- সর্বনিম্ন ভোটের হারের রেকর্ড
- ভোট বর্জন করে জনতার ঐতিহাসিক রায়
বাংলাদেশ নিউজ ডেস্ক: দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে শেখ হাসিনার অবৈধ সরকার যা চেয়েছে, সেটাই হয়েছে। এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলাদেশের অনৈতিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাতানো নির্বাচনের হ্যাট্রিক করেছেন। তবে ভোটের আমেজ বা উৎসব বলতে যা বোঝায়, এই ডামি নির্বাচনে তা দেখা যায়নি। ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষার যে চিরাচরিত ছবি, সেই ছবি ছিল মোটের ওপর অনুপস্থিত। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো অংশ না নেওয়ায় ডামি নির্বাচনটি একদিকে যেমন অংশগ্রহণমূলক হয়নি, তেমনি খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বরং এই প্রহসনের ডামি নির্বাচন সর্বনিম্ন ভোটের হারের রেকর্ড করেছে।
শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর দল জনগণের অংশগ্রহণকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্ত হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলেছিল। একারণে তাদের মূল চ্যালেঞ্জ ও চেষ্টা ছিল ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা, কিন্তু সেই উদ্যোগ সফল হয়নি। বরং ভোট কেন্দ্রগুলোতে বরাবরের মতই কুকুর ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। ফলে এই নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে খোদ নির্বাচন কমিশন দ্বিধায় রয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল একবার বলছেন, ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছে, আবার বলছেন ৪০ শতাংশ পড়েছে। সর্বশেষ অনেক প্রস্তুতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে জানান দিয়েছেন ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। তিনি যেন নিজের কথাই বিশ্বাস করছেন না।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গত কয়েক মাসে বহুবার একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ৭০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে, তিনি আবার নির্বাচিত হবেন। ওই জরিপ গত আগস্টে প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। বহুল আলোচিত সেই জনমত জরিপে রেকর্ড ৯২ শতাংশ ভোটার জানিয়েছিলেন, তাঁরা ভোট দিতে চান। এখন যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উল্লেখ করা ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটকে সঠিক বলে গণ্য করা হয়, তাহলেও ভোট দিতে আগ্রহী অন্তত ৫৮ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যাননি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হিসাব নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। কেননা, ভোট শেষ হওয়ার ঘণ্টাখানেক আগে যেখানে ভোটের হার ২৬ শতাংশ দেখানো হয়েছিলো, সেখানে এক ঘণ্টায় আগের সাত ঘণ্টার অর্ধেকের বেশি ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, সম্ভব কি না—সেটাও এক বিরাট প্রশ্ন। এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষের ভোট দিতে না যাওয়া, তার কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক ও অভিযোগ আছে এবং মানুষের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে, স্পষ্টতই সেগুলোর একটা প্রভাব দেশের বেশির ভাগ মানুষের ওপর পড়েছে। কোন সময় একতরফা নির্বাচন আবার কোন সময় সব দলের অংশগ্রহণের পরও নির্বাচনকে যেভাবে শেখ হাসিনা সরকার নিয়ন্ত্রণ করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে, রাতের আধাঁরে যেভাবে ব্যালট বাক্স ভরেছে, তার তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিতে জনগণ এই নির্বাচন নামক পাতানো খেলায় অংশ না নিয়ে সরকারকে সরাসরি লাল কার্ড দেখিয়েছে। ফলে দেশের গণতান্ত্রিক শক্তির সব আশংকা সত্য হয়েছে। ভোট বর্জন করে জনগণ ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে।

