।। শাহদীন মালিক ।।
এক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো নির্দিষ্ট ও নির্ধারিত সংজ্ঞা নেই। আমাদের মতো আইন নিয়ে যাঁদের কায়কারবার, তাঁদের চিন্তাভাবনাটাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সংজ্ঞাকেন্দ্রিক। যেমন চুরি। কী কাজ করলে চুরি হবে, দণ্ডবিধিতে তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। আপনার কাজ যদি এই চুরির সংজ্ঞার মধ্যে না পড়ে, তাহলে আপনাকে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করা যাবে না।
আইনি অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো সংজ্ঞা নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার একটা ধারণা আমাদের সবার জন্যই স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল কতগুলো ধারণা বাস্তবায়নের স্পৃহা, তাগিদ ও দৃঢ় বিশ্বাস থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পরে দেশ স্বাধীন হলে সেই দেশের মানুষের কী কী সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত হবে, সে সম্পর্কেও স্বচ্ছ ধারণা বেশির ভাগ নাগরিকের ছিল। এই ধারণা ও আকাঙ্ক্ষার পেছনে ছিল পাকিস্তান আমলের তিক্ত অভিজ্ঞতা। পাকিস্তান দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের নাগরিক হিসেবে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে আমরা বাঙালিরা ছিলাম বঞ্চিত। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের স্বপ্ন ছিল, আমাদের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সেই সব সুযোগ-সুবিধা এবং অধিকার আমাদের জন্য নিশ্চিত ও সুদৃঢ় করা হবে।
এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে সেই অধিকারগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে ফেলার রূঢ় উপলব্ধি। ভোট গেছে, মাঝেমধ্যে কিছু ভোটাভুটি হয়, তবে স্পষ্টতই এই ভোট সেই ভোট না। আমরা এখনো কিছু কথাবার্তা বলি, লেখালেখি করি, সমালোচনা করি, কিন্তু এসবই করি রয়েসয়ে, চৌদ্দবার চিন্তাভাবনা করে। চোর-ডাকাতেরা এখন আইনকে ততটা হয়তো ভয় পায় না। তারা ‘ম্যানেজ’ করায় অনেক পারদর্শী হয়ে উঠেছে। কিন্তু বলা-লেখার লোকজনের ডিজিটাল আইনের শঙ্কা ও ভীতি অনেক অনেক বেশি। আমাদের করের টাকা লুট হচ্ছে। এখন তো অন্তত শতকোটি টাকার দুর্নীতি না করলে সংবাদমাধ্যমে নাম ফাটে না। সরকার হাজার-লক্ষ কোটি টাকা ক্রমান্বয়ে ধার করছে। এই ধার তো আর মন্ত্রীরা শোধ করবেন না। শোধ করতে হবে আমাকে, আপনাকে, বছর বছর, দশক দশক ধরে। এই বছরের বাজেটে দেখলাম, সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা! সামলান এখন মেগা প্রকল্পের ঠেলা।
হারাতে হারাতে প্রায় সবকিছুই এখন তলানির দিকে। তবে একটা অধিকার এখন পর্যন্ত শুধুই অক্ষত না, বরং দিন দিন বাড়ছিল। দুনিয়াও আমাদের এই সাফল্যকে ইদানীং স্বীকার করছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জরিপে অন্তত এই একটা অধিকারের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশসহ অনেক দেশকে আমরা আস্তে আস্তে ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম।
২.
দুই-তিন বছর আগে ব্যাংককে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজে চড়ে। উড়োজাহাজে যাঁরা চড়েন, তাঁরা সবাই জানেন, আকাশে ওঠার ৫-১০ মিনিটের মাথায় উড়োজাহাজের ক্যাপ্টেন বা প্রধান পাইলট যাত্রীদের জন্য মাইকে তাঁর নাম বলে জানান দেন, আমি অমুক, এই প্লেন চালাচ্ছি এবং তারপর ছোটখাটো কয়েকটা তথ্য যেমন এত ফুট উচ্চতায় চড়ে কতক্ষণে উড়োজাহাজটি গন্তব্যে পৌঁছাবে, ইত্যাদি। নাম বললেন, গলা শুনলাম এবং স্পষ্টতই বোঝা গেল, বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন একজন বাঙালি নারী। তিন-চার দিন পর বাংলাদেশ বিমানেরই আরেকটি উড়োজাহাজে ব্যাংকক থেকে ঢাকার ফিরতি যাত্রা। আবার ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর এবং নাম উচ্চারণ, তিনিও বাঙালি নারী।
