।। ধ্রুব সাদিক।।
একটি প্রত্যন্ত গ্রামের অতিদরিদ্র এবং স্বল্পশিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে ভীষণ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেও বলেছিলেন তিনি, তাঁর সামনে হিমালয়ও নতশির। আধুনিক বাংলা গানের জগতে খ্যাত তিনি ‘বুলবুল’ নামে। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তাঁর অবদানই মূলত গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয় তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই বাংলা ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল। বাংলাদেশের অলিখিত জাতীয় কবি এবং অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতিক্ষেত্রের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কাজী নজরুল ইসলামের আজ ৪৪-তম মৃত্যুবার্ষিকী।
নজরুল ইসলাম যখন সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন, পৃথিবীর অধিকাংশ রাষ্ট্রই ছিল তখন উপনিবেশ, আর অধিকাংশ মানুষই ছিল পরাধীন। উপনিবেশ আর পরাধীনতার কষাঘাতে জর্জরিত মানুষ, পর্যুদস্ত মানবতা। পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ, ক্ষমতা ছিল মুষ্টিমেয় কতিপয় লোকের হাতে; যা তখনও ছিল এখনও আছে। বাংলা শিল্পসাহিত্যে নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিলেনই যেন মূলত সব ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য। ফলে বলা যায় নজরুল ইসলামের মতো সাম্যবাদের এমন জোরালো প্রবক্তা পৃথিবীতে কবি-সাহিত্যিক খুব কম জন্মগ্রহণ করেছেন। চোর-ডাকাত কবিতায় কবি বিশ্বব্যাপী অসাম্যের কারণ অনুসন্ধানে প্রয়াসী হয়েছিলেন। কবির মতে ভয়ংকর হ’ল তারা যারা অন্যের সম্পদ লুট করে ‘পেতেছে বিশ্বে বণিক-বৈশ্য অর্থ-বেশ্যালয়’। আর এদের কারণেই:
অন্ন, স্বাস্থ্য, প্রাণ, আশা, ভাষা হারায়ে সকল-কিছু,
দেউলিয়া হয়ে চলেছে মানব ধ্বংসের পিছু পিছু,
পালাবার পথ নাই,
দিকে দিকে আজ অর্থ-পিশাচ খুড়িয়াছে গড়খাই।
[চোর-ডাকাত]
নজরুল তার কবিতায় ব্যতিক্রমী এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা আগে কখনও ব্যবহৃত হয়নি। কবিতায় তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে ধারণ করেছিলেন; পাশাপাশি মানবসভ্যতার মৌলিক সমস্যাও ছিল তাঁর কবিতার উপজীব্য। নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় প্রকাশিত এক পত্রের মাধ্যমে নজরুলের ‘খেয়া-পারের তরণী’ এবং ‘বাদল প্রাতের শরাব’ কবিতাদুটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেছিলেন,’মহান আল্লাহ ও তাঁর পয়গম্বর মোহাম্মদ-কে নিবেদন করা কাজী নজরুল ইসলামের যেই চার শতাধিক প্রেমসঙ্গীত রয়েছে, তা গোটাবিশ্ব মুসলিমের কাছে নিয়ে যাওয়া যায়।’
নজরুল ইসলামকে হরহামেশাই বাঙালি মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। তাঁর সমকালেই অনেকে তাঁকে অভিহিত করেছেন ‘যুগমানব’ অভিধায়। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে এমন নয়। উপরে বলা মোহিতলালের কথাগুলোতে যে সম্প্রদায়গত বিবেচনা কাজ করেছে; আর, এসব মূল্যায়ন ঠিক কবি হিসাবে নয়, বরং নজরুলের সর্ববিধ কর্মকাণ্ড ও অবদানের সারাৎসার; এবং এগুলো মোটের উপর আমজনতার উচ্চারিত-অনুচ্চারিত অভিব্যক্তি— প্রাতিষ্ঠানিক কেতায় উৎপাদিত বিশেষজ্ঞ-মন্তব্য নয়, সেটা পরিস্কার হয় অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্যে। শিবনারায়ণ রায় বলেছেন, ‘এক হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত অসাম্প্রদায়িক কবি আর দেখা যায়নি। তাঁর পরিচয় ছিল মানুষ হিসাবে।’ সব ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে ছিলেন নজরুল ইসলাম, এবং অন্তরে তিনি না-ছিলেন হিন্দু না-ছিলেন মুসলিম, তাঁর নিজের লেখা একটি কথাতেই এটা পরিষ্কার করে লেখা, ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব জাত জালিয়াত খেলছো জুয়া।’
অসাম্প্রদায়িক নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় জন্ম দেন এক নতুন ধারার। ইসলামী সঙ্গীত তথা গজল, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেন অনেক উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত ও হিন্দু ভক্তিগীতি। সেই সময়ে সাম্প্রদায়িকতা দূর করার যতরকমের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, বলা যায় নজরুল ইসলাম সেসব উদ্যোগে জড়িত ছিলেন ওতপ্রোতভাবে। নজরুলের শেষ ভাষনেও ব্যাপারটির উল্লেখ আছে – “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’
মানবসৃষ্ট অসাম্যের সকল প্রাচীর ভেঙে নজরুল সাম্যের গান শুনিয়েছেন। মানব-সাগরে তিনি সকলকে সমান দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং সাম্যের বার্তা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন-
গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান,
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুস্লিম ক্রীশ্চান।
[সাম্যবাদী ]