আ ন ম জাফর সাদেক: কলকাতা থেকে দুই ঘণ্টার ফ্লাইট আন্দামানের রাজধানী পোর্ট ব্লেয়ার। অনেকটা ঝোঁকের বশেই আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ডে চলে এসেছি। ছোটবেলায় বই-পুস্তক পড়ে জেনেছিলাম সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা জারোয়া, ওঙ্গ, সেন্টিনেল, নিকোবরি, বাঙালিসহ অনেক প্রাচীন আদিবাসীদের নিবাস আন্দামানে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে হাজার মাইল দূরে বঙ্গোপসাগরে ছোট-বড় ৫৭২টি দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত ভারতের কেন্দ্রশাসিত একটি বিশেষ অঞ্চল এই আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ড। যার ৩৮টি দ্বীপে মনুষ্য বসতি আছে, তবে সবগুলো দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি নেই। এই অঞ্চলেরই একটা দ্বীপে জারোয়া, সেন্টিনেলিরা হাজার হাজার বছর ধরে আধুনিক সভ্য সমাজ থেকে নিজেদের আড়াল করে রেখেছে।
ওয়ান্ডুর, মুন্ডাপার্ক, করবিন্স কোভ বিচ
সময় নষ্ট না করে এয়ারপোর্ট থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসি। পোর্ট ব্লেয়ারের জামে মসজিদের পাশে একটা পছন্দসই হোটেলে ঠাঁই নিই। পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ওয়ান্ডুর বিচে বাসেই যাওয়া যায়। পিচঢালা আঁকাবাঁকা পথটির এক পাশে সমুদ্রের ঢেউয়ের ছলাত্ ছলাত্ শব্দ। হাজার হাজার নারকেল আর গুবাক তরু সারির মধ্যে ছোট ছোট মনুষ্য বসতিগুলো যেন কোনো চিত্রশিল্পীর আঁচড়ে আঁকা একেকটি ক্যানভাস। গাছের ডালে ডালে পাখির ঝাক। ওয়ান্ডুর বিচে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় জাল দিয়ে আবদ্ধ করে সুইমিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এই দ্বীপে প্রচুর কুমিরের আনাগোনা বলে নেটের বাইরে সাঁতার কাটলে কুমিরের পেটে চালান হওয়ার আশঙ্কা! পরের গন্তব্য মুন্ডা বিচ। চিদিয়াটাপ্পু নামে একটা রিজার্ভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে এই বিচে যেতে হয়। মুন্ডা পার্ক বিচের কোল ঘেঁষে এক ঘণ্টার একটি বিচ হাইকিং আছে। পর্যটকদের কাছে এই বিচ হাইকিং খুবই জনপ্রিয়। ওয়ান্ডুর আর মুন্ডা বিচ বিচরণ শেষে পড়ন্ত বিকেলে চলে এলাম করবিন্স কোভ বে আইল্যান্ডে। এটা পোর্ট ব্লেয়ারের খুব কাছে বলেই লোকে লোকারণ্য। প্রচুর বিদেশি পর্যটক বিচে সাঁতারসহ বিভিন্ন ওয়াটার অ্যাক্টিভিটি করছে।
রস আইল্যান্ড, নর্থ বে এবং সেলুলার জেলখানা
দ্বিতীয় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পোর্ট ব্লেয়ারের রাজীব গান্ধী ওয়াটার স্পোর্টস সেন্টারের আবেদিন জেটি থেকে রস আইল্যান্ড আর নর্থ বে আইল্যান্ডে রওনা দিলাম। রস আইল্যান্ড হারিয়ে যাওয়া এক প্রাচীন নগরী। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই রস আইল্যান্ড হয়ে ওঠে আন্দামানের প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র। এখানে গির্জা, বলরুম, পানি শোধনাগার, সেনা ব্যারাক, গভর্নমেন্ট হাউস, কমিশনারের বাসভবন, টেনিস কোর্ট, ছাপাখানাসহ আধুনিক নগরের সব সুযোগ-সুবিধা ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিরা এর দখল নেয়। কালক্রমে এখন এর নিয়ন্ত্রণ ভারতের নৌবাহিনীর হাতে। দেড় বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই আইল্যান্ডে কোনো স্থায়ী মনুষ্য বসতি নেই। ১৯৯৩ সাল থেকে পর্যটকদের জন্য দ্বীপটি উন্মুক্ত করা হয়েছিল। এখানকার ঘন জঙ্গলে হরিণ আর ময়ূরেরা অবাধে বিচরণ করে। ব্রিটিশদের বানানো প্রাসাদগুলোর ধ্বংসস্তূপ দেখে মনের অজান্তেই সেই প্রাচীন আমলে চলে গিয়েছিলাম।
এরপরের গন্তব্য নর্থ বে আইল্যান্ড। এই দ্বীপেও কোনো মানবসতি নেই। চারপাশে নারকেলের বাগান। স্কুবা ডাইভিং, বিচ হাইকিং, স্নরকেলিংসহ নানা অ্যাক্টিভিটি করতে লোকজন ছুটে আসে। আমি স্কুবা ডাইভিং বেছে নিলাম। সমুদ্রের তলদেশে প্রবালের ফাঁকে ফাঁকে হাজার প্রজাতির জলজ প্রাণীর সঙ্গে প্রায় তিরিশ মিনিট জলকেলি করলাম।
