শিরোনাম
শুক্র. ডিসে ৫, ২০২৫

বিজ্ঞাপনের প্রতিশ্রুতিতে তারকাদের দায়

।। কামাল আহমেদ ।।

ই-অরেঞ্জ নামের একটি অনলাইন বাণিজ্য বা ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান নিয়ে এখন নানা রকম অভিযোগ ও কেলেঙ্কারির কথা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি গুলশান থানায় প্রায় রেকর্ড সময় চাকরি করার বিরল সৌভাগ্যের অধিকারী পুলিশ ইন্সপেক্টর সোহেল রানার বেনামি বিনিয়োগের একটি প্রকল্প বলেও জানা যাচ্ছে। অত্যন্ত প্রতাপশালী এই ইন্সপেক্টর কপালের ফেরে দেশান্তরি হওয়ার চেষ্টার সময়ে ভারতে আটক হয়েছেন।

সাম্প্রতিক অন্যান্য আর্থিক কেলেঙ্কারির মতো ইন্সপেক্টর সোহেল রানার সহায়-সম্পদের সেসব বিবরণ গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। আমার লেখার বিষয় অবশ্য ওই আলাদিনের চেরাগের মালিক ইন্সপেক্টর নন বা তাঁর বেনামি কোম্পানি ই-অরেঞ্জ নয়; ই-অরেঞ্জ এবং এর মতো আরও যেসব অপরীক্ষিত ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করতে দেশের প্রতিষ্ঠিত তারকাদের ইমেজকে কাজে লাগায়, সেই তারকাদের বিষয়ে।

মেধা, যোগ্যতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারকারা খ্যাতি অর্জন করেন এবং জনমানসে তাঁদের যে ইমেজ বা ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে, তার সর্বোচ্চ আর্থিক মূল্য আদায় ও ভোগ করা তাঁদের ন্যায্য অধিকার। সুতরাং তাঁরা বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে অথবা কোনো পণ্য, পরিষেবা বা ব্র্যান্ডের প্রচার-প্রসারে অংশ নিলে আপত্তির কিছু নেই, সে ক্ষেত্রে তেমন কোনো আইনগত বাধাও নেই।

ভোগ্যপণ্য বিপণনের নতুন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ই-অরেঞ্জ ও ইভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে আগ্রহ তৈরি ও ক্রেতা আকর্ষণের জন্য তাই বেশ কিছু জনপ্রিয় তারকার শরণাপন্ন হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ভালো-মন্দ ওই সব তারকা ব্যক্তিজীবনের ব্যস্ততার মধ্যে কতটা গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করেছেন, তা বলা মুশকিল। তবে ই-অরেঞ্জের শুভেচ্ছাদূত হওয়ার কারণে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তা যে সুখকর নয়, সেটা তিনি ভালোই উপলব্ধি করেছেন। তাঁকে যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

এ ধরনের ঘটনা যে শুধু বাংলাদেশেই ঘটে, ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বিজ্ঞাপনে মিথ্যাচার কিংবা অসত্য তথ্য দিয়ে গ্রাহক বা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা অথবা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্যের প্রচার-প্রসারে অংশ নেওয়ার কারণে বহু তারকা সমালোচিত হয়েছেন। ভোক্তার জন্য ক্ষতিকর ও আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণেই এখন আর কেউ বিড়ি, সিগারেট ও তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপনে অংশ নেন না কিংবা শুভেচ্ছাদূত হন না।

২০১৬ সালেই ভারতে একটি নুডলস কোম্পানির বিজ্ঞাপন করার জন্য অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিনতা ও মাধুরী দীক্ষিত ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন। তখন ওই নুডলসে ক্ষতিকর রাসায়নিক পাওয়া গিয়েছিল বলেই ভারতজুড়ে হইচই পড়ে যায়। ভারতের তখনকার আইনমন্ত্রী প্রয়াত অরুণ জেটলি তখন বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া তথ্য বা দাবি করা পণ্য বা সেবার বিজ্ঞাপন বা সেগুলো অনুমোদনের ক্ষেত্রে অনুমোদনকারী তারকার ব্যক্তিগত দায় নির্ধারণ ও সাজার বিধান করে আইন প্রস্তাব করেন (সেলেবস কট ইন কন্ট্রোভার্সিস টু দেয়ার এনডোর্সমেন্ট ডিলস। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১১ নভেম্বর ২০১৬)। একই সময়ে চীনে আইন ছিল, কোনো তারকা কোনো পণ্যের বিজ্ঞাপন করতে চাইলে তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে সেই পণ্য ব্যবহার করে এর গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