জনগণ নির্বাচন নামক সরকারের পাতানো খেলা ভেঙে দিয়েছে। অথচ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে নিতে সরকার কত চেষ্টাই না করেছে। ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনতে তারা ঘোষণা দিয়ে ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে। বিরোধী দল হিসেবে পুতুল জাতীয় পার্টিকেও সরকার ইচ্ছামতো কাজে লাগিয়েছে। সরকারি দলের লোকদের মধ্যে কে নৌকা প্রতীক পাবে আবার কে হবেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সেটাও কূটকৌশলে নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু জনগণ অন্যটা ভেবেছে। সব মিলিয়ে জনগণ ভেবেছে এখানে তাদের ভোটের কোনো প্রয়োজন নেই। যেমনটা এর আগের দুটো জাতীয় নির্বাচন এবং এই সরকারের অধীনে আয়োজিত বেশির ভাগ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা গেছে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের অনেকে বলছেন, দুই থেকে তিন শতাংশ ভোটার কেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারেন। তবে কেন্দ্রের বাইরে দলীয় লোকদের জটলা সবসময় লেগে ছিল। পর্যবেক্ষকদের দেখানোর জন্য কৃত্রিমভাবে লাইন করা হয়েছে। আবার তারা চলে গেলে লাইন আর থাকেনি। কোন কেন্দ্রেই উল্লেখ করার মত ভোটারের দেখা মেলেনি। কিছু কিছু কেন্দ্র সারাদিনই ছিল একেবারে ফাঁকা। সরকারের ইচ্ছার ওপর প্রার্থীর বিজয় নির্ভর করেছে। ফলে ক্রমাগত প্রতারিত হয়ে ভোটাররা কেন্দ্রে না গিয়ে ভোট বর্জন করেছে। বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে শিশুদের নিয়ে গিয়ে ভোট দেওয়ানো হয়েছে, শিশুদের ভোট দিতে দেখা গেছে। ভোটার না থাকায় কেন্দ্রগুলোর বাইরে কুকুরের আনাগোনা দেখা গেছে। এক তরফা নির্বাচন পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটি প্রহসনে পরিণত করেছে। ৭ই জানুয়ারি নির্বাচনের নামে যে একতরফা সাজানো প্রহসন হয়ে গেলো তাতে সে সংকটের নিরসন হয়নি, বরং আরো গভীর হয়েছে। ঘোষিত ফলাফলে ভোট দেয়ার হার যাই দেখানো হয়ে থাকুক, বাস্তব সত্য হচ্ছে, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এই প্রহসন বর্জন করেছে। সারা দেশের ভোট কেন্দ্রগুলো ছিল ভোটারশূন্য এবং খুবই নগণ্য হারে ভোট পড়েছে। সাধারণ মানুষের এই বর্জন আসলে ভোট-বিমুখতা নয়, এটি বর্তমান সরকার ও শাসকগোষ্ঠীর প্রতি নীরব গণ-অনাস্থার সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। দৃশ্যমান এই অনাস্থা ক্ষমতাসীনদের বৈধতার ভিত্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। মুখে যে যাই বলুক, এটা সকলেই অনুধাবন করতে পেরেছে। এর ফলে ভেতরের বাইরের চাপ আরো বাড়তে থাকবে এবং স্থিতিশীলতা বিপন্ন হবার আশঙ্কা রয়েছে।
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার অন্যতম কারণ নিশ্চয়ই বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জন, কেননা ভোটারদের সামনে বিকল্প অনুপস্থিত। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আসন ভাগাভাগি ও নিজেদের ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের ভোটকে কার্যত মূল্যহীন করে তোলা হয়েছে। এই বিষয়টি ভোটারদের ভালো লাগেনি। যে নির্বাচনের ফলাফল সবার জানা, সেই ফলাফলকে বৈধতা দেওয়ার দায় তাঁরা কেন নেবেন? দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল সরকারের ক্ষমতা নবায়নের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতাহীন, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন তামাশাপূর্ণ এক আনুষ্ঠানিকতা। একারণে শত ভয়-ভীতি, প্রলোভন ও সরকারের আহ্বানে উপেক্ষা করে ভোট প্রদান না করার মাধ্যমে জনগণ এই নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে অতি স্বল্প সংখ্যক ভোটারের অংশগ্রহণে সরকারের নৈতিক পরাজয় হয়েছে। এই প্রহসনমূলক নির্বাচন দেশকে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
৭ জানুয়ারী যদি কোন নির্বাচন হয়ে থাকে, তবে সেই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জিতেনি, বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলীয় জোট জিতেছে। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগ রাষ্ট্রীয় শক্তির সর্বোচ্চ অপব্যবহার করেও স্থানভেদে ৮-১০ শতাংশের বেশি ভোট অর্জন করতে সমর্থ হয়নি। অর্থাৎ দেশের ৯০ শতাংশ জনগণ বিরোধী জোটের ভোট বর্জনকে সমর্থন করেছে। তাই এই নির্বাচনে জিতেছে বিরোধী জোট। এটি একটি গণভোটও বলা চলে, যাতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সাথে সম্মিলিত বিরোধী দল জনগণের আস্থা অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্র ফেরানোর সংগ্রাম এবং জনগণের ভোটাধিকার আনার যে ম্যান্ডেট এবং দায়িত্ব বিরোধী জোটের হাতে জনগণ তুলে দিয়েছে, বিরোধী জোট সেই শক্তিকে কাজে লাগিয়ে অবশ্যই সেই অভীষ্ট লক্ষ অর্জনে সক্ষম হবে।
