ঢাকা অফিস: ভোল্ট পাল্টাতে শুরু করেছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক ব্যবসায়ীরা। দীর্ঘ ১৬ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিতর্কিত সরকারকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন তারা। তবে ছাত্র-জনতার অভূত্থানের মধ্যদিয়ে দেশের দৃশ্যপট পাল্টে যাওয়ার পরই ওই অলিগার্কদের কণ্ঠে ভিন্ন সুর। তাদের মুখে এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা।
গেল বছর দেশের ব্যবসায়ীদের সমর্থন আদায়ের জন্য গণভবনে বৈঠক ডাকেন শেখ হাসিনা। সেখানে হামিম গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ কবির সুমনের একটি গান উল্লেখ করে শেখ হাসিনার সরকারের ওপর ভরসার কথা জানান। তখন তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই…. ভীষণ অসম্ভবে তোমাকে চাই।’
ব্যবসায়ীদের এমন দলকানার মতো সমর্থনে তখন অনেকেই আলোচনা-সমালোচনা করেছিলেন। এর মাঝে এবছর যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলন তীব্র হয় তখন আবারও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। ছাত্র-জনতার ওপর আওয়ামী লীগ ও সরকারের বিভিন্ন বাহিনী নির্বিচারে হত্যা চালালেও ব্যবসায়ীরা শেখ হাসিনার প্রশংসা করেন।
ওই সময় বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার কাছে আবারো প্রতিজ্ঞা করে গেলাম- আপনার সাথে আমরা ছিলাম, আমরা আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।’
সেখানে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, ‘আপনার হাতকে শক্তিশালী করা দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকদের দায়িত্ব। যারা খারাপ কাজ করছে, যারা আমার দেশকে পুড়িয়েছে, অসভ্যপনা করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
আন্দোলন চলাকালে ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এর পর কয়েকশ’ শিক্ষার্থী-জনতাকে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনায় গোটা দেশ যখন বিক্ষুধ তখন ২৩ জুলাই গণভবনে গিয়েছিলেন এই ব্যবসায়ীরা।
ওই সভায় স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে সমর্থন জানিয়ে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান বলেন, ‘আমাদের আপনার নেতৃত্বের ওপর বিশ্বাস আছে। ইনশাল্লাহ, মৃত্যুর আগে এবং পরে পর্যন্ত আপনার ওপর আমাদের আস্থা ও বিশ্বাস থাকবে।’
গত ১৬ বছরে শেখ হাসিনার শাসনামলে অনেক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে হাজার হাজার টাকার লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপি ছিল ২২ হাজার কোটি টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা।
এছাড়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বাজারে সিন্ডিকেট করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। নিত্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও ১২ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। গত বছর বসুন্ধরা গ্রুপ থেকে শুরু করে সিটি গ্রুপের বিরুদ্ধে কারণ ছাড়াই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ ওজনে কম দেওয়া ও ভেজাল পণ্য সরবরাহের অভিযোগে প্রতিযোগিতা কমিশনে অনেক মামলাও হয়েছে।
বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগও আছে শীর্ষ এই ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। দুবাই, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করে অঢেল অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা। আর এসবের সুযোগ করে দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। এসব কারণে স্বৈরশাসক হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার অন্যতম কুশীলবের ভূমিকায় ছিল এই ব্যবসায়ীরা।
তবে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে নিজেদের অবস্থান বদলাতে শুরু করেছেন তারা। সুর বদলে অলিগার্করা এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে ভেড়ার চেষ্টা করছেন।
এ বিষয়ে সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বিশ্লেষক এবং অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অলিগার্করা আবার যেন পুরনো খেলায় মেতে উঠতে না পারে সেই ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারকে সজাগ থাকতে হবে।’
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন সুরমায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে হামিম গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ বলেন, ‘এ সরকারের আমলে আমি যদি বিপদে পড়ি, তখন তো পুলিশকে পাওয়া যাবে না। তাহলে আমরা কার কাছে যাব। সে ব্যাপারগুলো বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমরা তুলি। তিনি আমাদের এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি জসিমউদদীন বলেন, ‘এ ক্রাইসিস (সংকট) অবস্থায় ব্যবসায়ীদের এক জায়গায় থাকতে হবে।’
স্কয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান অঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা এখন মিথ্যা কথা বলছেন। আমরা কোন না কোন দলের কথা শুনি। কেউ বিএনপি, কেউ আওয়ামী লীগ বা জামায়াতকে সমর্থন করি। এখন অনেকেই বলছি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার খুব ভালো।’
গত ২২ আগস্ট শিল্প-কারখানার পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে দেখা করেছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ বৈঠকে ব্যবসায়ী আব্দুল আওয়াল মিন্টু থাকলেও অন্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের আশির্বাপুষ্ট অলিগার্করাও ছিলেন।
সেই দিনই দেশের অন্যতম বড় শিল্প গ্রুপ বসুন্ধরা, সামিট, নাসা, ওরিয়ন ও বেক্সিমকোর মালিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের লেনদেনের তথ্য চেয়ে সব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চিঠি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর। কর ফাঁকির অভিযোগ অনুসন্ধান কার্যক্রমের স্বার্থে এই চিঠি দেওয়া হয়।