় করলেও টোল দেওয়ার মতো অবস্থা সাধারণ মানুষের নেই। এরপরও বাংলাদেশের মানুষের মাথায় চেপে বসা ঋণ সাধারণ মানুষের থেকেই নেওয়া হবে। ফলে স্বাধীনতার ৫৪ বছরের এই পর্যায়ে দেশ যদি দেউলিয়া হয়, এটা আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছুই হবে না।