এই নির্বাচন কতগুলো সত্য আমাদের সামনে হাজির করেছে। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণ না থাকলে সেই নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ থাকে না। এমন নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলনও ঘটে না। দ্বিতীয়ত, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিছক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির হয় না। সেখানে নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডামি নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে যেসব স্বতন্ত্র প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। এমনকি জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি দলও নির্বাচন করেছে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে। আসলে নির্বাচন হয়েছে আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ-নির্ভর দলগুলোর মধ্যে। এরপরেও এই নির্বাচনের ফলাফল ছিলো সবার জানা। একারণে এই ডামি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে না গিয়ে জনগণ বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটের ভোট বর্জনকে সমর্থন করেছে; বিরোধী জোটের গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন; বিরোধী জোটের হাজার হাজার রাজবন্দীর প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছেন।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পরপর তৃতীয়বারের মতো ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাঁদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে, তা শিগগিরই নিরাময় হবে বলে মনে হয় না। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা আত্মতৃপ্ত বোধ করতে পারে; কিন্তু গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ কখনোই তাদের জন্য সুখকর হবে না। রিজার্ভ তলানিতে, প্রবাসী আয়ে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি, রফতানিতে ভাটার টান, রাজস্ব আয়ের লক্ষ অর্জনে ব্যর্থতা এবং ব্যাংক খাতে সার্বিক ধস, বিপুল অঙ্কের অর্থ অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে ব্যয়ের ফলে বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত হয়ে পড়া এসব বর্তমান সময়ে অর্থনীতির বাস্তব চিত্র। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস তুলেছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রায় শূন্য, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগেও চলছে স্থবিরতা। লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করেও জ্বালানি খাতে কোনো অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারেনি সরকার। কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে, কল-কারখানা বন্ধ হয়ে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে।
এই সঙ্কট উত্তরণে সরকারকে এমন শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে যে যা কোন ‘নির্বাচনের নৈতিক মানদণ্ডে দুর্বল’ সরকারের পক্ষে মোকাবেলা করা সহজ হবে না। কারণ জনগণের ম্যান্ডেট ছা্ড়া রাজনৈতিকভাবে দুর্বল কোন সরকার কখনো স্বাধীনভাবে কিছু করতে পারে না। আওয়ামী লীগের দুর্বলতা কোথায় তা সবার জানা। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটও তাদের জন্য অনুকূল নয়। সবচেয়ে বড় কথা, ক্ষমতাসীন দলটির মানসিক গঠনপ্রকৃতি। গত ১৫ বছরে দেশ বা জাতির জন্য সত্যিকার অর্থে দীর্ঘমেয়াদে কল্যাণকর হবে এমন প্রকল্প বা কর্মসূচি তাদের আমরা দিতে দেখিনি। বরং জনগণের চোখে দৃশ্যমান উন্নয়নে তারা অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আর দলটির মন্ত্রী, এমপি এমনকি স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা বিপুল অর্থের মালিকে পরিণত হয়েছেন। লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত অপরিমেয় অর্থ তারা বিদেশে পাচার করে দিয়েছিন। তাদের অপশাসনামলে বিপুল ঋণখেলাপি দেশের অর্থনীতির ঘাড়ে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছেন। কোনো ব্যবস্থা নেই। এমতাবস্থায় এই সরকারের পদত্যাগ ছাড়া ভিন্ন কোন পথ নেই।