।। আসাদ মিরণ।।
বাগদাদ: টাইগ্রিস নদের তীরে বাগদাদের এক প্রাসাদে শেহেরজাদে এক হাজার এক রাত যাপন করেছিলেন। তার এক হাজার একটি গল্পের জন্ম সেখানে হয়েছিল অথবা পারস্য, আরব, ভারত, চীন বা তুর্কিস্তান থেকে সেখানে পাড়ি দিয়েছিল, ঠিক যেমনটি সুদূর দেশ থেকে বাণিজ্যিক কারাভাঁয় (শকটে) নিয়ে আসা হাজার-একটি বিস্ময় শহরের বাজারের দোকানগুলিতে ঠাঁই করে নেয়। বাগদাদ তখন বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। সকল পথ, সকল কথা আর দ্রব্যসামগ্রী এসে মিলিত হ’ত শহরের প্লাজায়, ফোয়ারায়, স্নানাগারে আর উদ্যানে। জগতের অতি বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ, জ্যোতির্বিদ, ও গণিতবিদরাও বাগদাদের বিজ্ঞান একাডেমিতে এসে জড়ো হ’ত, যা ‘হাউজ অব উইজডম’ নামে পরিচিত ছিল। তাদের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ আল-খাওয়ারিজমি, অ্যলজেব্রার (বীজগণিত) উদ্ভাবক, তার একটি বইয়ের নামের প্রথম শব্দ ছিল ‘আল-জাবর’, সেই অনুসারেই অ্যলজেব্রার নামকরণ হয়।
শরাবের কন্ঠস্বর: ওমর খৈয়াম বীজগণিত, দর্শন ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি ছিলেন গুপ্ত কবিতার রচয়িতা, যার কবিতা মানুষের মুখে মুখে পারস্য ছাড়িয়েও নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁর রচিত সে সব কবিতায় ছিল শরাবের প্রতি প্রশস্তি আর পাপজনক রসবোধ, ইসলামী শাসকদের দৃষ্টিতে যা ছিল অপরাধ। কবি বলেন, “ঈশ্বর আমার আবির্ভাবের কথা জানেন না আর আমার প্রস্থানেও তাঁর সৌন্দর্য ও মহিমা বিন্দুমাত্র ম্লান হবে না। যে চাঁদ কাল আমায় খুঁজবে, আমাকে সে খুঁজে না পেলেও আকাশে উঠবে। আমি মাটির নীচে ঘুমিয়ে থাকব, না থাকবে নারী, না কোন বন্ধু। আমাদের মতো ক্ষণিকের অতিথিদের কাছে বেঁচে থাকার মুহুর্তটাই চিরন্তন, সুতরাং তার জন্য কাঁদার চেয়ে তাকে পান করাই উত্তম।” খৈয়াম মসজিদের চেয়ে সরাই-খানাকেই বেশী পছন্দ করতেন। তিনি পার্থিব শক্তি বা দৈব হুমকি কোন কিছুকেই ভয় করতেন না। ঈশ্বরের জন্য তাঁর করুণা বোধ হত, কেননা তিনি কখনও মদ খেয়ে মাতাল হতে পারেন না। ‘সর্বোৎকৃষ্ট’ শব্দটি কোরআনে লেখা নেই, কিন্তু সুরার পাত্রের কিনারে সে কথা লেখা আছে। চোখ দিয়ে তা পড়া যায় না, চেখে দেখতে হয়।
ধর্মযুদ্ধ: মাত্র দেড় শতাব্দির ব্যবধানে, ইউরোপ প্রাচ্যের অবিশ্বাসী দেশগুলিতে আটটি ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ পরিচালনা করে। যীশুর পবিত্র সমাধি দখল করা ইসলাম ছিল খ্রিস্টানদের পুরনো শত্রু। অতএব বিশ্বাসের এই যোদ্ধারা তাঁদের যাত্রা পথে মানচিত্রের বাকি দেশগুলি নিশ্চিহ্ন করার সুযোগ নিয়েছিল। ঘর থেকে পবিত্র এই যুদ্ধের শুরু হয়। প্রথম ক্রুসেড ইহুদিদের সিনাগগ বা ধর্ম মন্দির পুড়িয়ে দেয় এবং মেইনজ ও জার্মানীর অন্যান্য শহরের একজন ইহুদিকেও