ভারতে শেষ পর্যন্ত ভোক্তা সুরক্ষা আইন ২০১৯ সালে পাস হয় এবং সেই আইনের ৮৯ ধারায় প্রস্তুতকারক এবং সেবা প্রদানকারীর মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনে ভোক্তার ক্ষতির জন্য দুই বছরের জেল ও ১০ লাখ রুপি জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। অপরাধের পুনরাবৃত্তির বেলায় প্রতিবারের জন্য সাজা বাড়বে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা ৫০ লাখ রুপি।

”অসাধু ব্যবসায়ী বা কথিত উদ্যোক্তারা আমাদের আইনগত দুর্বলতা এবং আইন প্রয়োগে শৈথিল্য ও প্রশাসনের দুর্নীতির সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে সম্পর্কে খোঁজখবর ও প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামেন। এ কারণে একই ভুলের ফাঁদে আমরা বারবার পা দিই।”

বাংলাদেশের আইনটি ২০০৯ সালের। ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষা আইন ২০০৯-এর ৪৪ ধারায় মিথ্যা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ক্রেতাদের প্রতারণার সাজা এক বছরের জেল কিংবা সর্বোচ্চ দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। ওই আইনে ভোক্তাস্বার্থ সুরক্ষায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে একটি দপ্তরও প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তারা এখন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত ই-কমার্স নির্দেশিকা মেনে চলার নির্দেশনাও দিয়েছে। তবে ভারত ও বাংলাদেশের আইনে বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ ও পণ্য বা সেবা অনুমোদন অথবা সুপারিশের জন্য তারকাদের ব্যক্তিগত দায় নির্ধারণ করা নেই। সম্ভবত এ কারণেই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা বা তার বর্ণিত গুণাগুণের বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাই ছাড়াই আমাদের তারকারা সেগুলোর প্রতিনিধিত্ব করায় রাজি হয়ে যান। অথচ এর কারণে যে তাঁরা নিজেদের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন, সেটি খেয়াল করেন না।

সমস্যাটি যে শুধু তারকাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তা-ও নয়। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের প্রতারণামূলক ব্যবসায়িক উদ্যোগে ব্যবহৃত হতে পারে। যে ইভ্যালি এখন দেনার দায়ে ডুবতে বসেছে এবং হাজার হাজার ভোক্তা ও সরবরাহকারীকে অজানা ক্ষতির মুখে ঠেলে দিয়েছে, সেই প্রতিষ্ঠান আমাদের জাতীয় দলের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। এর আগে ২০১২ সালে বিপিএল ক্রিকেটে টাইটেল স্পনসর করেছিল কথিত পনজি স্কিম বা প্রতারণামূলক বিনিয়োগ কোম্পানি ডেসটিনি গ্রুপ।

দেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তার বিচারে জাতীয় দল কিংবা লিগ টিমের লোগোতে যেকোনো কোম্পানির নাম সেই কোম্পানির প্রতি মানুষের আস্থা তৈরিতে কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিশ্চয়ই নতুন করে আলোচনার অবকাশ নেই। অনিচ্ছাকৃত হলেও এ রকম প্রতারকদের সঙ্গে নিজেদের নাম জড়ানোর জন্য প্রতারিত ভুক্তভোগীদের কাছে ক্রিকেট বোর্ড এবং ওই সব তারকা কেউ কখনো দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এমন কোনো খবর আমাদের চোখে পড়েনি। তাঁদের কি কোনোই দায় নেই?

অসাধু ব্যবসায়ী বা কথিত উদ্যোক্তারা আমাদের আইনগত দুর্বলতা এবং আইন প্রয়োগে শৈথিল্য ও প্রশাসনের দুর্নীতির সুযোগ কীভাবে কাজে লাগানো যায়, সে সম্পর্কে খোঁজখবর ও প্রস্তুতি নিয়েই মাঠে নামেন। এ কারণে একই ভুলের ফাঁদে আমরা বারবার পা দিই। প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম পরিস্থিতি এড়ানোর উপায় কী? দায়িত্বশীলদের জবাবদিহির প্রশ্নটি এখানে সবার আগে, কিন্তু কার্যকর গণতন্ত্রের অনুপস্থিতিতে সেই আলোচনা অর্থহীন। এ ক্ষেত্রে আমাদের তারকারা যদি কিছুটা সতর্ক হন, ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের প্রতি দায়িত্বশীল হন, তাহলে হয়তো কিছুটা পরিবর্তন সম্ভব। উচ্চ আদালত বিভিন্ন বিষয়ে যেভাবে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন, সে রকম ভূমিকাও অবশ্য ভুক্তভোগীদের কষ্ট লাঘবে কাজে আসতে পারে। কথিত ভূমিদস্যুদের প্রতারণা থেকে নাগরিকদের বাঁচাতে ভুঁইফোড় আবাসন কোম্পানির বিজ্ঞাপন প্রকাশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞার কথা এ ক্ষেত্রে স্মরণ করা যায়। ● কামাল আহমেদ সাংবাদিক

সম্পর্কিত পোস্ট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *