বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিরবিচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন, যেখানে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন শুধু পৃথিবীর মৌলিক বাস্তুসংস্থানই নয়, একই সঙ্গে বিশাল জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার।
জীববৈচিত্র্যের প্রাচুর্যের জন্য ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। আর ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর ইউনেসকো সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে। দেশের অন্তত ৪০ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল। অসংখ্য প্রাণী ও উদ্ভিদে ভরা সুন্দরবনে ৪৫০টি নদনদী ছড়িয়ে রয়েছে।
ঝড়ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিঝড় আম্পান, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে এলাকাকে বাঁচাতে সুন্দরবন এক সাহসী যোদ্ধা। ঢাল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে সৈনিকের মতো সুন্দরবন রক্ষা করেছে উপকূলীয় লাখো মানুষের জীবন, তাদের বাড়িঘর, পশুপাখি, বেঁচে থাকার একান্ত সম্বল। বাংলাদেশের রক্ষাকবচ হয়ে আজ দাঁড়িয়েছে সুন্দরবন। বুক পেতে প্রতিহত করেছে বাতাসের প্রবল তোড়। দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবনের রয়েছে অনবদ্য ভূমিকা।
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট নিছক একটি বন নয়, এটি একটি ইকোসিস্টেম। এর নদ-নদী, চারিদিকে ঘিরে থাকা বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের এক অনন্য সম্পদ। অথচ অত্যাচার-অনাচারে জর্জরিত বিশ্বপ্রকৃতির বিরলতম সম্পদ বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ক্রমাগত অস্তিত্ব-ঝুঁকির মুখে পড়ছে। সুন্দরবন হারাতে বসেছে তার অতীত ঐতিহ্য। দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য।
বিশ্বে যে ১৩টি দেশে বাঘ রয়েছে এরমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বিশ্বের বিভিন্ন আঞ্চলে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা গেলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও নানা প্রতিকূল পরিবেশ, নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে শুধু বাঘ নয়, বনের সামগ্রীক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। সুন্দরবনে জীবনযাপনে নানা প্রতিকূলতার পাশাপাশি সাগরে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে মিষ্টি পানি পানে অভ্যস্ত বাঘ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।
এছাড়া ঝড়ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী হতাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এছাড়া চোরাকারবারিদের বাঘ শিকার, লোকালয়ে আসা বাঘকে পিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও ঘটছে মাঝেমধ্যেই। চোরাশিকারিরা নানা রকম অখাদ্য কুখাদ্য ও নেশাদ্রব্য খাইয়ে বাঘকে ক্রমেই দুর্বল করে ফেলে। এমনকি দূর থেকে বাঘের দেহে বিষাক্ত ইনজেকশন ছুড়ে মারার মতো নৃশংস কাজও করছে তারা। সুকৌশলে হত্যার পর বাঘের চামড়া, মাংস, হাড়, দাঁত ও চর্বি উচ্চমূল্যে বিক্রি করে অবৈধ অর্থ উপার্জনের উন্মত্ত নেশায় মেতে ওঠে চোরাশিকারিরা।
সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ নদী ও খালে রয়েছে ১২০ প্রজাতির মাছ। জাহাজের প্রপেলারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ ছাড়া রাতে চলাচলের সময় টর্চ লাইটের তীব্র আলো ও শব্দ হরিণ এবং নিশাচর প্রাণীসহ সুন্দরবনের পশু-পাখির জীবনচক্রের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফলেছে।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করা হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, সর্বশেষ ২০১৮ সালে ক্যামেরা ট্র্যাপিং পদ্ধতিতে করা জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনে ১১৪টি বাঘ, এক থেকে দেড় লাখ হরিণ, ১৬৫ থেকে ২০০টি কুমির এবং ৪০ থেকে ৫০ হাজার বানর রয়েছে।
সুন্দরবন একাডেমির পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবন একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যের আধার অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের রক্ষাকবজ। তাই এটা মানুষের স্বার্থের জন্যই রক্ষা করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এতে সুন্দরবন সুরক্ষা অনেক সহজ হবে, সঠিক সময়ে সঠিক পরিকল্পনা করা যাবে।
খুলনা অঞ্চলের প্রধান বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সুন্দরবন প্রকৃতিগতভাবেই সৃষ্টি, প্রকৃতিই এর রক্ষক। এটা কখনো ধ্বংস হয়ে যাবে না। তারপরও সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ জায়গা অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কয়েকটি ডলফিন অভয়াশ্রমও গড়ে তোলা হয়েছে। বনের মধ্যে মিষ্টি পানি সংরক্ষণে ৪টি পুকুর নতুন করে খনন করা হয়েছে, পুনঃখনন করা হয়েছে ৮০টি পুকুর।