তাঁরা জীবিত রাখেনি। চতুর্থ ক্রুসেড যেরুজালেমের পথে যাত্রা করে কিন্তু সেখানে আর পৌঁছাতে পারে না। খ্রিস্টান যোদ্ধারা সমৃদ্ধ শহর খ্রিস্টান কনস্টানটিপোলে থামে, এবং তিন দিন তিন রাত্রি ধরে তাঁরা সেখানে লুঠতরাজ করে। গীর্জা, মঠ কোন কিছুই বাদ দেয় না। তারপর সেখানে যখন ধর্ষণের জন্য আর কোন নারী অথবা বস্তা ভরার লক্ষ্যে আর কোন প্রাসাদ লুটের জন্য অবশিষ্ট না থাকে, তখন তাঁরা তাঁদের পবিত্র অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্যের কথা ভুলে গিয়ে লুন্ঠিত মালামাল উপভোগের জন্য সেখানেই থেকে যায়। কয়েক বছর পর, ১২০৯ সালে, ফরাসী মাটিতে খ্রিস্টানদের নির্মূল করতে আরেকটি ক্রুসেড পরিচালনা করা হয়। বিশুদ্ধতাবাদী খ্রিস্টান ক্যাথারসরা রাজা অথবা পোপের ক্ষমতা অস্বীকার করত। তাঁদের বিশ্বাস, সকল প্রকার যুদ্ধেই ঈশ্বরের মৃত্যু হয়, এমনকি ঈশ্বরের নামে পরিচালিত ক্রুসেডেও। অত্যন্ত জনপ্রিয় এই প্রচলিত বিরুদ্ধ মতকে সমূলে উৎপাটন করা হয়। শহর থেকে শহরে, দূর্গ থেকে দূর্গে, গ্রাম থেকে গ্রামে অভিযান চলে। সবচেয়ে ভয়াবহ নৃশংসতা ঘটে বেজিয়েরে। সেখানে প্রত্যেকের হাতে ছুরি ছিলঃ ক্যাথারস আর ক্যাথলিক উভয়ের কাছে। কেউ কেউ ক্যাথেড্রালে আশ্রয় খুঁজেছিল। নিরর্থক, একজনও নিষ্ঠুর হত্যালীলা থেকে রেহাই পায়নি। কে যে কার, তার বাছ-বিচার করার সময় ছিলনা। কোন কোন ভাষান্তর অনুযায়ী, পোপের দূত আর্নাউড-অ্যামৌরি, পরের দিকে যিনি নারবোনের আর্চবিশপ হন, বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে আদেশ দেনঃ “সকলকে হত্যা কর; কেননা প্রভু জানেন, তারা প্রভুরই।”
ঐশ্বরিক আদেশ: খ্রিস্টীয় সশস্ত্রবাহিনীর মধ্যে স্বাক্ষরতার হার তেমন বেশী ছিল না। মুসার ফলকে লেখা আদেশগুলি পড়তে না পারার সেটা একটা ব্যাখ্যা হতে পারে। তাঁরা পড়ল যে ঈশ্বর আদেশ করেছেন, তাঁর নাম নেয়া নিরর্থক। সুতরাং ঈশ্বরের নাম নিয়ে যা কিছু করা যায়, তাঁরা তাই-ই করল। তাঁরা পড়ল যে ঈশ্বর তাদের মিথ্যা বলার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং ধর্মবিরোধীদের বিরুদ্ধে পবিত্র যুদ্ধে স্বাক্ষরিত চুক্তির প্রায় সবটাই তাঁরা লঙ্ঘন করল। তাঁরা পড়ল যে ঈশ্বর তাদের চুরি করার আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং প্রাচ্যের পথে তাঁদের সামনে যা কিছু পড়েছিল, সবটাই লুঠ করেছিল। পবিত্র ক্রুশের আশ্রয় ও পোপের আশীর্বাদ তাঁদেরকে আশ্বস্ত করেছিল যে, তাঁদের সকল প্রকার ঋণ ক্ষমা করা হবে আর তাঁদের আত্মা অনন্তকালের জন্য রক্ষা করা হবে। তাঁরা পড়ল যে ঈশ্বর তাদের যৌনাচার করার আদেশ দিয়েছে। সুতরাং প্রভুর সেবকরা যীশুর সশস্ত্রবাহিনীর জন্য শুধু অসংখ্য পেশাদার ভাড়া করেই ক্ষান্ত হননি, উপরন্তু তাঁদের জন্য লুটের মালের অংশ হিসেবে বন্দি বিধর্মীদেরও দেয়া হয়েছিল। এবং তাঁরা পড়ল যে