বাংলাদেশের মানুষকে বলা হয় মাটির মানুষ। সোনার এই বাংলার মানুষ সবসময়ই চায় এ দেশের উর্বর মাটির গন্ধ মাখা সংস্কৃতি। চলচ্চিত্রের কাছেও তাঁদের এই চাওয়া চিরদিনের। দেশীয় চলচ্চিত্রের গোড়া পত্তন থেকেই নির্মাণ হয়ে আসছে এ দেশের মাটি ও মানুষের গল্পনির্ভর চলচ্চিত্র। কমপক্ষে আশির দশক পর্যন্ত এই চিত্র বজায় ছিল বলেই তখনকার চলচ্চিত্রকে সোনালি দিনের চলচ্চিত্র বলা হতো। এরপর বিদেশি ছবির নকল ও ছবিতে দেশের যাপিত জীবনের ছায়া থাকত না বলেই দর্শক ধীরে ধীরে সিনেমা হলবিমুখ হতে শুরু করে। মাঝে মধ্যে যখন দুয়েকটি দেশের গল্পনির্ভর ছবি মুক্তি পায় তখনই আবার সিনেমা হলে ছুটে যায় সব শ্রেণি-পেশার দর্শক। ‘মনপুরা’, ‘মোল্লাবাড়ীর বউ’, ‘হৃদয়ের কথা’, ‘চন্দ্রগ্রহণ’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘ছুঁয়ে দিলে মন’সহ এ জাতীয় সব ছবিই দর্শকগ্রহণযোগ্যতার অন্যতম উদাহরণ। চলতি বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। এ বছর গত শুক্রবার পর্যন্ত মুক্তি পেয়েছে মোট ২৬টি ছবি। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ও ভিন্নধারা, উভয় ধরনের ছবিই ছিল। এ দুই ধারার মধ্যে দর্শকগ্রহণযোগ্যতায় এগিয়ে ছিল গল্পনির্ভর ছবিগুলোই। যেমন- ‘অলাতচক্র’, ‘পদ্মাপুরাণ’, ‘চন্দ্রাবতী কথা’, ‘রিকশা গার্ল’ (বিদেশি উৎসবে প্রদর্শিত), ‘রেহানা মরিয়ম নূর’, ‘নোনা জলের কাব্য’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’, ‘কালবেলা’, ‘মৃধা বনাম মৃধা’, ‘মিশন এক্সট্রিম’ প্রভৃতি। এদিকে বছরের শেষ ছবি হিসেবে মুক্তি পেতে যাচ্ছে সরকারি অনুদানে মীর সাব্বির নির্মিত ‘রাত জাগা ফুল’ ছবিটি। এটি মুক্তির আগেই দর্শকের মধ্যে ছবিটি নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। চলতি বছর উল্লেখযোগ্য যেসব ছবি দর্শক মন কেড়েছে সেসব গল্পের ছবির গল্প ছিল সংক্ষেপে এমন- ১০ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’। ২০১৪-১৫ সালে সরকারি অনুদানে তৈরি এই সিনেমার কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা করেছেন নূরুল আলম আতিক। এই চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট ছিল এমন- ‘১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ এক বন্দীশালা। বিহারি অধ্যুষিত ছোট এক শহর। সেখানে ব্রিটিশদের গড়া বিমানবন্দর সচল করতে সেনাবাহিনী আসে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে জনপদে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা। এর বাইরেও ছিল মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য প্রেক্ষাপট। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’তে অভিনয় করেছেন লায়লা হাসান, আহমেদ রুবেল, আশনা হাবিব ভাবনা, দিলরুবা দোয়েল, স্বাগতা, শিল্পী সরকার অপু, ইলোরা গওহর, জ্যোতিকা জ্যোতি প্রমুখ। একই দিন মুক্তি পায় সাইদুল আনাম টুটুলের ‘কালবেলা’। মুক্তিযুদ্ধের দহনকালের ঘটনা নিয়ে নির্মিত হয় চলচ্চিত্রটি। সরকারি অনুদানে নির্মিত এই চলচ্চিত্র মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী সময় নারীদের দহনকালের সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা বই ‘নারীর ৭১’ ও যুদ্ধপরবর্তী সময়ের কথ্যকাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত। তৎকালীন সদ্য পাস করা সানজিদা নামের এক শিক্ষিত নারীর জীবনের ছায়া অবলম্বনের ঘটনা। সানজিদা মাস্টার্স পাস করা একটা ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করে। ছেলেটা খুলনা জুটমিলে অফিসার পদে চাকরিতে যোগ দেয়। বিয়ের দুই-আড়াই মাসের মাথায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনারা অন্য অফিসারের সঙ্গে সানজিদার স্বামীকে গ্রেফতার করে। সানজিদা পাগলের মতো স্বামীকে খুঁজতে থাকে। শেষে স্বামীর পরিহিত গায়ের জামা দেখে তাকে শনাক্ত করে। এমনই হৃদয়স্পর্শী গল্প নিয়ে এগোয় চলচ্চিত্র ‘কালবেলা’। এতে অভিনয় করেছেন তাহমিনা অথৈ, শিশির আহমেদ, মাসুম বাশার, মিলি বাশার, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, লুৎফর রহমান জর্জ প্রমুখ। ‘রাত জাগা ফুল’ নামে দেশের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র পরিচালনা করলেন অভিনেতা মীর সাব্বির। