১৯৭৩ সালে মুক্তি পাওয়া সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ ছবিতে পশ্চিমবাংলার প্রখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে প্রথম বাংলাদেশি নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একই নামে লিখা একটি উপন্যাস অবলম্বনে সেই ছবি নির্মিত হয়েছিল। যে ছবিটি ছিল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম রঙিন ছবি।
তেতাল্লিশের মন্বন্তর ও তার পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণ বাংলার আর্থ-সামাজিক পটপরিবর্তন নিয়ে নির্মিত সেই ‘অশনি সংকেত’ ছবির রেশ ধরেই প্রথমবার সৌমিত্রের সঙ্গে দেখা হয়েছিল ববিতার। সেখান থেকেই দুজনের পরিচয় এবং পরস্পর আরও কাছাকাছি আসা।
টানা ৪১ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় মৃত্যুর কাছে হার মেনে পাড়ি জমিয়েছেন না ফেরার দেশে। কিন্তু ববিতার চোখে সেই সৌমিত্র দা’কে ঘিরে অজস্র স্মৃতি আজ যেন শোকের কালো মেঘ হয়ে আকাশে ভাসছে।
রবিবার দুপুরে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে সৌমিত্র শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরই তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ‘অশনি সংকেত’ এর অনঙ্গ বউ’খ্যাত অভিনেত্রী ববিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রিয় অভিনেতার স্মৃতিচারণ করেন।
ববিতা বলেন, ‘সৌমিত্র বাবু একজন অসাধারণ মানুষ। উনি এত বড় একজন শিল্পী যে আমি বলে বোঝাতে পারবো না। আর আমি যখন ১৯৭৩ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ সিনেমায় কাজ করতে গেলাম তখনই দাদার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। তখন আমার বয়সটাও কম ছিল, ১৫-১৬ বছর। ঢাকায় তখন মনে হয় দু-একটি ছবি করেছি, আমি খুব যে চলচ্চিত্রের সবাইকে চিনি তা বলবো না, আমি শুধু ‘অপুর সংসার’ ছবিটা বোধহয় দেখেছিলাম।’
সৌমিত্রের সঙ্গে প্রথম দেখার সেই মুহূর্তটির বর্ণনা করতে গিয়ে ববিতা বলেন, ‘প্রথম দেখা হয় বীরভূম-শান্তিনিকেতনের একটি আউটডোর লোকেশনে, সেখানে উনার পোশাক-আশাক গেটআপ দেখে আমি অদ্ভূতভাবে তাকিয়ে ছিলাম। তারপর উনি খুব আদর করে কাছে ডেকে বললেন, ‘তুমি জানো, আমি যে গঙ্গাচরণ আর তুমি হচ্ছো গিয়ে অনঙ্গ বউ’।’
ঢাকাই ছবির এই সোনালী যুগের নায়িকা বলেন, ‘সৌমিত্র দা’র সঙ্গে কাজ করেছি। উনার যে সুন্দর ব্যবহার… এবং আমি নার্ভাস হয়েছিলাম বিদেশি আর্টিস্ট, আমি কাজ করতে পারবো কি পারবো না। কিন্তু দেখলাম, উনি এত আপন করে নিয়েছেন, মোটেও আমার খারাপ লাগেনি। একটা জিনিস খুব অদ্ভূত লেগেছে, আমি যখনই ক্যামেরার সামনে শট দিচ্ছিলাম, তখনিই সৌমিত্র দা’কে দেখেছি ওই ক্যামেরার পাশে মানিক দাদা ক্যামেরার লুক থ্রো করছে, লুক নিচ্ছে; উনি পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন অভিনয় করছি না করছি, সেটা দেখছেন…।’
‘কাজের ফাঁকে আমাদের খুব মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করতেন। দাদা শুটিংয়ের ফাঁকে কবিতা আবৃত্তি করতেন, শরীরচর্চা করতেন। শুটিং শেষে কলকাতায় ফেরার পথে ট্রেনে বসে গেম খেলতাম। জার্মানির বার্লিন ফেস্টিভ্যালে আমরা যেদিন গোল্ড পেলাম, সেদিন যে কী অবস্থা! সেদিনের সৌমিত্র দা’র মুখের অদ্ভূত খুশিটা আমি আগে কখনও দেখিনি।’
‘সৌমিত্র দাদা প্রায়ই ঢাকায় আসতেন। তিন-চার বছর আগে একটা আয়োজন হলো, সৌমিত্র দাদা আসছেন… ববিতাও আসুক…। সেখানে দাদাকে দেখে আমি একদম দরজা দিয়ে ঢুকে ‘দাদা, আপনাকে এতদিন পর দেখছি’ বলে দৌড় দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। সে কী যে একটা ফিলিংস আমি বলে বোঝাতে পারবো না। কলকাতায় গেলেও দাদার সঙ্গে ফোনে কথা হতো।’
সবশেষ সৌমিত্রের সঙ্গে কথার প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘এই তো তুমি কেমন আছো? তুমি শুনলাম অনেক বিখ্যাত হয়েছো, অনেক ছবিটবি করছো, অনেক পুরস্কার জিতেছো। তুমি যখন ‘অশনি সংকেত’ করেছ তখন আমরা বুঝতে পেরেছি, তুমি একদিন অনেক বড় হবে।’
ববিতা প্রিয় অভিনেতাকে নিয়ে আরও বলেন, ‘দাদা আমাকে নিয়ে অনেক ইন্টারভিউতে ভালো ভালো কথা বলতেন। উনি আমাদের হৃদয়ে থাকবেন চিরকাল। উনি এত বড় একজন শিল্পী, আমি মেনেই নিতে পারছি না যে, আজ তাঁর আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি।’