বিকেলের দিকে চলে এলাম কালাপানি নামে পরিচিত পোর্ট ব্লেয়ারের কুখ্যাত সেলুলার জেলখানায়। ১৮৯৬ সালে এর নির্মাণ শুরু আর শেষ হয় ১৯০৬ সালে। মিয়ানমার থেকে আনা ইট দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। আঠারো শতকের ইংরেজ দার্শনিক জেরেমি বেনথামের ভাবনায় গড়ে তোলা হয়। সেলুলার জেলের সেল সংখ্যা ৬৬৯টি। প্রতিটি সেলের আয়তন সাড়ে চার বাই পৌনে তিন মিটার। সেলুলার জেলখানার রাজবন্দিদের মধ্যে হোবির সিং, মোহন কিশোর নমদাস, মোহিত মিত্র, বটুকেশ্বর দত্ত, যোগেন্দ্র শুক্লা, বিনায়ক দামোদর সাভারকর, মৌলভি লিয়াকত আলী, সুবোধ রায়, দিওয়ান সিং কালেপানি, ফজলে হক খায়রাবাদী, হেমচন্দ্র দাস, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, লোকনাথ বল, উল্লাসকর দত্ত, হোরাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী, বারীন্দ্র কুমার ঘোষ উল্লেখযোগ্য। লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোর মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর যোদ্ধাদের ঐতিহাসিক কাহিনির বিবরণ শুনে যে কারো মস্তক শ্রদ্ধায় নত হয়ে যাবে।
বারাটাং আইল্যান্ড
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে ২৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটা ছোট দ্বীপ বারাটাং। এখানে যেতে হলে ভোর ৩টার সময় রওনা হয়ে জিরকাটাং চেকপোস্টে এসে রিপোর্ট করতে হয়। তারপর ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে জারোয়া অধ্যুষিত বনাঞ্চল দিয়ে। এই পথে গাড়ি থামানো কিংবা ছবি তোলা পুরোপুরি নিষিদ্ধ। নিয়ম ভঙ্গ করলেই জেল অথবা জরিমানা। বারাটাং আইল্যান্ড থেকে বোটে করে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর ব্যাকওয়াটারের মধ্য দিয়ে চুনাপাথরের গুহা দেখে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়। তবে লাইমস্টোন কেভের দিকে যেতে হলে বোট থেকে নেমে দেড় কিলোমিটারের একটা কষ্টকর হাইকিং করতে হয়। বারাটাংয়ের প্রধান আকর্ষণ ডে ভলকানো। এটি আন্দামান নিকোবর আইল্যান্ড এর একমাত্র আগ্নেয়গিরি। ২০০৫ সালে এটি সক্রিয় হয়েছিল।
হেভলক আর নীল আইল্যান্ড
পোর্ট ব্লেয়ার থেকে সরকারি ক্রুজে খুব সস্তায় হেভলক যাওয়া যায়। গ্রিন ওশান আর মর্কুজ নামে দুটি বিলাসবহুল ক্রুজও চলে। জেটি থেকে ৪১ কিলোমিটার দূরত্বের হেভলকে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। এই দ্বীপের বাসিন্দাদের আদি নিবাস ছিল বাংলাদেশ। শরণার্থী হিসেবে তারা এই জঙ্গলে বসতি গড়ে। এখানকার সুবিধামতো বাজেটের একটা কটেজে উঠে পড়লাম। এবার হেভলক ঘোরার পালা। রাধানগর, কালাপাথর, এলিফ্যান্ট বিচ এই আইল্যান্ডের উল্লেখযোগ্য সৈকত। রাধানগরে সাদা বালুকাবেলার সঙ্গে নীল সমুদ্রের জল যেন মিলেমিশে একাকার। এখানে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসে। নীল জলরাশির প্রেমে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। কালাপাথর, বিজয়নগর আর এলিফ্যান্ট বিচগুলোও আকর্ষণীয়। এলিফ্যান্ট বিচে যেতে হলে দুপুর ১টার মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের ভেতর দিয়ে বিচ সাফারি করে যেতে হয়। হেভলক থেকে নীল আইল্যান্ড যেতে চল্লিশ মিনিট লাগে। নীল আইল্যান্ডের বাসিন্দারাও বাঙালি। ওরা বাংলাদেশের পর্যটকদের খুব সমাদর করে। নীল আইল্যান্ডে স্কুবা ডাইভিং, স্নরকেলিংসহ বিভিন্ন ওয়াটার অ্যাক্টিভিটি করা যায়। দ্বীপে দেখার মতো উল্লেখযোগ্য হলো ভরতপুর বিচ, লক্ষ্মীপুর বিচ, ন্যাচারাল ব্রিজ বা হাওড়া ব্রিজ, যা কোরাল রিফের সমন্বয়ে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে। ভাটার সময় অনেক দূরে গিয়ে ন্যাচারাল সুইমিং পুলে সাঁতার কাটার অনুভূতি বহুদিন মনে রাখার মতো। বহু প্রজাতির বর্ণিল সামুদ্রিক কোরালসহ বিচিত্র সব ওয়াইল্ড লাইফের বিচরণ এই দ্বীপে।
কিভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে প্লেনে আন্দামান যেতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার মতো। প্লেনের রাউন্ড টিকিট পড়বে আট হাজার থেকে দশ হাজার টাকা। ভ্রমণের কিছু দিন আগে বুকিং দিলে অনেক সস্তায় বিমান টিকিট পাওয়া যাবে। তবে অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করলে কলকাতা, বিশাখাপত্তম কিংবা চেন্নাই থেকে জাহাজে করেও আন্দামান যাওয়া যায়। সময় লাগবে বাহাত্তর ঘণ্টার মতো। জাহাজের টিকিটের জন্য ইন্ডিয়ান শিপিং করপোরেশনে যোগাযোগ করতে হবে।