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মীর সাব্বিরের এই চলচ্চিত্রটি ৩১ ডিসেম্বর মুক্তি পেতে যাচ্ছে। পরিচালনার পাশাপাশি মীর সাব্বির এতে অভিনয় করেছেন। আরও অভিনয় করেছেন চুমকি, তানভীর, ঐশী, ফলজুর রহমান বাবু প্রমুখ। মীর সাব্বির বললেন, নামটা রূপক অর্থে ব্যবহার করেছি। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা অন্ধকার থাকে। সেই অন্ধকারের পর একটা আলো আসে। বোঝাতে চেয়েছি আলো এবং অন্ধকারের মাঝখানে মানুষ বিচরণ করে, সেখান থেকে আলোর বিচ্ছুরণটাকে ধরে নিই বিজয়। রাত জাগা ফুলে বাংলাদেশের ঘ্রাণ পাওয়া যাবে। ২৪ ডিসেম্বর মুক্তি পায় ‘মৃধা বনাম মৃধা’। সিয়াম-নোভা অভিনীত এই ছবিটি মূলত একটি পারিবারিক ক্রাইসিস নিয়ে তৈরি। নোভার প্রথম চলচ্চিত্র এটি, একই সঙ্গে সিয়াম-নোভার দারুণ রসায়নকেই নির্মাতা এখানে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। সঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন শক্তিমান অভিনেতা তারিক আনাম খান। সিয়াম বলেন, এই ছবিটির গল্পের প্রতি ভীষণ আশাবাদী কারণ পরিবার নিয়ে দেখার মতো একটি ছবি। এই ছবির গল্পই এক দর্শক আরেক দর্শককে টেনেছে।
চলতি বছর মুক্তি পাওয়া ‘নোনা জলের কাব্য’ ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর একটি মূল ভূখন্ড হতে বিচ্ছিন্ন প্রান্তিক জেলেপল্লীর জনগণের পরিবর্তিত পরিবেশে সংগ্রাম ও পাশাপাশি জেলেদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতিকে ধর্মাশ্রয়ী মানুষের সদা প্রভাবের পটভূমিতে বর্ণিত গল্প। ছবিটিতে অভিনয় করেন তিতাস জিয়া, ফজলুর রহমান বাবু, অশোক ব্যাপারী, তাসনুভা তামান্না প্রমুখ।
‘পদ্মাপুরাণ’ ছবিটি নির্মাণ করা হয়েছে পদ্মাপারের মানুষের সুখ-দুঃখ, জীবনযাত্রার মান, সীমান্ত দিয়ে মাদক পারাপারসহ নানা বিষয় নিয়ে। এর মধ্যে ওঠে এসেছে প্রতিবন্ধী একটি পরিবারের গল্প। যে পরিবারের চারজনের মধ্যে দুজনই প্রতিবন্ধী। পদ্মার চরে হাজার প্রতিকূলতার মধ্যে তাদের টিকে থাকার গল্প। এই সিনেমায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নিখুঁতভাবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন অভিনেত্রী শম্পা রেজা। এখানে তাঁকে তৃতীয় লিঙ্গের প্রধান হিসেবে দেখ গেছে। সিনেমাটির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে এই চরিত্রটি। যিনি কি না সেই প্রতিবন্ধী ছোট মেয়েকে (ময়না) তৃতীয় লিঙ্গ মনে করে তার দলে টেনে নেন। পরে দেখা যায় তিনি তৃতীয় লিঙ্গ নন। বড় হওয়ার পর অন্যের দ্বারা গর্ভবতী হয়ে পড়েন ময়না। এই ময়নার চরিত্রটিই হলো গল্পের নায়িক সাদিয়া মাহি।
দেশ বিদেশে আলোচিত প্রশংসিত ও পুরস্কৃত ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবির গল্পে দেখা যায় একটি বেসরকারি কলেজের ৩৭ বছর বয়সী শিক্ষিকা রেহানা মরিয়ম নূরকে কেন্দ্র করেই এ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরি হয়। যেখানে রেহানা একজন সিঙ্গেল মা, মেয়ে, বোন ও শিক্ষিকা হিসেবে কঠিন জীবনযাপনে অভ্যস্ত। রেহানা মরিয়ম নূর ৬ বছর বয়সী এক কন্যার মা! মেয়েকে একা বড় করা, বাবা, মা ও ভাইয়ের দেখাশোনা, খরচ জোগাড় সবই করতে হয় তাকে? তিনি এক সন্ধ্যায় কলেজ থেকে বেরোনোর সময় অপ্রত্যাশিত ঘটনার সাক্ষী হন। এরপর থেকে তিনি তার মেডিকেল কলেজের ছাত্রীর পক্ষ হয়ে সহকর্মী অপর শিক্ষকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ঘটনার প্রতিবাদ জানান। আর এ প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে তিনি ক্রমেই একরোখা হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে শুরু হয় নানা সংঘাত। ওই ছাত্রীর জন্য ন্যায়বিচারের খোঁজ করতে থাকেন নূর। এই চরিত্রে আজমেরী হক বাঁধন অনবদ্য অভিনয় করেছেন।
সবশেষে বলা যায়, এভাবেই যাপিত জীবনের গল্প নিয়ে নির্মিত উল্লিখিত ও নির্মিত প্রতিটি ছবিই দর্শক সাদরে গ্রহণ করেছে।