আমাদের সম্পর্কটা ছিল মামা–ভাগনির: সামিনা চৌধুরী
আমাদের সম্পর্কটা ছিল মামা–ভাগনির মতো। সেই ছোটবেলা থেকে কাওসার (কাওসার আহমেদ চৌধুরী) মামাকে দেখছি। কলেজ পার হওয়ার পর প্রথম তাঁর লেখা গান গাই। তাঁর লেখা আমার গাওয়া প্রথম গান ‘আমায় ডেকো না’। এরপরই গেয়েছিলাম ‘কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে’ গানটি। শেষ পর্যন্ত তাঁর লেখা পাঁচটি গানে কণ্ঠ দিয়েছি। বাকি তিনটি গান হলো ‘আমি অনুতপ্ত’, ‘রবি ঠাকুরের গান গাই’, ‘মনে রেখো কবিতার একটি চরণ, দ্য সিঙ্গার নট দ্য সং’। তাঁর যতগুলো গান আমি গেয়েছি এবং যতগুলো গান অন্যরা গেয়েছেন, সবই সুপারহিট।
আধুনিক গান সবাই লেখেন, কিন্তু গীতিকবি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল স্টাইলিশ ও ফ্যাশনেবল কথার মিশেলে গান তৈরি করা। এমন গান কেউ লিখতে পারেনি। তিনি নিজেও যেমন ফ্যাশনেবল ছিলেন, তাঁর লেখাও তেমন ছিল। আজ সবাই বলছেন, তিনি প্রচারবিমুখ মানুষ ছিলেন! প্রচারবিমুখ মানুষ বলে তিনি কিছুই চাননি, তা নয়। প্রচারবিমুখ মানে, আমি নিজে থেকে কিছু জানাতে চাই না। এই যেমন আল্লাহ আমাকে যে কণ্ঠ দিয়েছেন, তা আপনারা ব্যবহার করে আমাকে শিল্পী বানিয়েছেন। কাওসার মামাও তেমন ছিলেন, আমার আব্বাও। মামা সৃষ্টিশীলতায় ভরপুর একজন মানুষ ছিলেন।
ছোট্টবেলা থেকে আমি তাঁর ব্যাপারে কিউরিয়াস ছিলাম: শম্পা রেজা
কাওসার ভাই (কাওসার আহমেদ চৌধুরী) ও লাকী ভাইকে (লাকী আখান্দ্) সেই ১০ বছর বয়স থেকে চিনি। আমাদের ওল্ড ডিওএইচএসের বাসায় আড্ডার ছলে তো আমরা কত মজার মজার গান বানিয়েছি। ইট ওয়াজ মিউজিক লাইফ, যেটা বলে আরকি। আমাদের এমন আড্ডা হতো, একটা পরিবারের মতো হয়ে যাই। তাই তো স্বাভাবিকভাবে লাকী ভাই ও কাওসার ভাই আমার মামণিকে মামণি ডাকতেন, বাবাকে বাবু ডাকতেন—আমরা যে রকম ডাকতাম। অন্য রকম একটা ব্যাপার ছিল আমাদের।
কাওসার ভাই আমার প্রচণ্ড প্রিয় একজন মানুষ। খুব ছোট্টবেলা থেকে আমি তাঁর ব্যাপারে কিউরিয়াস ছিলাম। তাঁর ভাবনা-চিন্তা, ভাষার ভঙ্গি, গান রচনা তো বাদই দিলাম—তিনি যে কী ভালো ছবি আঁকতেন। এখনো ডায়েরি খুঁজলে পেলে কাওসার ভাইয়ের ছবি পাব।
১২-১৩ বছর তাঁর লেখা প্রথম গান গাই। ‘ওই চোখ তুলনাবিহীন’ গানটি গাওয়ার অনেক পরে জানতে পারি, এটি আমাকে নিয়ে লেখা হয়। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’, ‘আমায় ডেকো না’, এই গানগুলোর জন্মও আমার সামনেই। কাওসার ভাই যখন এসব লিখেছেন, তখন আমার বোঝার মতো বয়স ছিল না। আমি শুধু তাঁদের গান শুনে পাগল হতাম। আমার বাসায় বসে যে আমাকে নিয়ে লিখছেন, টেরই পেতাম না। আমাদের ওল্ড ডিওএইচএসের বাসার ছাদে কত আড্ডা। যখন বড় হয়েছি, একটু বোঝার মতো বয়স হয়েছে, তখন তাঁরা বলতেন, এসব গান আমাকে নিয়ে লেখা।
খুবই অসাধারণ সৃষ্টিশীল মানুষ তাঁরা। আমার সৌভাগ্য যে তাঁদের সঙ্গেই আমি বড় হয়েছি। আমাদের এই সম্পর্ক সংগীতের সম্পর্ক, সেই সম্পর্ক সব সময় ছিল। বছর চারকে আগে কাওসার ভাইয়ের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়। এরপর তাঁর ছেলে প্রতীকের কাছ থেকে বাবার খোঁজখবর নিতাম।
আমার পুরো জীবনে কাওসার ভাইয়ের লেখা পাঁচ-ছয়টি গান গেয়েছি। গীতিকবি হিসেবে তিনি তো দারুণ। এত আধুনিক। এত কাব্যিক। তাঁর লেখা ‘ওগো বসন্ত বান্ধবী মোর’ গানটি তো আমার এত প্রিয়, এত প্রিয়, বলে বোঝাতে পারব না। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটিও আমিই গেয়েছিলাম, বাংলাদেশ টেলিভিশনের একটি লাইভ অনুষ্ঠানে। ১৯৭৬-৭৭ সালে। আমার আজ একটা কথাই মনে হয়, আগে আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎটা অনেক আধুনিক ছিল। যত দিন গেছে, আমরা সবাই পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি, জানার আগ্রহের চেয়ে নিজেদের জাহির করার প্রবণতা জেঁকে বসে। আমরা ভুলে গেছি, আমাদের কবিতা পড়তে হবে, গল্প-উপন্যাস ও দেশ-বিদেশের ভালো লেখা পড়তে হবে। চমৎকার চলচ্চিত্র দেখতে হবে, গান শুনতে হবে, পেইন্টিং দেখতে হবে। প্রকৃতির সঙ্গে সাংঘাতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।