ঈশ্বর তাঁদের হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। ফলে, সমস্ত শহরে রায়ট চলে, শিশুরাও তা থেকে বাদ যায় নাঃ ধর্ম বিরোধীদের কলুষিত ভূমি নিষ্কলুষ করার পবিত্র খ্রিস্টীয় কর্তব্যবোধে অথবা সাধারণ প্রয়োজনবোধে, সিংহহৃদয় রিচার্ডের ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, যিনি স্রেফ বন্দিদের গলা চিরে ফেলেন কারণ তাঁরা তাঁর কাজের গতি কমিয়ে দিচ্ছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, “রক্ত ছিটিয়ে তাঁরা হেঁটে যাচ্ছিল।”
ফরাসী নারীতে পাগল: সুলতান সালাদিনের ডান ছিলেন ইমাদ আদ্-দ্বীন। তাছাড়া, তিনি ছিলেন একজন জমকালো কবি। তিনি দামেস্কর প্রায় তিন’শ ফরাসী পতিতা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছিলেন, যারা তৃতীয় ক্রুসেডের সময় যীশুর যোদ্ধাদের সঙ্গ দিতে এসেছিলঃ তাঁরা সকলেই ছিল বন্য ব্যভিচারী, উদ্ধত এবং অবজ্ঞাকারী, তাঁরা কেবল দিত আর নিত, নিরেট কামুক পাপী, বিলাপকারী আর ছিনাল, সহজলভ্য কিন্তু অহংকারী, হঠকারী, অতিশয় আকুল, রঙ্গিন এবং রঙ মাখা মূর্তি, কাঙ্খিত, মনোরম, নিখুঁত সৌন্দর্যপূর্ণ, কৃতজ্ঞ, যারা ভাড়া দিয়েছে আর ভাড়া নিয়েছে, ধ্বংস আর পুননির্মাণ করেছে, হারিয়ে গিয়েছে আবার খুঁজেও পাওয়া গেছে, চুরি হয়ে গিয়েছে এবং সান্তনা পেয়েছে, অযাচিত প্রলোভনসঙ্কুল, অবসন্ন, আকাঙ্ক্ষিত এবং কাম্য, চঞ্চল ও হতবুদ্ধিকারী, সর্বদা পরিবর্তনশীল, পাকা, দারুণ কঁচি, কামার্ত, নিজেদের অর্পণ করে, প্রেমময়, আবেগপ্রবণ, নির্লজ্জ, অসংযমী পোঁদ আর সরু কোমর, মাংসল উরু, আনুনাসিক কন্ঠস্বর, কালো চোখ, নীল চোখ, পাংশু চোখ। আর আহ্ কি দারুন-কোন উচ্চবাচ্য নেই।
কবি নবী: মুহাম্মদের উত্তরসূরিরা পরস্পরের বিরুদ্ধে মারামারি করতে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল, শিয়ার বিরুদ্ধে সুন্নি, কায়রোর বিরুদ্ধে বাগদাদ, এবং মুসলিম বিশ্ব পারস্পরিক এই ঘৃণার জেরে বহু খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। নিজেদের মধ্যে এ যুদ্ধে, মুসলিম বাহিনীর সংহতি নষ্ট হয়ে যায় আর সেই সুযোগে ক্রুসেডাররা বিনা বাধায় বিজয়ীর গতিতে পবিত্র সমাধিস্তম্ভে ঢুকে পড়ে। এক আরব কবি, যিনি আরবদের দৃষ্টিকোন থেকে আরব সম্পর্কে থেকে লিখেছেন। তিনি এই ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন এভাবে: এই দেশে দু’ধরণের মানুষ আছে: যাদের ঘিলু আছে, কিন্তু ধর্ম নাই আর যাদের ধর্ম আছে, কিন্তু কোন ঘিলু নাই অধিকন্তু ভাগ্য আমাদের চূর্ণবিচূর্ণ করেছে যেন আমরা কাঁচের তৈরী, এবং ভাঙা সেই টুকরোগুলি কোনদিনই আর জোড়া লাগবেনা।
কবির নাম আবু আলী আল-মা’আররি। ১০৫৭ সালে সিরিয়ার মা’আররাত শহরে তিনি মারা যান, চল্লিশ বছর পূর্বে খ্রিস্টানরা এই শহরকে তিলে তিলে ধ্বংস করে। কবি নাকি অন্ধ ছিলেন। তাঁরা তাই-ই বলে।