বহু বছর ধরে বিভিন্ন উড়োজাহাজ কোম্পানির জাহাজে চড়ে হিল্লি-দিল্লি, বিলাত-আমেরিকা করেছি। নারী ক্যাপ্টেনের কণ্ঠস্বর আমি কখনো শুনিনি, বাংলাদেশ বিমান ছাড়া। বলা বাহুল্য, সেই বিমানযাত্রার পর দেশ-জাতি নিয়ে বুক গর্বে ভরে উঠেছিল। শত বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা, নির্যাতন আর অনেক ধর্মীয় নেতাদের মধ্যযুগীয় বয়ান সত্ত্বেও এ দেশের নারীরা তিলে তিলে এগিয়ে যাচ্ছেন। একটু একটু করে রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতায় তঁারা আরও এগোবেন, এটা তো ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দেশের জন্য অতি স্বাভাবিক ও স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপার।
মুক্তিযুদ্ধের পর নারীদের বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত করে বঙ্গবন্ধু তাঁদের অবদানের যে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, সেই রকম মর্যাদা তৃতীয় বিশ্বে যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া কোনো দেশের নারীরা পেয়েছেন বলে জানা নেই। বলা বাহুল্য, নারী-পুরুষের সম-অধিকার সংবিধানস্বীকৃত। রাষ্ট্র কোনো কিছুতেই নারী-পুরুষের কোনো ধরনের, কোনো অছিলায় বৈষম্য করতে পারবে না। এত দিন বৈষম্যের পক্ষে গোঁড়া ধর্মীয় বক্তাদের কিছু অদ্ভুত বয়ান ছাড়া কোনো বক্তব্য চোখে পড়েনি বা শুনিওনি। তবে এখন পড়িনি আর শুনিনি কথাটা জোর গলায় আর বলা সম্ভব না। এখন সংসদীয় কমিটি ‘বয়ান ফরমাইয়াছেন’ যে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় তাঁদের যে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়, তাতে নাকি নারী কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকতে পারবেন না। বিষয়টা টিভির সংবাদে শুনেছি, খবরের কাগজেও পড়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও এই নিয়ে লেখালেখি-বলাবলি চলছে, কিন্তু এখনো বিশ্বাস করতে মন চায় না।
৩.
মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরও এই বাংলাদেশে সংসদীয় কমিটি রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান থেকে নারীদের বাদ দেওয়ার বিষয়টি আলোচনা ও সুপারিশ করতে পারে, এটা যেকোনো নাগরিকের পক্ষেই মেনে নেওয়া অসম্ভব। ধর্ষণ করে, ডাকাতি করে, প্রতারণা করে অপরাধীরা আমাদের অধিকারবঞ্চিত করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু বা অনেক অনেক সদস্য গুম করে, মিথ্যা মামলা দিয়ে, থানায় অথবা রিমান্ডে নিয়েও আমাদেরকে অধিকারবঞ্চিত করেন। ঘুষখোর আমলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের পেশাজীবীও আমাদের সম্পদ লুটপাট করেন এবং করতে পারেন। তবে এসব বেআইনি কাজ হয় চুপিসারে, লুকিয়ে ও লোকচক্ষুর আড়ালে আর মাঝেমধ্যে আমরা নাগরিকেরা জেনে ফেললে বা টের পেলে হইচই করি।
লুকিয়ে না, আলোচনাটা হয়েছে প্রকাশ্যে এবং খোদ একটা সংসদীয় কমিটিতে। কোনো সংসদীয় কমিটি আলোচনা করে মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান জানিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার অনুষ্ঠানে নারীদের অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করার মতো এত বড় অসাংবিধানিক, বেআইনি ও সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য কাজ যে করতে পারে, তা কখনো কল্পনাও করিনি। কমিটি নাকি আবার এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে কী যেন প্রস্তাবও পাঠিয়েছে।
অনেকেই অনেক কিছু না জানতে পারেন, না বুঝতে পারেন। এটা দোষের কিছুই নয়। কিন্তু কিছু পদে থেকে ন্যূনতম অনেক বিষয় জানা ও বোঝা অত্যাবশ্যক। মন্ত্রণালয়ের কোনো সচিব যদি বলেন, ‘আমি ইংরেজি পড়তে পারি না’ িকংবা ডাক্তার যদি বলেন, ‘রোগী দেখে প্রচণ্ড ভয় লাগে’, তাহলে তো হবে না। এই সংসদীয় কমিটির আলোচনা ও মন্ত্রণালয়কে দেওয়া পরামর্শ থেকে অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, তাঁরা কে এবং কী তাঁদের কাজ, সেটা জানা, বোঝা বা চিন্তা করার সময় ও সুযোগ হয়তো তাঁরা পাননি। অবশ্য সেটাও–বা ভাবি কেমন করে, কেননা এঁদের অনেকেই নাকি বেশ কয়েকবার সাংসদ হয়েছেন। অবশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আজকাল সাংসদ হতে জানা-বোঝা বা জনপ্রিয়তার প্রয়োজন পড়ে না।
আমরা আর কত পেছনে যাব? মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত নারী-পুরুষ সম-অধিকারও কি এখন আমরা হারাতে বসেছি?
ড. শাহদীন মালিক বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক

